দায়িত্বশীল নির্বাচনে ইসলামের নির্দেশনা

শায়খ ইবনুল কালাম

যেকোনো দায়িত্বকে ইসলাম আমানত জ্ঞান করে। সেটি পালনের জন্য সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করে। কোনো ধরনের ত্রুটি বিচ্যুতি হলে আল্লাহর জবাবদিহিতার বিষয় সামনে নিয়ে আসে। সেজন্য দায়িত্বশীল নিয়োগে যোগ্য ব্যক্তি বাছাই করার প্রতি ইসলাম সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। এ বিষয়ে বিশিষ্ট সাহাবী আবু জর রা. এর একটি ঘটনা প্রাসঙ্গিক। একবার তিনি নবীজি সা.কে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি কি আমাকে আমেল (প্রশাসক) হিসেবে নিয়োগ দেবেন ন? তখন নবীজি সা. বললেন, আবু জর, তুমি হলে দুর্বল। এই পদ আমানতস্বরূপ। (দুর্বলরা তা সামাল দিতে পারবে না। কেউ যদি দায়িত্ব যথাযথভাবে আঞ্জাম দিতে না পারে তাহলে) কিয়ামতের দিন এটি লজ্জা ও লাঞ্ছনার কারণ হবে। রাসূল সা. আরো বলেন, হ্যাঁ, যে ওই দায়িত্ব ভালোভাবে গ্রহণ করবে এবং অর্পিত দায়িত্বের হক যথাযথভাবে আদায় করবে সে বেঁচে যাবে। সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৮২৫

মৌলিকভাবে তিনটি শর্ত পাওয়া গেলে কোনো ব্যক্তিকে দায়িত্বের জন্য বিবেচনা করা যেতে পারে। শর্তগুলো হলো, ব্যক্তির মাঝে আদালত বা ন্যায়পরায়ণতা থাকা। তিনি গভীর জ্ঞানের অধিকারী হওয়া। অর্থাৎ তার মধ্যে এমন চিন্তা ও প্রাজ্ঞতা থাকা, যার মাধ্যমে তিনি যথাযথভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারবেন এবং সময়ের যথাযথ পদক্ষেপটি গ্রহণ করতে পারবেন। এছাড়া তার কাছে যেকোনো স্বার্থের আগে নাগরিকদের স্বার্থ প্রাধান্য পেতে হবে। এই তিনটি বিষয় কোনো ব্যক্তির মাঝে পাওয়া গেলে তাকে দায়িত্বশীল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

দায়িত্বশীলকে অবশ্যই ন্যায়পরায়ন ও নেককার হতে হবে। ইসলামের দৃষ্টিতে ন্যায়পরায়নতার মানদণ্ড হলো, শরীয়ত মেনে বিচারকার্য পরিচালনা করা। অর্থাৎ দায়িত্বশীলকে শরীয়তের বিষয়ে প্রাজ্ঞ হতে হবে। এবং তার শাসনকার্য কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী পরিচালনা করতে হবে। যে কুরআন-সুন্নাহ অনুযায়ী তার শাসন কার্য পরিচালনা করলো না, সে ন্যায়ের পথে রইলো না।

দায়িত্বশীলকে গভীর জ্ঞানের অধিকারী হতে হবে মানে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের গভীর জ্ঞান তার মাঝে থাকতে হবে। যেমন যারা শাসক বা মন্ত্রিসভার লোক হবেন তাদেরকে জ্ঞান রাখতে হবে রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন সম্পর্কে, চুক্তি ও সন্ধি সম্পর্কে, পার্শ্ববর্তী দেশ ও জাতি সম্পর্কে, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক সম্পর্কে। অর্থাৎ তাদের রাজনৈতিক শক্তি সম্পর্কে যথাযথ ধারণা রাখা, তাদের থেকে কী আশা করা যায়, তাদের পক্ষ থেকে কোন ধরনের আশঙ্কা আছে, তাদের আধিপত্য ও হস্তক্ষেপ রোধ করার জন্য এবং তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, সে সম্পর্কে জ্ঞান রাখতে হবে। এসব বিষয়ের জ্ঞান এককভাবে সবার মধ্যে থাকা জরুরি নয়। বরং মন্ত্রিসভার সম্মিলিতভাবে যদি এমন গভীর জ্ঞান থাকে, তাহলেও যথেষ্ট। হজরত উমর রা. এর এই কর্মপদ্ধতি ছিল। তিনি প্রশাসক নির্বাচনের ক্ষেত্রে কেবলই দ্বীনদারি দেখতেন না। পাশাপাশি রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও বিবেচনায় নিতেন। অবশ্য দ্বীনদারিতায় ঘাটতি থাকলে তাকে কোনো সুযোগ দিতেন না।

সুতরাং এই বৈশিষ্ট্যগুলো যার মাঝে থাকবে, সে শাসন বা প্রশাসনে যাওয়ার যোগ্য। যার মাঝে এই বৈশিষ্ট্যগুলো থাকবে না, তার প্রসাশনে যুক্ত হওয়া উচিৎ নয়। বরং এক্ষেত্রে তার থেকে ত্রুটি-বিচ্যুতি হওয়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে। আর কারো থেকে যদি ত্রুটি-বিচ্যুতি প্রকাশ পায়, তাহলে যেমনটি আগে বলা হয়েছে, এ কারণে সে পরকালে বড় ধরনের লাঞ্ছনার শিকার হতে হবে।

অযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দেয়ার পরিণাম কত ভয়াবহ হতে পারে তা একটি হাদিস থেকে অনুমান করা যায়। বিশিষ্ট সাহাবী আবু হুরায়রা রা. বলেন, ‘একবার রাসুলুল্লাহ সা. মজলিসে আলোচনা করছিলেন। এ সময় এক বেদুঈন সাহাবী এসে জিজ্ঞাসা করলেন, কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে? আল্লাহর রাসূল সা. তার প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না। বরং নিজ আলোচনায়ই রত থাকলেন। এতে কেউ কেউ ধারণা করলেন যে লোকটির প্রশ্ন নবীজি সা. শুনেছেন। কিন্তু তার কথা পছন্দ করেননি। আবার কেউ কেউ বললেন, বরং তিনি শুনতেই পাননি। পরে রাসূল সা. আলোচনা শেষে বললেন, কিয়ামত সম্পর্কে প্রশ্নকারী লোকটি কোথায়? তিনি বললেন, এই যে আমি, হে আল্লাহর রাসুল! তখন মহানবী সা. বললেন, যখন কোনো অযোগ্য ব্যক্তির ওপর কোনো কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়, তখন তুমি কিয়ামতের অপেক্ষা করবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৯)

হাদিসবিশারদগণ বলেন, উল্লিখিত হাদিস দ্বারা অযোগ্য ব্যক্তির নিয়োগদানের ভয়াবহ পরিণতির দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। কেননা অযোগ্য ব্যক্তি নিয়োগ পেলে সে আমানতের খিয়ানত করবে। দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ার কারণে সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। একইসাথে যোগ্য ব্যক্তি উপযুক্ত সম্মান ও দায়িত্ব লাভ থেকেও বঞ্চিত হবে।

সেজন্য দায়িত্বশীল নিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই আমানতদারিতার পরিচয় দিতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে অযোগ্য শাসকদের হাত থেকে রক্ষা করেন। আমিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top