মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) চার বিচারকের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই পদক্ষেপটি এসেছে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি এবং আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর কথিত যুদ্ধাপরাধের মামলার প্রেক্ষাপটে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর এক বিবৃতি অনুসারে, নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা বিচারকরা হলেন উগান্ডার সোলোমি বালুঙ্গি বোসা, পেরুর লুজ ডেল কারমেন ইবানেজ কারাঞ্জা, বেনিনের রেইন অ্যাডিলেড সোফি আলাপিনি গানসো এবং স্লোভেনিয়ার বেটি হোহলার।
রুবিও বলেন, ‘এই চার ব্যক্তি আইসিসির বিচারক হিসেবে আমেরিকা এবং আমাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরাইলকে লক্ষ্য করে আইসিসির অবৈধ এবং ভিত্তিহীন কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে জড়িত।’
আইসিসি এই নিষেধাজ্ঞার কঠোর নিন্দা জানিয়ে এক বিবৃতিতে জানিয়েছে। এটি একটি আন্তর্জাতিক বিচারিক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতার উপর আক্রমণ, যা বিশ্বব্যাপী ‘অকল্পনীয় নৃশংসতার’ শিকার লাখো মানুষের জন্য ন্যায়বিচার প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করে।
বিচারক বোসা ও ইবানেজ কারাঞ্জা ২০১৮ সাল থেকে আদালতের বেঞ্চে রয়েছেন এবং ২০২০ সালে তারা একটি আপিল চেম্বারের অংশ ছিলেন, যা আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করার অনুমোদন দেয়।
২০২১ সাল থেকে আইসিসি আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর পরিবর্তে আফগান সরকার ও তালেবানের অপরাধের দিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।
আইসিসির বিচারক আলাপিনি গানসো ও হোহলার গাজা যুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে নেতানিয়াহু ও সাবেক ইসরাইলি প্রতিরক্ষা প্রধান ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেফতারি পরোয়ানার অনুমোদনে ভূমিকা রেখেছেন। একই মামলায় হামাস নেতা ইবরাহিম আল-মাসরির বিরুদ্ধেও পরোয়ানা জারি করা হয়।
২০২০ সালেও ট্রাম্প প্রশাসন আদালতের কার্যক্রমের জন্য আইসিসির তৎকালীন প্রধান প্রসিকিউটর ফাতু বেনসুদা ও তার এক শীর্ষ সহকর্মীর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। নেতানিয়াহুর গ্রেফতারি পরোয়ানার প্রতিবাদে চলতি বছরের জানুয়ারিতে মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে আইসিসিকে শাস্তি দেয়ার পক্ষে ভোট হয়, যার ধারাবাহিকতায় এই সাম্প্রতিক নিষেধাজ্ঞা।
মানবাধিকার কর্মী ও সংগঠনগুলো এই পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আন্তর্জাতিক বিচারবিষয়ক পরিচালক লিজ ইভনসন বলেন, ‘এই শাস্তিমূলক পদক্ষেপগুলো আইনের শাসনের উপর সরাসরি আক্রমণ।’
এই নিষেধাজ্ঞাগুলোর ফলে সংশ্লিষ্ট বিচারকদের আর্থিক লেনদেনের সক্ষমতা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ মার্কিন ডলারে বা যুক্তরাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন নিষিদ্ধ। তবে ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ৮ জুলাই পর্যন্ত একটি সাধারণ লাইসেন্স জারি করেছে, যার আওতায় টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের সাথে পূর্ববর্তী লেনদেন বন্ধ করার সময় দেয়া হয়েছে, শর্ত হলো অর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি ব্লক করা সুদ-বহনকারী অ্যাকাউন্টে জমা রাখতে হবে।
এই পদক্ষেপ এমন এক সময়ে এসেছে যখন আইসিসি ইতোমধ্যেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে চাপে রয়েছে। সম্প্রতি আদালতের প্রধান প্রসিকিউটর করিম খান জাতিসঙ্ঘের এক যৌন অসদাচরণ তদন্তের প্রেক্ষিতে সাময়িকভাবে পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন।
২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার করার এখতিয়ার রাখে, যদি সংশ্লিষ্ট দেশ সদস্য হয় বা জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ বিষয়টি আদালতে উত্থাপন করে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ইসরাইল এই চারটি দেশই আইসিসির সদস্য নয়।
বর্তমানে আইসিসি গাজা, ইউক্রেন, সুদান, মায়ানমার, ফিলিপাইন, ভেনেজুয়েলা এবং আফগানিস্তানে উচ্চ-প্রোফাইল যুদ্ধাপরাধ তদন্তে নিয়োজিত। আদালত ইতোমধ্যে ইউক্রেন থেকে শিশুদের বিতাড়নের অভিযোগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং গাজায় যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ইসরাইলের নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে। উভয় দেশই আদালতের সদস্য নয় এবং তারা এই অভিযোগ ও আদালতের এখতিয়ার উভয়ই প্রত্যাখ্যান করেছে।
সূত্র : রয়টার্স