মুফতি আব্দুল কাদির মাসুম
তারাবীহতে দ্রুত তেলাওয়াত নিয়ে আমাদের সমাজে কত রকমের যে মাতামাতি ও প্রতিক্রিয়া রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। কেউ একে বেদআত বলছেন। কেউ জায়েয বলছেন। কেউ এমন নামাযকে মকরুহ বলছেন। এদিকে আবার ইমাম সাহেব তারতীলের সাথে তেলাওয়াত করলে পরের দিন থেকে মসজিদ মুসল্লী শূন্য। জামাতের জৌলুস হ্রাস পেয়ে যায়।
আমাদের যে কোন আমলের মানদণ্ড খাইরুল কুরুন তথা সাহাবী, তাবেয়ী ও তবে তাবেয়ীনের কথা ও কাজ। তাঁদের আমলের নিক্তিতে আমাদের যে আমল পড়বে তা-ই সঠিক আর যেটা পড়বে না সেটা পরিত্যাজ্য গণ্য হবে।
তারাবীহর কেরাতের বেলায় তাঁদের আমল কেমন ছিল? আমরা খোঁজতে গিয়ে এর উত্তর পাই ইমাম ইবনে আবি শাইবাহ ও ইমাম আব্দুর রাযযাকের কাছে।
মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাকে এসেছে-
عن ﺍﻟﺜَّﻮْﺭِﻱِّ ﻋَﻦِ ﺍﻟْﻘَﺎﺳِﻢِ ﻋَﻦْ ﺃَﺑِﻲ ﻋُﺜْﻤَﺎﻥَ ﻗَﺎﻝَ : ﺃَﻣَﺮَ ﻋُﻤَﺮُ ﺑِﺜَﻠَﺎﺛَﺔِ ﻗُﺮَّﺍﺀٍ ﻳَﻘْﺮَﺀُﻭﻥَ ﻓِﻲ ﺭَﻣَﻀَﺎﻥَ . ﻓَﺄَﻣَﺮَ ﺃَﺳْﺮَﻋَﻬُﻢْ ﺃَﻥْ ﻳَﻘْﺮَﺃَ ﺑِﺜَﻠَﺎﺛِﻴﻦَ ﺁﻳَﺔً ﻭَﺃَﻣَﺮَ ﺃَﻭْﺳَﻄَﻬُﻢْ ﺃَﻥْ ﻳَﻘْﺮَﺃَ ﺑِﺨَﻤْﺲٍ ﻭَﻋِﺸْﺮِﻳﻦَ ﻭَﺃَﻣَﺮَ ﺃَﺩْﻧَﺎﻫُﻢْ ﺃَﻥْ ﻳَﻘْﺮَﺃَ ﺑِﻌِﺸْﺮِﻳﻦَ .
অর্থাৎ হযরত আবু উসমান নাহদী রহ. বলেন, উমর রাযি. তারাবীহর ইমামতির জন্য তিনজন কারীকে নামায পড়াতে নির্দেশ দিলেন। তাঁদের মধ্যে দ্রুতগতিতে (হদরে) তেলাওয়াতকারীকে (প্রত্যেক রাকআতে) ত্রিশ আয়াত করে পড়ার, মাঝারি গতিতে (তাদবীরে) তেলাওয়াতকারীকে পঁচিশ আয়াত করে পড়ার এবং ধীরগতিতে (তারতীলে) তেলাওয়াতকারীকে বিশ আয়াত করে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। (দেখুন: মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক ৪/২৬১ হা. নং- ৭৭৩)
মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহতে এসেছে-
ﺣَﺪَّﺛَﻨَﺎ ﺣُﺴَﻴْﻦُ ﺑْﻦُ ﻋَﻠِﻲٍّ ﻋَﻦْ ﺯَﺍﺋِﺪٍ ﻋَﻦْ ﻫِﺸَﺎﻡٍ ﻋَﻦِ ﺍﻟْﺤَﺴَﻦِ ﻗَﺎﻝَ : ﻣَﻦْ ﺃَﻡَّ ﺍﻟﻨَّﺎﺱَ ﻓِﻲ ﺭَﻣَﻀَﺎﻥَ ﻓَﻠْﻴَﺄْﺧُﺬْ ﺑِﻬِﻢُ ﺍﻟْﻴُﺴْﺮَ ﻓَﺈِﻥْ ﻛَﺎﻥَ ﺑَﻄِﻲﺀَ ﺍﻟْﻘِﺮَﺍﺀَﺓِ ﻓَﻠْﻴَﺨْﺘِﻢِ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥَ ﺧَﺘْﻤَﺔً ﻭَﺇِﻥْ ﻛَﺎﻥَ ﻗِﺮَﺍﺀَﺗُﻪُ ﺑَﻴْﻦَ ﺫَﻟِﻚَ ﻓَﺨَﺘْﻤَﺔٌ ﻭَﻧِﺼْﻒٌ ﻓَﺈِﻥْ ﻛَﺎﻥَ ﺳَﺮِﻳﻊَ ﺍﻟْﻘِﺮَﺍﺀَﺓِ ﻓَﻤَﺮَّﺗَﻴْﻦِ .
