দারিদ্র্য, ইসলাম,

দারিদ্র্য বিমোচন : পশ্চিমা নীতি বনাম বাস্তবতা

নূরে জাহান মুনিয়া

পৃথিবীতে মানব সভ্যতার সাথে সাথে অস্তিত্বে থাকা সমস্যাগুলোর মধ্যে দারিদ্র্য একটা। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও হিউম্যানিটেরিয়ান সংগঠনগুলো বিশ্বমানবতাকে দারিদ্র‍্যমুক্ত করার লক্ষ্যে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে আসছে। জাতিসংঘ দারিদ্র‍্যকে অর্ধেক নামিয়ে আনার লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি চালিয়ে আসছে। কিন্তু বাস্তবে দারিদ্র্য নিরসন সম্ভব হচ্ছে না। ডিকেড আফটার ডিকেড বিশ্বে দারিদ্র্য বাড়ছে বৈ কমছে না।

‎এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ইতিহাস আমাদের সাক্ষ্য দেয়, মুসলিম খলিফা ও শাসকেরা তাদের প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও রাষ্ট্র দারিদ্র‍্যমুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইতিহাসে যখনই কোনো সাম্রাজ্য পূর্ণরূপে যাকাত আদায় করেছে সেখানেই দারিদ্রের হার নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়।

‎সাহাবী ও খলিফা উমর রা.-এর সময় ইয়েমেনের গভর্নর মুয়ায ইবন জাবাল রা. ইয়েমেনের এক-তৃতীয়াংশ যাকাত কেন্দ্রে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। খলিফা উমর রা. জানতে চাইলেন- ‘তোমাকে কি ট্যাক্স উসুল করতে পাঠিয়েছি? ধনীদের থেকে নিয়ে ওখানেই গরীবদের দিয়ে দাও।’ গভর্নর জানালেন- যাকাত নেয়ার কেউ নেই। এরপরের বছর অর্থাৎ দ্বিতীয় বছর যাকাতের অর্ধেক পাঠালেন এবং তার পরের বছর যাকাতের পুরোটাই পাঠিয়ে দিলেন কেন্দ্রে! কারণ পুরো যাকাত নেয়ারই আর কেউ নেই ইয়েমেনে।

‎খুলাফা রাশিদা পরবর্তী সময়েও এমন উদাহরণ পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ খলিফা উমর ইবনুল আবদুল আজীয রহিমাহুল্লাহ-এর সময়কাল।

‎এমনকি সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হচ্ছে, অটোমান সাম্রাজ্যের সপ্তম খলিফা মুহাম্মদ আল ফাতিহ রহিমাহুল্লাহ এর সময়ে। সময়টা নতুন বিশ্বব্যবস্থা থেকে খুব বেশি দূরে না। ওই সময়ে একজন মুসলিম যাকাতের টাকা দেয়ার মতো কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলো না। নিরুপায় হয়ে টাকা একটা থলিতে করে চৌরাস্তার মোড়ে ঝুলিয়ে লিখে দিয়েছিলো, “ভাই, অনেক খুঁজেও আমি কোনো ফকির পাইনি। তুমি যদি অভাবী হও নির্দ্বিধায় এটা নিয়ে যাও।” জানা যায়, প্রায় তিনমাস ঝুলে ছিলো থলিটা।

‎যাকাত কার্যকরী ভাবে আদায় শুরুর পর ডিকেড আফটার ডিকেড অপেক্ষা করতে হয়নি। এখন যাকাত কার্যকরী ভাবে আদায় হয় না, উপরন্তু যাকাত আদায়কারী কমই, কাপড় বিতরণ করে যাকাত দিয়েছি বলা মানুষ অহরহ। তেমনিভাবে সম্পত্তির উত্তরাধিকারের নির্ধারিত যেই অংশ আল্লাহ নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা-ও যথাযথভাবে বন্টিত হয় না। নারীকে তার অংশ বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছেনা।

‎সেটা কেন?

‎কারণ অথরিটি নেই। যাকাত গ্রহণ ও বন্টনের জন্য রাষ্ট্রের ইসলামি অথরিটি লাগে। সামর্থ্যবান যাকাত প্রদান না করলে দন্ডিত হবে। তারপর কার্যকরী বন্টনের রূপরেখাও ইসলামি সমাজব্যবস্থার আছে। যাকাত সংগ্রহ করে রাষ্ট্রই নিজ দায়িত্বে প্রাপ্যদের তা বুঝিয়ে দেয়।

‎প্রচলিত আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে নারীদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা সহজ। ঠকানো সহজ। আর ইসলামি আইন নারীদের জন্য নির্ধারিত অংশ নিশ্চিত করে পাই টু পাই। না করলে দন্ড নিশ্চিত। জনসম্মুখে।

‎সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর করতে গরীবের মাথায় করের বোঝা চাপানোর প্রয়োজন নেই, না আছে বোগাস এবসলিউট সমতার। ইসলামি যাকাতব্যববস্থা এবং সুষম বন্টন দিয়ে সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করা সম্ভব। আর এটার বাস্তব নমুনার ইতিহাস আমাদের আছে।

‎অন্যদিকে ফ্রেঞ্চ রেভল্যুশন থেকে এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক স্ট্যাবিলিটি, দারিদ্র্য নিরসনের যুতসই একটা প্রমাণ মিলবে? প্লিজ?

‎কুরবানীতে বিভিন্ন দিক থেকে দরিদ্রদের সাথে হাতে হাতে বিনিময় হয়। পশু ক্রয় থেকে চামড়া বিপনন হাজার কোটি টাকার লেনদেন, পুরোটাই হয় দরিদ্রদের সাথে। মাঝে কোনো ব্যাংকের লেনদেন নেই। পুরো টাকা কুরবানীকে কেন্দ্র করে যুক্ত হয় অর্থনীতিতে। গোটা বছর গোশতের মুখ না দেখা মানুষ কুরবানী আসলে গরুর গোশত খেতে পায়। এমনকি কৃষক থেকে সরকার নিয়ে চাল ডাল বিক্রি করে তখনও কৃষকের মুনাফা নিশ্চিত হয় না। ক্ষেত্রবিশেষে শুধু শ্রমের রূপান্তর হয়।

‎সুদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় দরিদ্রদের সম্পদ ক্রমে বিত্তবানদের হাতে যায়। সম্পদের এককেন্দ্রীকরণ হয়। সম্পদ নিচ থেকে উপরে উঠে কিন্তু নিচে নামার পথ রুদ্ধ করে। ইসলামি অর্থনীতি ও সুষম বন্টনব্যবস্থাকে উপড়ে ফেলে সুদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দাঁড়াতে চায়। আর ইসলাম চায় সুদকে নির্মূল করতে।

‎নোবেল প্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদের অর্থনৈতিক মডেলটা প্রাতিষ্ঠানিক মুনাফা সর্বোচ্চকরণে কাজে লাগলেও দারিদ্র্য নিরসনে কিনারা করতে পারছে না। গ্রামীণ ব্যাংকের কেলেঙ্কারি দু’দিন আগে আমরা দেখেছি। দেশের কর সংক্রান্ত নতুন সংস্কার পর্যবেক্ষণ করলেই যথেষ্ট।

‎দেখবেন একটা কাপড় কিনতে গেলেও আপনার ট্যাক্স ৭.৫% থেকে বেড়ে ১৫% হয়েছে। ১০০ টাকা মোবাইল রিচার্জে আপনার জন্য থাকবে প্রায় ৪৩ টাকা। কিন্তু আন্তর্জাতিক কিছু পুরষ্কার যেমন নোবেল, পুলিৎজার ইত্যাদির উপর কোনো ট্যাক্স থাকবে না। পরোক্ষ কর বাড়ানো হয়েছে, যাতে দরিদ্রের ব্যয় বাড়ে। সম্পদ কর, উচ্চ আয় ও বিলাসী দ্রব্যের উপর প্রত্যক্ষ কর বাড়েনি। ফলাফল, করব্যবস্থা বেশি পরোক্ষ হওয়ায় ধনীরা সারপাস করে, গরীবরা বেশি বোঝা বহন করে। আসলে ধনীরা কর ঠিকমতো আদায়ই তো করে না। তাদের রাষ্ট্রের শাস্তির আওতায় আনা যায় না। রাষ্ট্রীয় আইনের ফাঁকফোকর এটা। এমনকি বিদেশ থেকে আমদানি হওয়া বিলাসী পণ্যসমূহেরও ট্যাক্সের বোঝা পড়ে মুটে মজুর, চা শ্রমিকের মাথায়, ঐসব পণ্য যারা জীবনে ছুঁতেও পারবে না।

‎ইসলাম শুধু কুরবানীতে দরিদ্রের মুখে গোশত দিয়েই ক্ষান্ত হতে চায় না। যাকাত, খারাজ, উশর, ফিদইয়া, সদকাতুল ফিতর, কুরবানী, করযে হাসানা, সুষম বন্টন- এসবই ইসলামের আইনে অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্রে ইসলামের আইন বাস্তবায়িত হলে, সবার উপর মহান আল্লাহর অথরিটি নিশ্চিত হলে আইনের কার্যকরী প্রয়োগ হয়। এর সুফলই আমাদের সোনালী অতীত এবং ভবিষ্যৎ ইন শা আল্লাহ। কেউ দারিদ্র্য ও বঞ্চিত সমস্যার সমাধান চায় কিন্তু সুদী অর্থব্যবস্থার কলাপস চায় না; অথবা যাকাত-ইসলামি বন্টনের প্রভাব দেখতে চায় কিন্তু ইসলামি শরীয়াহ চায় না; বিষয়টা < ফল চাই, গাছ চাই না > ছাড়া কিছু না।

নারী কথন থেকে গৃহীত

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top