ভারতের পহেলগাম হামলার পর ভারতজুড়ে কাশ্মীরি মুসলমানদের উপর হামলা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এতে একদিকে ভারতে ইসলামোফোবিয়া বৃদ্ধি পেয়েছে। অপরদিকে নানা উগ্রবাদী সংগঠন কাশ্মীরি মুসলমানদের উপর হামলার জন্য আহ্বান জানাচ্ছে। এমনই ভীতসন্ত্রস্ত পরিবেশের জানান দিয়েছেন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে থাকা কাশ্মিরীদের এক ডজনের বেশি সদস্য।
ইসরাইল যেভাবে গাজাকে শেষ করেছে, আমরাও ওদের শেষ করব : বিজেপি নেতা শুভেন্দু
আল জাজিরার প্রতিবেদনে চিত্র এভাবে তুলে ধরা হয়েছে, উত্তরাঞ্চলীয় পাঞ্জাব রাজ্যের জলন্ধরের এক সরু ও ব্যস্ত রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে আসিফ দার হঠাৎই অনুভব করেন যে চারপাশের সব চোখ যেন তার দিকেই তাকানো। এগুলো বন্ধুত্বের চোখ ছিল না। মনে হচ্ছিল, ভিড়ের প্রতিটি চোখে যেন প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে।
এভাবেই সাম্প্রতিক পরিস্থিতির চিত্রায়ন করলেন দার। দার ও তার এক বন্ধু যখন একটি এটিএম বুথের সামনে থামলেন, তখন দুই অচেনা ব্যক্তি তাদের কাছে এসে জাতিগত পরিচয় জানতে চায়। আতঙ্কে তারা পালিয়ে যান। পরদিন সকালে ২৩ এপ্রিল দার যখন দুধ কিনতে বাইরে বের হন, তখন তিন ব্যক্তি তাকে দেখে ইসলামবিদ্বেষী গালাগালি করতে থাকেন। তাদের একজন চিৎকার করে বলল, ‘সে কাশ্মীরি, সব বিপর্যয়ের মূল তারাই।
মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) জম্মু ও কাশ্মীরের পর্যটন শহর পহেলগামে বন্দুকধারীদের গুলিতে নিহত হন ২৬ জন পর্যটক, আহত আরও অনেকে। হামলার দায় স্বীকার করেছে একটি ভারতবিরোধী সশস্ত্র কাশ্মীরি সংগঠন। তবে নয়াদিল্লি এর জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে আসছে।
কাশ্মিরে পর্যটক হত্যাকাণ্ড : দায় স্বীকারকারী টিআরএফ কে এবং কেন এই হামলা?
ভারতজুড়ে কাশ্মীরি মুসলমানদের উপর হামলা
এই নৃশংসতার পর ভারতের ভেতরে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে জাতিগত ও ধর্মীয় বিভাজনের চিত্র। দেশজুড়ে কাশ্মীরি মুসলমানদের উপর হামলা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা চরমপন্থী হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠী এমনকি সহপাঠীদের দ্বারাও নিগৃহীত হচ্ছেন। গালাগালি, হুমকি, শারীরিক হয়রানি—সবই যেন এখন তাদের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতা।
উত্তরাখণ্ড, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশসহ একাধিক রাজ্যে বাড়িওয়ালারা কাশ্মীরি ভাড়াটেদের বাড়ি ছাড়তে বলছেন; দোকানদাররা তাদের সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করে দিচ্ছেন। কেউ কেউ এতটাই আতঙ্কিত যে বিমানবন্দরে রাত কাটাচ্ছেন, ফিরে যাচ্ছেন কাশ্মীরে।
“আমরা দায়ী নই, কিন্তু মূল্য দিতে হচ্ছে আমাদেরই,” বলেন দার।
কাশ্মিরে হামলা : ভারতীয় হিন্দুরাই বলছেন, ঘটনা পরিকল্পিত
‘চোখে চোখে শুধু অবিশ্বাস’
কাশ্মীর একটি বিতর্কিত অঞ্চল, পুরোটা দাবি করে ভারত, যদিও বাস্তবে এটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত। নয়াদিল্লি বারবার ইসলামাবাদকে ‘সীমান্ত-সন্ত্রাসবাদ’ ছড়ানোর অভিযোগে অভিযুক্ত করছে, যদিও পাকিস্তান এর সম্পূর্ণ দায় অস্বীকার করে বলেছে, তারা কেবল কাশ্মীরিদের ন্যায্য জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষায় কূটনৈতিক ও নৈতিক সহায়তা দেয়।
পহেলগামের ঘটনার পর ভারত একতরফাভাবে জলবণ্টন চুক্তি বাতিল করেছে, পারস্পরিক বহিষ্কার করেছে কূটনীতিকদের, দুই দেশের সম্পর্ক আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ভারতের অভ্যন্তরে থাকা নিরীহ কাশ্মীরি মুসলমানরা। আল জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভারতের সাতটি শহরের অন্তত এক ডজন কাশ্মীরি মুসলমান জানান, তারা ঘরবন্দি হয়ে দিন কাটাচ্ছেন— এমনকি ক্যাব বুকিং বা খাবার অর্ডার দেওয়ার মতো অনলাইন কার্যক্রম থেকেও বিরত রয়েছেন।
কাশ্মিরে হামলা : ২৬ জন পর্যটক নিহত হওয়ার ঘটনায় কী ঘটেছিল
দার জলন্ধরে অ্যানেস্থেশিয়া ও অপারেশন থিয়েটার প্রযুক্তির দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র। জীবনে প্রথমবার কাশ্মীর ছেড়ে শিক্ষার জন্য বাইরে এসেছেন।
