টুডেনিউজ ডেস্ক
“রাজান, তোমার চীনে যাওয়ার দরকার নেই—হুওয়ারায় এসো, চীন এখানেই আছে।”
আমার বন্ধু আহমেদ কথাটি মজা করে বললেও, এতে ছিল একটি তিক্ত সত্য। নিরাপত্তার কারণে তিনি নিজের পুরো পরিচয় গোপন রাখতে বলেন।
হুওয়ারা, নাবলুসের কাছে একটি ছোট ফিলিস্তিনি গ্রাম। এটি ঘিরে আছে সবচেয়ে সহিংস ও উগ্র ইহুদিবাদী বসতিগুলোর একটি, যার মধ্যে রয়েছে ইতজার।
আমি জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, “চীনা শ্রমিকরা আশপাশের বসতিতে থাকে ও কাজ করে। আমি প্রায়ই তাদের গ্রামের রাস্তায় দেখি, তারা আমাদের দোকান থেকেও কেনাকাটা করে।”
এই কথাগুলো আমাকে গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করে। আমি অধিকৃত পশ্চিম তীরজুড়ে বহু ফিলিস্তিনির সঙ্গে কথা বলি এবং সাক্ষ্য সংগ্রহ করি।
রামাল্লার আলী বলেন, “আমি বেইত এল-এ বহু চীনা শ্রমিককে বাড়ি ও সড়ক বানাতে দেখেছি।”
হেবরনের সাঈদের স্মৃতি, “কোভিড-১৯ এর সময় বসতি স্থাপনকারীরা চীনা শ্রমিকদের আলাদাভাবে কোয়ারেন্টাইনে রেখেছিল।”
এইসব অভিজ্ঞতা একটি অস্বস্তিকর সত্য তুলে ধরে: চীনা শ্রমিকরা দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি বসতি গড়তে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে।
যেটি চীনের নিজস্ব ঘোষিত নীতির বিপরীত। এক দশক আগে, চীন নিজ দেশের শ্রমিকদের বসতিগুলোতে কাজ করতে নিষেধ করেছিল।
২০১৫ সালে চীন-ইসরায়েল শ্রমচুক্তিতে, অধিকৃত পশ্চিম তীরে চীনা শ্রমিক না পাঠানোর শর্ত ছিল। তবে এটি কোনো নৈতিক অবস্থান নয়, বরং নিরাপত্তা-উদ্বেগ থেকেই ছিল।
কিন্তু ২০১৬ সালে, চীন মিৎজপে শালেমের একটি বসতি-ভিত্তিক কোম্পানি আহাভা অধিগ্রহণ করে। এতে চীনের নিরাপত্তা-উদ্বেগ শিথিল হয়ে পড়ে।
এরপর ২০১৭ সালে, আগের শর্তেই নতুন একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়, যাতে ৬০০০ চীনা শ্রমিক ইসরায়েলে পাঠানো হয়।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইমানুয়েল নাহশন জানান, এটি ছিল “শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা” নিশ্চিত করার জন্য।
তবে চীনা কর্মকর্তারা বলেন, “মূল সমস্যা নিরাপত্তা নয়, বরং বসতি স্থাপন নিয়ে চীনের আপত্তি।”
কিন্তু রামাল্লা, নাবলুস ও হেবরনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট হয়েছে—চীনা শ্রমিকরা বসতি নির্মাণে জড়িত।
এটি বসতি স্থাপনের বিরোধিতায় চীনের অবস্থান কতটা আন্তরিক, সে প্রশ্ন তোলে।
‘আমাদের সময়ের পথিকৃৎ’
গাজায় চলমান হত্যাযজ্ঞের মাঝে চীনা কর্মকর্তারা পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান বলেন, ইসরায়েলকে “অবৈধ বসতি স্থাপন বন্ধ করতে হবে।”
কিন্তু একদিকে চীন সংযমের কথা বললেও, অন্যদিকে চীনা কোম্পানিগুলো দখলদারি ও বসতি স্থাপনকারী প্রকল্পে কাজ করছে।
একটি তাৎপর্যপূর্ণ উদাহরণ হলো ‘আদামা কৃষি সমাধান’। এটি আগে ইসরায়েলি কোম্পানি ছিল, এখন এটি চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কেমচায়নার সম্পূর্ণ মালিকানাধীন।
জেরুজালেম পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজা যুদ্ধ চলাকালে আদামা শ্রমিক সংকটে থাকা কৃষকদের সহায়তা করেছে—বিশেষ করে দক্ষিণের কৃষক, গাজা এনভেলপের আশপাশের বাসিন্দা এবং উত্তরাঞ্চলের বসতিগুলোর কৃষকরা।
আদামার এক প্রতিনিধি বলেন, “এই কৃষকেরা আমাদের সময়ের পথিকৃৎ। দেশের নিরাপত্তা রক্ষায় তাদের অবদান অপরিহার্য।”
তিনি আরও বলেন, “তারা আজ কঠিন কষ্ট ও শ্রমিক সংকটের মধ্যে নিজেদের জমিতে ফিরছেন। আদামা, শান্তিকালেও যেমন পাশে ছিল, সংকটকালেও পাশে থাকবে।”
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে, আদামা গাজা এনভেলপ ও উত্তরাঞ্চলীয় বসতির বাসিন্দাদের জন্য কৃষিশিক্ষায় একাডেমিক ডিগ্রি অর্জনের লক্ষ্যে প্রায় ১০ লক্ষ শেকেলের বৃত্তি ঘোষণা করে।
