শায়খ হাসান মুরাদ
১৮ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে দেশের নারীদের সার্বিক কল্যাণের জন্য শিরিন পারভীন হক এর নেতৃত্বে ১০ সদস্যবিশিষ্ট নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। সম্প্রতি উক্ত কমিশন “নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন” শিরনামে ৩১৮ পৃষ্ঠার একটি সংস্কার কপি তৈরি করেছে, যা ১৭ টি অধ্যায়ে বিভিক্ত।
বাংলাদেশের অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের কাছে উক্ত কমিশন ১৯ এপ্রিল ২০২৫ তারিখে মূল ১৫টি বিষয়সহ ৪৩৩ টি নারী বিষয়ক সংস্কার সুপারিশ করেছে । এবং তা সরকারি ওয়েব সাইটে বই আকারে প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত জাতীয় নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ও তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। এসব সুপারিশ শুধুমাত্র ইসলামি শরিয়াহর সঙ্গেই সাংঘর্ষিক নয়, বরং ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সাংবিধানিক অধিকারের বিরুদ্ধেও অবস্থান করছে। এই প্রবন্ধে আমরা প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করে দেখবো কেন এগুলো বাতিল করা উচিত।
নারী কমিশনের কয়েকটি ইসলাম বিরোধী সুপারিশ:
(১) সকল ধর্ম-মতের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন। (পৃষ্ঠা ৯)
নারী কমিশনের প্রথম ইসলাম বিরোধী সুপারিশ হলো সকল ধর্মের জন্য একক পারিবারিক আইন চালু করা। এর অর্থ হচ্ছে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান সবার পারিবারিক আইনকে বাতিল করে একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আইন চাপিয়ে দেওয়া। বাস্তবতা হলো, এটি নিছক ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মত্যাগকে উৎসাহিত করার কৌশল। অর্থাৎ, হিন্দু-মুসলিম-খৃস্টান সবাইকে পারিবারিক বিষয়ে ‘আইনগতভাবে ধর্মত্যাগ’ করতে উৎসাহিত করা হবে, পরবর্তীতে একে বাধ্যতামূলক বানানো হবে।
(২) ৯ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে; সংবিধানের ২৮নং অনুচ্ছেদের অধীনে নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্যমূলক বিধান বিদ্যমান, বিশেষ করে বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, ও ভরণপোষণের ক্ষেত্রে ধর্মীয় আইন অনুসরণ বাধ্যতামূলক হওয়ায় নারীরা বৈষম্যের শিকার হন। যার ফলে পুরুষ ও নারীর মাঝে বিদ্যমান অসমতা তাদের সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ করে রাখছে। এখানে ধর্মীয় আইনকে অবজ্ঞা করে নিজেদের প্রণিত আইনকে প্রমোট করার চেষ্টা করছে। ধর্মীয় আইনকে বৈষম্যের কথা বলে মূলত ইসলামী আইন তথা আল্লাহর বিধানকে অবজ্ঞা করেছে। যা স্পষ্ট কুফরি। আল্লাহর বিধান কখনো পরিবর্তন হওয়ার নয়।
(৩) বিবাহ-শাদী, খোরপোষ, সন্তান প্রতিপালনসহ পারিবারিক বিষয়ে জাতিসংঘ প্রণীত আইন বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। এটি মূলত ঈঊউঅড সনদ হিসেবে পরিচিত। (পৃষ্ঠা, ৯)
ঈঊউঅড (ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ঃযব ঊষরসরহধঃরড়হ ড়ভ অষষ ঋড়ৎসং ড়ভ উরংপৎরসরহধঃরড়হ অমধরহংঃ ডড়সবহ) বাস্তবায়নের আহ্বান রয়েছে। যদিও এই সনদ নারীর অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে কিছু ভালো দিক রাখে, তবে এর অনেক ধারা ইসলামি পারিবারিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
(৪) পারিবারিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষকে অভিন্নভাবে দেখতে বলা হয়েছে। (পৃষ্ঠা, ৯)
কমিশনের মতে, পারিবারিক ক্ষেত্রে নারী-পুরুষকে অভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে হবে। এটি মূলত পশ্চিমা ‘জেন্ডার সমতা’ ধারণার প্রতিফলন। ইসলাম অবশ্যই নারী-পুরুষের মাঝে সম্মান ও মর্যাদায় সমতা দিয়েছে, কিন্তু তাদের দায়িত্ব ও ভূমিকার মধ্যে স্বতন্ত্রতা রেখেছে। সূরা নিসা ৩৪-এ বলা হয়েছে, “পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল, কারণ আল্লাহ একের উপর অপরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং তারা নারীদের উপর ব্যয় করে।” অতএব, ইসলাম নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য করে না কিন্তু তাদের সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য ও দায়িত্ব অনুযায়ী ভিন্নতা স্বীকার করে। এটাই ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি।