অর্থাৎ বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত হাসান বসরী রহ. বলেন, যে ব্যক্তি রমযানে লোকদের নিয়ে ইমামতি করে সে যেন তাদের জন্য সহজতা অবলম্বন করে। সে যদি ধীরগতিতে তেলাওয়াতকারী হয় তাহলে যেন সমগ্র রমযানে এক খতম করে। যদি মাঝারি গতির তেলাওয়াতকারী হয় তাহলে দেড় খতম করে। আর যদি দ্রুতগতিতে তেলাওয়াতকারী হয় দুই খতম করে। (দেখুন: মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবাহ ২/১৬৩ হা. নং- ৭৬৭৯)
এই দুই বর্ণনা থেকে বুঝা যাচ্ছে, সালাফের যুগে তারাবীহতে আস্তে ও দ্রুত উভয় ধরণের তেলাওয়াতের প্রচলন ছিল। সুতরাং তারাবীহতে দ্রুত তেলাওয়াত মারাত্মক দোষের কিছু নয়। আস্তে তেলাওয়াতের মতো দ্রুতও একটি সুন্নাহ। কোন পদ্ধতিই আপত্তিকর নয়। তবে উত্তম হচ্ছে ধীরে ধীরে পড়া।
কিন্তু ফাইভ জি গতিতে তেলাওয়াত (যা আমাদের দেশের অনেক জায়গায় চলে) যে হরফ মাখরাজ মদ সঠিকভাবে আদায় হয় না। তা অবশ্যই বর্জনীয়। এর অনুমোদন শরীয়তে নেই। ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহ. লিখেন-
قَوْلُهُ (وَمَا يُكْرَهُ أَنْ يُهَذَّ كَهَذِّ الشِّعْرِ) كَأَنَّهُ يُشِيرُ إِلَى أَنَّ اسْتِحْبَابَ التَّرْتِيلِ لَا يَسْتَلْزِمُ كَرَاهَةَ الْإِسْرَاعِ وَإِنَّمَا الَّذِي يُكْرَهُ الْهَذُّ وَهُوَ الْإِسْرَاعُ الْمُفْرِطُ بِحَيْثُ يَخْفَى كَثِيرٌ مِنَ الْحُرُوفِ أَوْ لَا تَخْرُجُ مِنْ مخارجها وَقد ذكر فِي الْبَاب إِنْكَار بن مَسْعُودٍ عَلَى مَنْ يَهُذُّ الْقِرَاءَةَ كَهَذِّ الشِّعْرِ وَدَلِيلُ جَوَازِ الْإِسْرَاعِ مَا تَقَدَّمَ فِي أَحَادِيثِ الْأَنْبِيَاءِ مِنْ حَدِيثِ أَبِي هُرَيْرَةَ رَفَعَهُ خُفِّفَ عَلَى دَاوُدَ الْقُرْآنُ فَكَانَ يَأْمُرُ بِدَوَابِّهِ فَتُسْرَجُ فَيَفْرُغُ مِنَ الْقُرْآنِ قَبْلَ أَنْتُسْرَجَ
অর্থাৎ ইমাম বুখারীর এ ভাষ্য থেকে বুঝা যায়, তারতীলে তেলাওয়াত যদিও মুস্তাহাব, কিন্তু দ্রুত তেলাওয়াতও অপছন্দনীয় নয়। এর দলিল হল, হযরত আবু হুরায়রা রাযি.-এর বর্ণনা যে, হযরত দাঊদ আ.-এর জন্য তেলাওয়াতকে সহজ করে দেয়া হয়েছিল (অর্থাৎ খুব দ্রুত পড়তে পারতেন।)। তিনি তাঁর বাহনসমূহতে গদি বসাতে নির্দেশ করে খাদেমরা গদি বসানোর আগেই এক খতম করে ফেলতেন। তবে এমন ফাহেশ তেলাওয়াত যে অনেক হরফের উচ্চারণ অস্পষ্ট থেকে যায় এবং মাখরাজ থেকেও বের হয় না তা অবশ্যই বিবর্জিত। ইবনে মাসউদ রাযি. এমন তেলাওয়াতের ওপর প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। (ফাতহুল বারী ২/৮৯, দারুল মারিফা বৈরুত)
ফাতাওয়ায়ে দারুল উলূম দেওবন্দে এসেছে, তারাবীহতে এত দ্রুত তেলাওয়াত যে বুঝে আসে না, এরূপ তেলাওয়াতে সওয়াবের পরিবর্তে গোনাহ হবে। (দেখুন: ফাতাওয়া দারুল উলূম দেওবন্দ ৪/২৫৭)
লেখকের ফেসবুক থেকে