আদামার বসতিগুলোর সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে। এর পণ্য জর্ডান উপত্যকার ইসরায়েলি বসতিতে কৃষি পরীক্ষায় ব্যবহৃত হয়েছে।
আরও উদ্বেগের বিষয়, এর একটি ভেষজনাশক গাজা সীমান্তে ইসরায়েলি সামরিক ঠিকাদারদের মাধ্যমে আকাশপথে স্প্রে করা হয়েছে, যা গাছপালা ধ্বংস করেছে।
চীন নিজেকে নিরপেক্ষ বা মানবিক শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করলেও আদামার মালিকানা তাকে সরাসরি ফিলিস্তিনি জীবিকা ধ্বংসের সঙ্গে যুক্ত করে।
ঔপনিবেশিক স্থাপনায় চীনের নীরব সমর্থন
এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত চীনা কোম্পানি—বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে—ইসরায়েলি বসতি ও সেখানকার কোম্পানিগুলিতে সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে বিনিয়োগ করেছে।
একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো তনুভা—ইসরায়েলের একটি শীর্ষস্থানীয় খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান, যার কার্যক্রম অবৈধ বসতিগুলোর মধ্যেই কেন্দ্রীভূত। আন্তর্জাতিকভাবে বয়কটের আহ্বান থাকা সত্ত্বেও, ২০১৪ সালে চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্রাইট ফুড কোম্পানি তনুভার ৫৬ শতাংশ শেয়ার কিনে নেয়।
২০২১ সালে তনুভা একটি সরকারি টেন্ডার জিতে নেয়, যার মাধ্যমে মাতেহ ইয়েহুদা অঞ্চলের ১৬টি বসতিতে ২২টি পাবলিক ট্রান্সপোর্ট রুট পরিচালনা শুরু করে—সবগুলোই দখলকৃত পূর্ব জেরুজালেম ও পশ্চিম তীরের মধ্যে। এগুলো কেবল বাস রুট নয়, বরং উপনিবেশ গড়ার পরিকাঠামো; বসতি স্থাপনকারীদের জীবনকে আরও সহজ, স্থায়ী এবং নিরাপদ করে তুলতে এদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
আরেকটি দৃষ্টান্ত ২০১৬ সালের, যখন চীনের ফোসুন গ্রুপ অধিগ্রহণ করে ‘আহাভা’ নামের একটি প্রসাধনী ব্র্যান্ড, যার উৎপাদন কেন্দ্র অবস্থিত মিৎজপে শালেম বসতিতে। এই কোম্পানিটি বহুদিন ধরেই বৈশ্বিক বয়কট অভিযানের লক্ষ্য ছিল এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ একে অবৈধ বসতি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
এই সময়েই চীনা কূটনীতিকেরা ইসরায়েলকে বসতি সম্প্রসারণ বন্ধ করতে আহ্বান জানিয়ে আসছেন। ২০২৩ সালের শেষ দিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চীনের সাবেক রাষ্ট্রদূত ঝাং জুন বলেন, “আমরা ইসরায়েলকে আহ্বান জানাচ্ছি যেন তারা পশ্চিম তীরে বসতিস্থাপনকারী সহিংসতা বন্ধ করে, যাতে উত্তেজনা ও সংঘাত আরও না বাড়ে।” তার উত্তরসূরি ফু কংও একই বার্তা পুনরাবৃত্তি করেন এবং ইসরায়েলকে “অবৈধ বসতি কার্যক্রম বন্ধ করার” আহ্বান জানান।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—চীনের নিজস্ব কোম্পানিগুলো যখন এসব অবৈধ কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িত, তখন এই বক্তব্যের কি কোনো নৈতিক ভিত্তি আছে?
জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা বসতি-সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত কোম্পানিগুলোর একটি নিয়মিত তালিকা প্রকাশ করে। তবুও চীনা কোম্পানিগুলো এমন সহযোগিতা অব্যাহত রাখে—যেন তারা আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা করে না।
জাতিসংঘের একাধিক প্রস্তাব অনুযায়ী, ইসরায়েলের এসব বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের স্পষ্ট উদাহরণ। অথচ চীনের এই জড়িত থাকা তাদের নিজেদেরই ঘোষিত নীতির পরিপন্থী।
বেইজিং বসতি স্থাপনের বিরোধিতা করলেও, ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ফিলিস্তিনের অধিকার বিসর্জন দিয়ে ইহুদিবাদী উপনিবেশের ভিত্তিকে আরও মজবুত করছে।
আরও আশঙ্কাজনক বিষয় হলো, এসব বিনিয়োগ কতটা নীরবে, চোখের আড়ালে চলছে—যেন গোপনে একটি বর্ণবাদী ব্যবস্থাকে জিইয়ে রাখা হচ্ছে, এমন সময়েও যখন বেইজিং ফিলিস্তিনের স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি তোলে।
সূত্র : মিডল ইস্ট আই