টুডেনিউজ বিডি ডটনেট
তালেবান এখন আর কেবল একটি পর্বতের বিদ্রোহী গোষ্ঠী নয়; তারা একটি রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। তারা এর বৈধতা চাইছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও তারা স্বীকৃতির আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছে। এই ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় তালেবানের সাথে যুক্ত হলে ভারত ও আমেরিকা উভয়ের জন্যই এক নতুন কৌশলগত দিগন্ত উন্মোচিত হতে পারে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই দুই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য প্রশ্নটা তাই ‘তালেবানকে স্বীকৃতি দেয়া উচিত কিনা’ নয়। বরং ‘তালেবানকে একঘরে রাখলে কাদের হাতে আফগানিস্তানের চাবিকাঠি তুলে দেয়া হবে’—এই তাৎপর্যময় প্রশ্নটি। আফগানিস্তানে ভবিষ্যৎ প্রভাব রক্ষায় কৌশলগত সম্পর্ক এখন সময়ের দাবি।
তিন সেক্টরে পূর্ণ শরিয়াহ আইন বাস্তবায়নের নির্দেশ তালেবান প্রধানের
সন্ত্রাসবাদ দমন ও কৌশলগত ভারসাম্যের প্রয়োজনে সম্পৃক্ততা
তালেবান ২০০১ সালের ৯/১১ হামলার পর থেকেই মার্কিন রাজনৈতিক স্মৃতিতে এক নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। ওসামা বিন লাদেন ও আল-কায়েদার আশ্রয়দাতা হিসেবে তালেবান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এক ঘৃণিত প্রতীকে পরিণত হয়েছিল। দীর্ঘ ১৮ বছরের যুদ্ধ, প্রায় ২,৫০০ মার্কিন সেনার মৃত্যু এবং হাজার হাজার আহত সৈন্যের স্মৃতি আজো কুয়াশার মতো ছায়া ফেলে। তবুও ২০২১ সালে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তৈরি হওয়া শূন্যতা এক নতুন নিরাপত্তা হুমকির জন্ম দিয়েছে আইসিস-কে-এর মতো চরমপন্থী গোষ্ঠীর মাধ্যমে।
স্কুল শিক্ষার্থীদের নতুন পোশাক নির্ধারণ করল তালেবান
আইসিস-খোরাসান প্রদেশ (IS-K) এখন কেবল তালেবানের জন্য নয়, বরং আমেরিকাসহ পশ্চিমা স্বার্থের জন্যও এক বড় চ্যালেঞ্জ। ২০২১ সালের আগস্টে কাবুল বিমানবন্দরের প্রাণঘাতী হামলা তারই প্রমাণ। যদিও আদর্শিকভাবে ভিন্ন, তালেবান নিজস্ব ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে আইসিস-কে-এর বিস্তার ঠেকাতে আগ্রহী। ফলে সন্ত্রাসবাদ দমন এবং দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে তালেবান হয়ে উঠতে পারে এক পরোক্ষ কৌশলগত অংশীদার।
চীন ইতোমধ্যে তালেবানের সাথে ৫৪০ মিলিয়ন ডলারের তেল উত্তোলন চুক্তিসহ বিনিয়োগ ও নিরাপত্তা সহযোগিতা শুরু করেছে। রাশিয়া তালেবান প্রতিনিধিদের মস্কোতে স্বাগত জানিয়ে কূটনৈতিক যোগাযোগ জোরদার করছে। এমনকি ঐতিহাসিক শত্রু ইরানও জ্বালানি বাণিজ্যে তালেবানের সাথে সম্পর্ক গভীর করছে। এই প্রেক্ষাপটে আফগানিস্তানে কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রাখতে আমেরিকার কাছে তালেবানের সাথে সীমিত সম্পৃক্ততা একটি প্রয়োজন।
মার্কিন নিরাপত্তা হুমকির তালিকা থেকে বাদ দেয়া হলো আফগানিস্তানের নাম
নয়াদিল্লির কৌশল : তালেবান-পাকিস্তান বিভেদের সুযোগ গ্রহণ
তালেবানের পুনরুত্থান প্রথমে ভারতের জন্য এক চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখা দিয়েছিল। ১৯৯৯ সালের আইসি-৮১৪ হাইজ্যাক, ২০০৮ সালের কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসে হামলা—সবকিছুই তালেবান ও তাদের সহযোগীদের সাথে ভারতের সম্পর্ককে আরো জটিল করে তোলে। তবুও বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় ইসলামাবাদ ও তালেবানের মধ্যে দৃশ্যমান ফাটল নয়াদিল্লির জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে।
তালেবান এখন ডুরান্ড লাইনকে সীমান্ত হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করছে এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরে সাম্প্রতিক বিমান হামলা তালেবান নেতৃত্বে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে। এই উত্তেজনা ভারতকে আফগানিস্তানে কৌশলগত প্রভাব পুনর্নির্মাণের এক দুর্লভ সুযোগ দিচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের প্রভাব প্রতিহত করতেই ভারত তালেবানের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
তালেবান নেতা হাক্কানির জন্য ১০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার প্রত্যাহার করল আমেরিকা
তালেবানের সাথে মৃদু, কিন্তু স্থায়ী সংলাপ নয়াদিল্লিকে এমন এক অবস্থানে আনতে পারে, যেখানে কাশ্মীর ও ভারতের অভ্যন্তরে উগ্রবাদী কার্যক্রমে তালেবানের মদত ঠেকানো সম্ভব হতে পারে।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সাথে আফগানিস্তানের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মওলাভি আমির খান মুত্তাকির ২০২৫ সালের জানুয়ারির বৈঠক সেই দিকেই এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। ২০২৪ সালেই ভারতের একটি প্রতিনিধিদল আফগানিস্তানে গিয়ে অবকাঠামো ও বাণিজ্যিক ইস্যুতে আলোচনা করেছে। ভারতের জন্য এটি কেবল নিরাপত্তার বিষয় নয়, অর্থনৈতিক এবং আঞ্চলিক সংযোগের প্রশ্নও বটে। আফগানিস্তানের সঙ্গে চাবাহার বন্দর হয়ে সংযোগ স্থাপন ভারতকে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার মধ্যে এক কৌশলগত সুবিধা দেবে। একইসাথে এটি চীনের বিআরআই প্রকল্পে একচ্ছত্র দখলের পাল্টা ভারসাম্য হিসেবেও কাজ করবে।
আফগানিস্তানে পশ্চিমা আইন প্রয়োজন নেই : তালেবান প্রধান
বাস্তববাদ বনাম নৈতিকতা
তালেবান এখনো একটি কর্তৃত্ববাদী শাসকগোষ্ঠী। তবুও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তবতায় ‘নৈতিক পবিত্রতা’ কদাচিৎ কার্যকর হয়। বাস্তববাদী কৌশলগত সম্পর্ক রক্ষা করেই জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করা সম্ভব। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তালেবানের সাথে সীমিত যোগাযোগ সন্ত্রাসবাদ দমনে এক কৌশলগত প্রয়োজনে পরিণত হয়েছে। ভারতের জন্য এটি পাকিস্তানের প্রভাব কমানো এবং চীনের একচ্ছত্র দখল ঠেকাতে একটি কার্যকর হাতিয়ার। এই পুনঃসম্পৃক্তি তালেবানের অতীতকে মুছে দেয় না, বরং বর্তমানকে চিনে বাস্তব সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রেক্ষিত তৈরি করে।
সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
তালেবানের সাথে টেকসই সম্পর্ক স্থাপনের আহ্বান ওআইসির