ফোরদো, ইরান, ইসরাইল, পারমাণবিক

ট্রাম্প বললেন ধ্বংস, পেন্টাগন বলছে ‘মিথ্যা’- ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে দ্বন্দ্ব

টুডেনিউজ ডেস্ক

গত শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের চালানো বিস্ফোরক বিমান হামলায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংস হয়নি বলে জানিয়েছে পেন্টাগন। দেশটির সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (ডিআইএ) এক মূল্যায়নে জানায়, এই হামলা ইরানের কার্যক্রমকে কেবলমাত্র কয়েক মাসের জন্য পিছিয়ে দিয়েছে, পুরোপুরি ধ্বংস করতে পারেনি।

উল্লেখ্য, শনিবার যুক্তরাষ্ট্র অত্যাধুনিক বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান ব্যবহার করে ফোর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহান—এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় ৩০ হাজার পাউন্ড ওজনের ‘বাংকার বাস্টার’ বোমা নিক্ষেপ করে। এই বোমা ৬০ ফুট কংক্রিট বা ২০০ ফুট মাটি ছেদ করে বিস্ফোরিত হতে সক্ষম। ওই হামলার পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একে ‘অত্যন্ত সফল’ বলে আখ্যা দেন।

তবে মাত্র তিন দিনের মাথায় পেন্টাগনের গোয়েন্দা ইউনিটের মূল্যায়ন সেই দাবির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তারা জানায়, হামলায় ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ ধ্বংস হয়নি, সেন্ট্রিফিউজগুলো প্রায় অক্ষত রয়েছে এবং ক্ষয়ক্ষতি মূলত অবকাঠামোগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ।

বিবিসির সহযোগী মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিবিএস নিউজকে গোপন সূত্র জানায়, হামলার আগেই ইরান তাদের ইউরেনিয়ামের কিছু অংশ স্থানান্তর করেছিল। এছাড়া, ভূগর্ভস্থ মূল স্থাপনাগুলো অনেকটাই অক্ষত রয়েছে। তারা বলেছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে কয়েক মাস পিছিয়ে দিয়েছে মাত্র, সর্বোচ্চ এইটুকুই।’

হোয়াইট হাউস অবশ্য এই গোয়েন্দা মূল্যায়নকে ‘সম্পূর্ণ ভুল’ বলেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতে, এই ধরনের মূল্যায়ন তাকে হেয় করার উদ্দেশ্যেই প্রকাশ করা হয়েছে। ট্রাম্প ট্রুথ সোশালে এক পোস্টে দাবি করেন, নিউইয়র্ক টাইমস ও সিএনএনের প্রতিবেদন ‘মিথ্যা’ এবং সামরিক ইতিহাসের অন্যতম সফল এক অভিযানের অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ এই গোয়েন্দা তথ্য ফাঁসকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘এটি অবশ্যই তদন্ত হওয়া উচিত। যারা দায়ী তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’ তিনি আরো বলেন, তিনি সব ক্ষয়ক্ষতির মূল্যায়ন প্রতিবেদন পড়েছেন এবং তার মতে, সবকিছু ‘সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে।’

হামলার পর স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গেছে, ফোর্দোর পারমাণবিক স্থাপনার দু’টি প্রবেশপথের আশপাশে ছয়টি নতুন গর্ত এবং ধুলোমাখা ধ্বংসস্তূপ রয়েছে। তবে এতে ভূগর্ভস্থ ক্ষয়ক্ষতির নির্দিষ্ট মাত্রা বোঝা যায়নি।

হামলার পর ড্যান কেইন, জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান বলেন, ‘চরম ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংস’ হয়েছে। একইসাথে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথও এই অভিযানকে ‘সম্পূর্ণ সফল’ বলে দাবি করেছেন।

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুও বলেন, ‘১৩ জুন থেকে ইরানের সাথে সঙ্ঘাত শুরুর পর থেকে ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা দমনে সফল হয়েছে এবং এর ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডারও ধ্বংস করেছে।’

অন্যদিকে, ইরানি রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার সংস্থার উপ-রাজনৈতিক পরিচালক হাসান আবেদিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যেসব স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে সেগুলো আগেই খালি করা হয়েছিল।’ ইরানের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, হামলায় বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি।

বিশ্লেষক ডেভিড অলব্রাইটের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলায় ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি পুনরুদ্ধারে ‘উল্লেখযোগ্য সময়, বিনিয়োগ ও শক্তির’ মুখোমুখি হবে। তিনি সতর্ক করে বলেন, ইরান যদি কর্মসূচি পুনরায় গড়তে চায়, তবে নতুন হামলার ঝুঁকি বাড়বে।

উল্লেখ্য, এই হামলার পর ইরান কাতারের আল-উদেইদ ঘাঁটিতে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যেখানে কয়েক হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছে। যদিও ওই হামলার বেশিরভাগই প্রতিহত হয় এবং কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

এর পরপরই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প উভয় পক্ষকে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান এবং পরে ইসরায়েল ও ইরান যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর ঘোষণা দেয়।

সংঘাতের পটভূমি

এই সাম্প্রতিক সংঘাত শুরু হয় ১৩ জুন, যখন ইসরাইল আকস্মিকভাবে ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায়। ইসরাইলের দাবি, ইরান খুব শিগগিরই পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে সক্ষম হবে, তাই এই হামলা। ইরান বলে, তাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ।

ইসরাইলের হামলার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় তেহরান শত শত রকেট ও ড্রোন ইসরাইল লক্ষ্য করে ছোঁড়ে। এই হামলা-পাল্টা-হামলা এখনো থেমে যায়নি, যদিও দুই দেশ আপাতত যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছেছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আসছেন। তবে মার্কিন ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের পূর্ববর্তী মূল্যায়নে বলা হয়েছিল, ইরান বোমা বানাচ্ছে না, যা ট্রাম্প এখন ‘ভুল’ বলে অভিহিত করছেন।

পরিস্থিতি কতটা স্থিত হবে, তা নির্ভর করছে ইরান তার পারমাণবিক কার্যক্রম কত দ্রুত পুনর্গঠনের পথে এগোয়, এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া কতটা কঠোর হয়, তার উপর।

সূত্র : বিবিসি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top