(৫) মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বাতিল করে নারী-পুরুষকে সমান সম্পদ প্রদান। (পৃষ্ঠা, ২৫) নারী কমিশনের প্রথম বিতর্কিত সুপারিশটি হলো মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বাতিল করে নারী-পুরুষকে সমান সম্পত্তি প্রদানের আহ্বান। অথচ, ইসলামে উত্তরাধিকার বণ্টন একেবারেই মানব-নির্ধারিত নয়; এটি সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত একটি বিধান (সূরা নিসা: ১১-১২, ১৭৬)। এখানে পরিবর্তনের অর্থ হবে আল্লাহর বিধানে হস্তক্ষেপ করা, যা কুরআনের বিধান অস্বীকার করার নামান্তর। ইসলাম নারীকে শুধু সম্পত্তির অধিকারই দেয়নি, বরং তার জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে আর্থিক দায়িত্ব পুরুষের উপর অর্পণ করেছে। একজন নারী তার বাবার ঘরে, স্বামীর ঘরে কিংবা ভাইয়ের ঘরে কোনো অবস্থাতেই আর্থিক দায়ভার বহন করে না। ফলে উত্তরাধিকারে পুরুষের অধিক অংশ কোনো বৈষম্য নয়, বরং এটি দায়িত্বের পরিপ্রেক্ষিতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ন্যায়বিচার।
(৬) ১০ নং পৃষ্ঠায় বর্তমান সংবিধানের ২৬, ২৭, ২৮(৩) ২৯, ৩২, ও ৪২ অনুচ্ছেদ সংশোধনের সুপারিশ করা হচ্ছে। অর্থাৎ রাষ্ট্র নীতি হবে হবে ইহজাগতিক এবং মানবিক কেন্দ্রিক। এই আইনে মূলত পরজগত বা আখেরাতের বিষয়কে বাদ দেওয়া হয়েছে। মানুষ শুধু ইহজীবনের চিন্তা করবে। অথচ মানুষের জীবনের মূল লক্ষ্য আখেরাতের সফলতা। জান্নাত লাভ করা।
(৭) ৬৬ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে পিতার নাম পরিচয় না পাওয়া গেলে মাতার নাম দিয়ে জন্মনিবন্ধনের ব্যবস্থা নেওয়া । অর্থাৎ শিশুকে মায়ের পরিচয়ে পরিচিত করার এক প্রবনতা তৈরি করার আয়োজন চলছে। এ ক্ষেত্রে পিতাহীন শিশুটির নিশ্চয় কোন দায় নেই, তবে শিশুকে সমাজে মায়ের পরিচয়ে পরিচিত করার বিষয়টি বিবাহহীন সন্তান জন্মের বৈধতা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা মাত্র যা হারাম।
(৮) ২২৫ পৃষ্ঠায় ৬.৩.২.১ ধারায় বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে ফৌজদারি আইনে অন্তর্ভূক্ত করতে সুপারিশ করা হয়েছে। যা একাধিক সহিহ হাদীসের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া। তাছাড়া বিষয়টি সামাজিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অন্যতম কারণ হবে। এসব বিষয় মেনে নিলে নারী দ্বারা পুরুষ নির্যাতনের সংখ্যা আনুপাতিক হারে বাড়বে।
(৯) ২১৯, ২০ পৃষ্ঠায় নারীদের সব ধরনের খেলা-ধূলা, নাচ-গান, নাটক, সিনেমা ইত্যাদিতে নারীদের অংশ গ্রহন করাকে জেলা উপজেলা পর্যায়ে ব্যাপকায়ন করার নীতি বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিষয়টি সরাসরি পর্দার বিধানের বিপরীত। আর নারী-পুরুষের পর্দার বিষয়টি কুরআনের বিভিন্ন আয়াত দ্বারা প্রমানিত। ৩১৮ পৃষ্ঠার সংস্কারে এমন আরও অনেক অবাস্তব বিষয় উত্থাপন করা হয়েছে, যা কোন ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষায় আমাদের অবস্থান
এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হলে তা শুধু মুসলিমদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও জীবনধারার উপর আঘাত নয়, বরং জাতীয় ঐক্য ও সামাজিক স্থিতির জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। তাই এই সুপারিশগুলো অবিলম্বে বাতিল করতে হবে এবং নারী কমিশনকে পুনর্গঠন করতে হবে, যেখানে সকল ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব থাকবে।
ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত নয় : সাধারণ আলেম সমাজ