“কাশ্মীরে খুব একটা সুযোগ নেই, তাই আমি ভবিষ্যতের জন্য মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতে চাই” বলেন তিনি। “ভাল কিছু করতে পারলে পরিবারকে সহায়তা করতে পারব।”
কিন্তু বাস্তবতা তাকে ভেঙে দিচ্ছে। টার্ম পরীক্ষার আগে আতঙ্ক ও বিষণ্ণতা তাকে গ্রাস করছে। “এই ক’মাসে যা শিখেছিলাম, সব যেন ভুলে গেছি,” বলেন তিনি। “আমার মন ঠিকভাবে কাজ করছে না। মনে হচ্ছে হঠাৎ করেই আমাকে সবকিছু ছেড়ে চলে যেতে হতে পারে।”
“যেদিকেই তাকাই, শুধু অবিশ্বাস,” বলেন দার। “আমরা অভিশপ্ত, কারণ আমাদের চেহারাই বলে দেয়—আমরা কাশ্মীরি মুসলমান।”
কাশ্মিরে হামলা : কলকাতা ডিজিটাল মিডিয়া ফেডারেশনের কো-ফাউন্ডারের ৯ অভিযোগ
আত্মত্যাগও ভুলে যায় ভারতীয় মিডিয়া
হামলার পর বিভিন্ন বেঁচে যাওয়া ব্যক্তির বর্ণনা থেকে জানা গেছে, বন্দুকধারীরা ধর্মের ভিত্তিতে পর্যটকদের আলাদা করেছিল। নিহত ২৬ জনের মধ্যে ২৫ জনই হিন্দু পুরুষ।
তবে ভারতীয় মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ায় একেবারে উপেক্ষিত রয়ে গেছে ২৬তম নিহতের পরিচয়: একজন কাশ্মীরি মুসলমান, যিনি পর্যটকদের রক্ষা করতে গিয়ে হামলাকারীদের হাতে প্রাণ হারান।
কাশ্মীরি বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদ শেখ শওকত বলেন, “আজকের ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ দীর্ঘদিন ধরে জমে উঠেছে। কাশ্মীরিরা দ্বিগুণ বোঝা বহন করেন—তাঁরা কাশ্মীরি, আবার মুসলমান। তাই সহজ শিকার হয়ে উঠেছেন তারা।”
‘কাশ্মীরি মুসলমানদের তাড়াও’— হুমকি উগ্র গোষ্ঠীর
উত্তরাখণ্ডের রাজধানী দেরাদুনে মঙ্গলবার একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতা ভয়াবহ হুমকি উচ্চারণ করেন।
“সরকারের অপেক্ষা করব না। কাশ্মীরি মুসলমানরা সকাল ১০টার মধ্যে না গেলে এমন শাস্তির মুখোমুখি হবে, যা কল্পনাও করতে পারবে না,” বলেন হিন্দু রক্ষা দলের নেতা ললিত শর্মা। “আমাদের কর্মীরা কাল সকালে তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে রাস্তায় নামবে।”
এরপর কাশ্মীরি ছাত্র মুশতাক ওয়ানির সোশ্যাল মিডিয়া ফিডেও এমন হুমকি বার্তা আসতে শুরু করে। গ্রন্থাগার বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ওয়ানি জানান, দেরাদুনে কাশ্মীরি ছাত্রদের ফোনে ফোনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলার পরও দেরাদুনে কাশ্মীরি ছাত্রদের উপর দফায় দফায় হামলা হয়েছিল। অনেকে আজও ফিরে যাননি।
“আমাদের জীবন যেন এক অভিশাপ,” বলেন ওয়ানি। “জঙ্গিরা কারও ক্ষতি করলে তার মাশুল দিতে হয় আমাদের—নিরীহ কাশ্মীরি মুসলমানদের।”
বর্তমানে ওয়ানি ১৫ জন ছাত্রকে কাশ্মীরে ফেরানোর ব্যবস্থা করেছেন। নিজেও এক বন্ধুর বাসায় লুকিয়ে টার্ম পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
তবে হুমকি-দাতাকে গ্রেপ্তারের পর এবং পুলিশের নিরাপত্তা দেওয়ার আশ্বাসে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে, জানান ওয়ানি।
‘পহেলগাম সবকিছু বদলে দিয়েছে’
কাশ্মীরি মুসলমানদের উপর হামলার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর জম্মু ও কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লাহ অন্যান্য রাজ্য সরকারগুলিকে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
“ভারতের মানুষকে বলছি—কাশ্মীরিদের শত্রু ভাববেন না। তারা এই হামলার পক্ষে নয়,” বলেন তিনি।
২০১৯ সালে নয়াদিল্লি কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করে। ওমর আবদুল্লাহ ২০২৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করলেও, তার প্রশাসনের ক্ষমতা সীমিত, নিয়ন্ত্রণ এখনও কেন্দ্রের হাতে।
দক্ষিণ কাশ্মীরের উমর প্যারে জম্মুতে ফার্মেসি পড়ছেন। তিনি জানান, “পহেলগামের আগে সব ঠিকঠাক ছিল, এখন আর স্বাভাবিকভাবে বাইরে বের হওয়া যায় না।”
হামলার পর বাইকে চড়ে “জয় শ্রীরাম” স্লোগান দিতে দিতে ঘুরে বেড়ানো উগ্রপন্থীদের দেখে প্যারে ভীত হয়ে পড়েন। তার গলিতেই কাশ্মীরি ছাত্রদের মারধরের ভিডিও ভাইরাল হয়।
“এমন দৃশ্য আগে কখনও দেখিনি,” বলেন তিনি।
সূত্র : আল জাজিরা