শায়খ ইবনুল কালাম
দীর্ঘ ১৫ বছর পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল বাংলাদেশীরা। অভূতপূর্ব ছাত্র-নাগরিক আন্দোলনে দেশ ত্যাগ করলো স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা। এতে জালেমের বিরুদ্ধে মাজলুমের জয় সূচিত হয়েছে। জয় হয়েছে মানে জালিমকে তাড়ানো গেছে। তবে তাদের দোসররা রয়ে গেছে। এখন স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের এতোদিনের জমিয়ে রাখা ক্ষোভ তাদের উপরই উগরে দেয়ার কথা। তবে অন্যায়ের প্রতিদান শুধুই সদৃশ শাস্তিবিধানের মাধ্যমে হয় না। এর উত্তম বিকল্পও রয়েছে। তার দৃষ্টান্ত আমরা মহানবী সা. এর জীবনীতে পাই।
ইসলামের ঊষালগ্নে মুসলিমরা অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তাদের সেই অমানিশাকাল বেশিদিন থাকেনি। মাত্র ১৩ বছরের ব্যবধানে জুলুমের প্রতি-বিধান করার সক্ষমতা অর্জন করেছিলেন তারা। সর্বশেষ মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে জালেমদের উপর চূড়ান্ত বিজয়ও অর্জন করেছিলেন মুসলিমরা। তখন আল্লাহর রাসূল সা. চাইলে জুলুমের প্রতিশোধ নিতে পারতেন। তালিকা করে জালিম নেতাদের চূড়ান্ত শাস্তি দিতে পারতেন। কিন্তু নবীজি সা. ওই পথে হাঁটেননি। তিনি প্রতিশোধ নেননি। বরং সবাইকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। সেদিন জালিম থেকে শুরু করে ন্যূন্যতম দোসর পর্যন্ত নবীজির ক্ষমা পেয়েছিল।
সেদিন নবীজি সা. পুরো মক্কার মাত্র ১৫ জন লোককে ক্ষমার অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন। নবীজি সা. এর চাচা হামজা রা. এর কলিজা চিবিয়ে খেয়েছিলেন যে হিন্দা, তাকেও নবীজি ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। নবীজি সা.কে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন যে ফোজালা, তাকেও নবীজি মাফ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এদের অপরাধ ছিলো আরো জঘন্য। নানা কারণে তারা ছিল ক্ষমার অযোগ্য। সেজন্য তাদের ক্ষমা করা হয়নি। তবে তাদের মধ্যে মাত্র ছয়জন নিহত হয়েছিল। অন্যরাও নানা উপায়ে নবীজির ক্ষমা পেয়ে যায়।
রাসূল সা. বিজয়ী বেশে মক্কায় প্রবেশকালে কোনো ধরনের রক্তপাত ঘটাননি। কারো সম্পদে হাত দেননি। সাহাবিদেরকেও কোনো প্রতিশোধের সুযোগ দেননি। বরং মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সবাইকে সতর্ক দিয়েছেন, কেউ নিজের ঘর বন্ধ করে বসে থাকলে তাকে যেন আঘাত না করা হয়। আবু সুফিয়ানের ঘরে আশ্রয় নিলেও রেহাই পাবে। কেউ প্রতিরোধ গড়ে তুললে প্রতিরোধ ভাঙা পরিমাণ প্রতিঘাত করা যাবে।
বিজয়ের প্রাক্কালে নবীজি সা. নিজের মিত্রদের প্রতি সজাগ ছিলেন। তারা যেন আগের কোনো অন্যায়ের প্রতিশোধ গ্রহণ না করে। মুসলিমদের মিত্র বনু খোজায়া কোরেশের মিত্র বনু বকরের হাতে অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। মক্কা বিজয়ের সময়কে বনু খোজায়া সুবর্ণ সুযোগ হিসেবে নিলো। তারা পূর্ব শত্রুতরার জেরে বনু বকরের উপর হামলা করে বসল। এতে বনু বকরের অনেকেই প্রাণ হারালো। খবর পেয়ে রাসূল সা. তাদের ডেকে পাঠালেন। এরপর তাদের ভীষণ তিরস্কার করেন। এ সময় রাসূল সা. বললেন, এবারের রক্তপাতের বদলা আমি দিয়ে দিচ্ছি। তবে কান খুলে শুনে রাখো, সামনে যদি এ ধরনের কোনো রক্তপাত ঘটানো হয়, তবে হত্যাকারী থেকে কেসাস নেয়া হবে।
