ধর্মীয় বিষয়ে স্কলারদের মাঝে মতভিন্নতা কেন

শায়খ ইবনুল কালাম

ধর্মীয় বিভিন্ন বিষয়ে ইসলামিক স্কলারদের মাঝে মতভিন্নতা দেখা যায়। এর থেকে মানুষের মাঝে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, তাকে দু’ভাগে ভাগ যায়। কিছু মানুষ এর থেকে ধরে নেন যে ধর্মীয় বিষয়ে যেকোনো মতভিন্নতা থাকতে পারে। সেটি জরুরিয়াত, কতইয়্যাত, ইজমাইয়্যাতে হোক কিংবা ফিকহি শাখাগত বিষয়েই হোক। আবার কিছু মানুষ বিরক্ত হন যে আল্লাহ এক, রাসূল এক, কিতাব এক, তবে এতো মতোবিরোধ কেন? এই দুই শ্রেণির মানুষই প্রান্তিকতার শিকার। আর এর পেছনে কাজ করছে ইখতেলাফের ভিন্নতা, উৎস ও কারণ না জানা। বস্তুত সব ইখতেলাফ নিন্দনীয় নয়। কিছু ইখতিলাফ নন্দিত। আর কিছু ইখতেলাফ নিন্দিত। উভয় শ্রেণির আলোচনা কুরআন-সুন্নাহেই বিদ্যমান রয়েছে।

ইখতেলাফের প্রকারভেদ

মূলত ইখতেলাফ দুই প্রকার- নন্দিত ইখতেলাফ ও নিন্দিত ইখতেলাফ। একে আরবিতে বলা হয় اختلاف ممدوح واختلاف مذموم। তো কোন ইখতেলাফ নন্দিত আর কোন ইখতিলাফ নিন্দিত সংক্ষেপে তা জানা যাক।

নিন্দিত ইখতেলাফ : জরুরিয়াতে দ্বীন (স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত বিষয়াদি), কতইয়্যাতে দ্বীন (অকাট্য বিষয়াদি) ও ইজমাইয়্যাতে দ্বীনের (ঐকমত্যপূর্ণ বিষয়াদি) নিয়ে যে ইখতেলাফ করা হবে, সেটি হলো নিন্দিত ইখতেলাফ। এমনিভাবে যার কুরআন-সুন্নাহ ও তৎসংশ্লিষ্ট শাস্ত্রসমূতে পাণ্ডিত্য নেই, তার ইখতেলাফও নিন্দিত ইখতেলাফের পর্যায়ভুক্ত।

নন্দিত ইখতেলাফ : জরুরিয়াতে দ্বীন (স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত বিষয়াদি), কতইয়্যাতে দ্বীন (অকাট্য বিষয়াদি) ও ইজমাইয়্যাতে দ্বীনের (ঐকমত্যপূর্ণ বিষয়াদি) ইত্যাদির বাইরে শাখাগত যেসব বিষয়ে ইখতেলাফ হয়, সেগুলো হলো নন্দিত ইখতেলাফ।

নন্দিত ইখতেলাফ কেন হয়

যদি কোনো বিষয়ে কুরআনের, সুন্নাহের কিংবা ইজমার সুস্পষ্ট বক্তব্য না থাকে, তাহলে ওই বিষয়ে মুজতাহিদকে ইজতেহাদ করতে হয়। তিনি তার আল্লাহ প্রদত্ত মেধা ও সংশ্লিষ্ট শাস্ত্রের সমঝ এবং শাস্ত্রীয় নীতিমালা অনুসরণ করে ইজতেহাদ করেন। আর স্বভাবই সবার সমঝের প্রতিফলন এক হওয়া জরুরি নয়। সেজন্য মুজতাহিদদের মাঝে মত-পার্থক্য হয়েছে।

ইখতেলাফের আরেকটি কারণ হলো, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরবি ভাষার দিক থেকে কুরআন বা সুন্নাহকে একাধিকভাবে ব্যাখ্যার সুযোগ থাকে। তখন সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে একেক মুজতাহিদ একেক ব্যাখ্যাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এ কারণেও ইখতেলাফ হয়ে থাকে।

ইখতেলাফ কখন হয়

ইখতেলাফ সাধারণত হাওয়াদিস ও নাওয়াযিলের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। আর নাওয়াযিলের ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরাম তাদের পূর্ববর্তীদের থেকে কোনো নস পান না। সেজন্য তাদেরকে ইজতেহাদ করতে হয়। আর শাস্ত্রীয় নীতিমালা অনুসরণ করা হলেও যেহেতু সবার বুদ্ধির প্রতিফলন এক হয় না, সেজন্য ইখতেলাফের সূত্রপাত ঘটে।

ইখতেলাফ কখন থেকে শুরু হয়

রাসূল সা. এর যুগ থেকেই নন্দিত ইখতেলাফের সূচনা হয়েছে। এ বিষয়ে একটি ঘটনা প্রসিদ্ধ রয়েছে। আল্লাহর রাসূল সা. সাহাবায়ে কেরামকে বনু কুরায়যায় যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়ে বললেন, لا يصلين أحد العصر إلا في بني قريظة অর্থাৎ ‘তোমাদের কেউ যেন বনু কুরায়যায় না পৌঁছে আসর না পড়ে।’ রাসূল সা. এর এই নির্দেশ শুনে সাহাবায়ে কেরাম বনু কুরায়যার উদ্দেশে রওনা হলেন। পথিমধ্যে আসরের সময় অতিক্রান্ত হওয়ার উপক্রম হলো। তখন সাহাবায়ে কেরামের মাঝে মতভিন্নতা দেখা দিলো। কেউ বললেন, রাসূল সা. বলেছেন, বনু কুরায়যায় গিয়ে আসর পড়তে। সেজন্য আসরের সময় থাকুক আর না থাকুক, আমরা বনু কুরায়যায় গিয়েই আসরের নামাজ পড়ব। আর কিছু সাহাবায়ে কেরাম বললেন, রাসূল সা. এর এই কথার উদ্দেশ্য হলো, যেন বনু কুরায়যায় রওনা হতে দেরী না করা হয়। নামাজ বিলম্বিত করে পড়া নবীজির উদ্দেশ্য নয়। তারা পথিমধ্যেই নামাজ পড়ে নিলেন। পরে ঘটনাটি রাসূল সা.কে বলা হলে তিনি কোনো পক্ষকেই ভর্ৎসনা করেননি। বরং উভয়ের অবস্থানকেই মৌন সমর্থন দিয়েছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর : ৪১১৯)

এ ঘটনা থেকে বুঝা যায়, শাখাগত বিষয়ে ইখতেলাফ হতে পারে। এর প্রতি নবীজি সা. এর মৌন সমর্থনও রয়েছে। এখান থেকে আরেকটি বিষয় বুঝা যায়, যেখানে কুরআন বা সুন্নাহের বক্তব্যকে একাধিকভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ আছে, সেখানে যেকোনো এক ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করার অনুমতি আছে।

রাসূল সা. এর ইন্তেকালের পর নতুন যেসব বিষয় সামনে এসেছে, সেসব নিয়েও ফুকাহায়ে কেরাম এভাবে ইজতেহাদ করেছেন। এভাবে ফুকাহায়ে কেরামের যুগে যেসব বিষয় নতুন উদ্ভাবিত হয়েছে, তারা সেসব নিয়ে ইজতেহাদ করেছেন। মোটকথা, প্রত্যেক যমানার ফকিহগণ তাদের সমসাময়িক নাওয়াযিল নিয়ে ইজতেহাদ করেছেন। এক্ষেত্রে তারা যথাযথ রীতি অনুসরণ করেই ইজতেহাদ করেছেন। কিন্তু বুদ্ধির প্রতিফলন এক না হওয়ায় একাধিক মতামত দেখা গিয়েছে।

নন্দিত ইখতেলাফের ফায়দা কী

নন্দিত ইখতেলাফের নানাবিধ উপকারিতা রয়েছে। নিম্নে কিছু আলোচনা করা হলো,

-ইফতেলাফের একটি ফায়দা হলো, এর দ্বারা আমলের ক্ষেত্রে প্রশস্ততা তৈরি হয়। একটি ইবাদতের একাধিক পন্থা আবিষ্কৃত হয়। তখন যার জন্য যেই পথটি সহজ হয়, তিনি ওই পথ অনুযায়ী আমল করবেন। তবে অন্যমত গ্রহণের জন্য অবশ্যই যোগ্য হতে হবে। আর ভিন্নমত গ্রহণের ইতিহাসও কম নয়।

-দ্বিতীয় ফায়দা হলো, একাধিক পথের উভয়টির পক্ষে যেহেতু দলীল রয়েছে, তাই যে পথ অনুযায়ীই আমল করুক না কেন, মনে সংকীর্ণতা থাকবে না যে আমি যে পথ ধরে চলছি তা ঠিক কিনা। বরং প্রশান্ত চিত্তে আমল করতে পারবে। কারণ, তার পক্ষে নির্ভরযোগ্য এবং আমলযোগ্য দলীল তো আছে।

-তৃতীয় ফায়দা হলো, একেকজন একেক পথ ধরে চললে আল্লাহ তায়ালার নিকট যেটি সঠিক, কোনো না কোনো পক্ষের মাধ্যমে সেটির উপর আমল হয়ে যায়।

 

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top