সাম্প্রতিক সময়ে ইসরাইল ও ইরানের মধ্যকার সামরিক সংঘাত চূড়ান্ত উত্তেজনাকর মোড় নিচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে, ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর মন্তব্য এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থান নিয়ে নতুন বিতর্কের জন্ম হয়েছে ইরানে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের বিষয়ে।
নেতানিয়াহুর অবস্থান : সংঘাত নয়, অবসান
সোমবার মার্কিন সম্প্রচার মাধ্যম এবিসি নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নেতানিয়াহুকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির বিরুদ্ধে ইসরাইলের সম্ভাব্য হত্যার পরিকল্পনা বাতিল করেছেন কিনা। নেতানিয়াহু সরাসরি প্রশ্নের উত্তর না দিলেও বলেন, এটি সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে তুলবে না, এটি সংঘাতের অবসান ঘটাবে, এবং ইসরাইল যা প্রয়োজন তা করছে।
ব্যানন-কার্লসনের বিশ্লেষণ : শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনই মূল লক্ষ্য
এই আলোচনার পর, ট্রাম্পের সাবেক উপদেষ্টা স্টিভ ব্যানন এবং সাবেক ফক্স নিউজ বিশ্লেষক টাকার কার্লসন দু’জনেই ইঙ্গিত দেন যে হোয়াইট হাউসের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড ইরানে শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরিচালিত হচ্ছে। কার্লসন স্পষ্ট ভাষায় বলেন, শাসন পরিবর্তন—এই তো আসল কথা, এবং জানান তিনি এ পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের চেনেন।
যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব
ব্যানন প্রশ্ন তোলেন, কেন ইরান সম্পর্কিত ক্যাম্প ডেভিড বৈঠকে তুলসি গ্যাবার্ডকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, যিনি আগেই বলেছেন ইরান পারমাণবিক অস্ত্রের কাছাকাছি নেই। তিনি বলেন, এটি কেবল পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে নয়, বরং সম্পূর্ণ নেতৃত্বের শিরশ্ছেদ পরিকল্পনা।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের কিছু ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ ধারার রাজনীতিবিদ ও ট্রাম্পের ভোটার বেস এই ধরনের শাসন পরিবর্তনের প্রচেষ্টা এবং সম্ভাব্য যুদ্ধের বিপক্ষে। তারা মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধ আমেরিকার স্বার্থের পরিপন্থী।
আইনি সীমাবদ্ধতা ও বাস্তবতা
১৬০০ সালের যুদ্ধ আইনের আওতায় রাষ্ট্রনেতাদের হত্যা নিষিদ্ধ, কিন্তু ৯/১১ পরবর্তী সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ সেই নীতির সীমারেখা ঘোলাটে করে তুলেছে। ইরান ১৯৮৪ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের চোখে ‘সন্ত্রাস পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্র’। তবে আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন—একটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতাকে হত্যা আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হবে এবং তা যুদ্ধের মাত্রাকে বিপজ্জনকভাবে বাড়াতে পারে।
ইরানি জাতীয়তাবাদ ও রাজনৈতিক কাঠামোর প্রতিরোধক্ষমতা
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরান-বিশেষজ্ঞ সিনা আজোদি বলেন, ইরান একটি সুসংগঠিত রাষ্ট্র, যেখানে সর্বোচ্চ নেতার উত্তরসূরি নির্বাচনের জন্য একটি পরিষদ বিদ্যমান। এটি ইরাক বা যুগোস্লাভিয়ার মতো নয়, যেখানে নেতার পতনে শাসনব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
আজোদি মনে করেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরানের জনগণের মধ্যে শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনও বৃহত্তর গণবিদ্রোহ দেখা যায়নি। তিনি বলেন, আমি কাউকে এই শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের পক্ষে কথা বলতে শুনিনি, বরং শেষ শাহের পুত্রের বক্তব্য নিয়ে কেবল উপহাসই শুনেছি।
ট্রাম্প প্রশাসনের কৌশল : দ্বৈত বার্তা
শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের ভেতরে দ্বৈত বার্তা লক্ষ্য করা যায়। একদিকে, ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে একটি নতুন চুক্তি করতে আগ্রহী ছিলেন এবং খামেনির সঙ্গে ব্যক্তিগত চিঠি বিনিময়ও করেছেন। অন্যদিকে, তার প্রশাসন ও প্রতিরক্ষা বিভাগ ইসরাইলকে অস্ত্র সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে এবং তেহরানে সামরিক আক্রমণের ক্ষেত্রে কূটনৈতিক ছাড়পত্র দিচ্ছে।
এই পর্যায়ে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ট্রাম্প নিজে সরাসরি শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের পথে পা বাড়াননি। তবে ইসরাইলি আক্রমণের মাধ্যমে এমন একটি বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে, যেখানে ওয়াশিংটন চাইলেও একসময় আর নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না।
সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির কর্মকর্তা ডিলান উইলিয়ামস বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বমঞ্চে কূটনৈতিক উৎসাহ ও সামরিক সহায়তা দিচ্ছে। ফলে, এই অঞ্চল এবং বিশ্ব একে ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্রের সম্মিলিত প্রচেষ্টা হিসেবেই দেখছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, ইরানে জনপ্রিয় আন্দোলনের অনুপস্থিতিতে বাইরের হস্তক্ষেপ শুধু ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে পারে। তাই এই মুহূর্তে একটি সফল শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।