কোনো শহর বিজয়ের অর্থ কেবল নেতাদের থেকে শহরের কর্তৃত্ব গ্রহণ করাই নয়। বরং শহরবাসীর মন জয় করাও বিজয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এক্ষেত্রে সবিশেষ কার্যকরী হলো বিজয়ী প্রধানের ভাষণ। সেজন্য নবীজি সা. মক্কা বিজয়ের পর একটি ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। ভাষণে মক্কাবাসীকে লক্ষ্য করে বলেন, হে কোরেশরা, অতীতের সকল ভ্রাণ ধারণা থেকে পবিত্র হও। কৌলিন্যের গর্ব ভুলে যাও। সবাই এক হও। মানুষ হিসেবে সবাই সমান, এ কথায় বিশ্বাসী হও। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, হে মানুষ, আমি তোমাদের সবাইকে একই স্ত্রী ও পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি। তোমাদেরকে বিভিন্ন গোত্র ও শাখায় বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারে।’
এই ভাষণের মধ্য দিয়ে রাসূল সা. নগরবাসীর মন থেকে ভয়কে দূর করলেন। নিজের মহানুভবনার মাধ্যমে তাদের মন জয় করলেন। ফলে প্রতি বিপ্লবের আশঙ্কা অনেকটাই কেটে গেল।
রাসূল সা. এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না। বরং নগরীর আশপাশের অন্যান্য গোত্রের প্রতিও মনোনিবেশ করলেন। যেন নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে কেউ এই মহান বিজয়কে ম্লান করতে না পারে। সেজন্য রাসূল সা. তাদের কাছে প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। এরই ধারাবাহিকতায় খালেদ বিন ওলিদ রা.-কে মক্কার উপকণ্ঠে থাকা বনী যাজিমা গোত্রের কাছে পাঠানো হয়। তারা খালেদ রা.-এর দাওয়াত গ্রহণ করল না। উল্টো অত্যন্ত রূঢ় আচরণ করল। ফলে খালেদ রা. তাদের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এ যুদ্ধে যাজিমা গোত্রের কিছু লোক প্রাণ হারায়। এই সংবাদ রাসূল সা.-এর কাছে পৌঁছালে তিনি খালেদ রা.কে তিরস্কার করেন। দাওয়াত কবুল না করে রূঢ় ব্যবহার করায় তাদের শাস্তিবিধানের পক্ষ নেননি। বরং ক্ষতিপূরণ দিয়ে সন্তুষ্ট করেন। তারা রাসূল সা.-এর এমন মহানুভবতা দেখে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।
এভাবে রাসূল সা. প্রতিটি পদক্ষেপে মহানুভবতার পরিচয় দিয়ে পরাজিতদের মন জয় করতে সক্ষম হন। ফলে নাগরিকদের জমিয়ে প্রতিবিপ্লব ঘটানোর মতো সুযোগ স্থানীয় নেতাদের হাতে অবশিষ্ট থাকেনি। এছাড়া এমন বিজিত অঞ্চলে নিজ সাহাবীদেরও নিরাপত্তার জন্য আলাদাভাবে ভাবতে হতো নবীজি সা. কে। নগরবাসীকে অনুকূলে নিয়ে আসতে পারায় ওই চিন্তাও অনেকাংশে কমে যায়। এতে সব দিক থেকেই রাসূল সা. জয়ী হন।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক