ভারত, ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, অপারেশন সিঁদুর, সম্পাদকের বাছাই,

পাকিস্তানের কাছে ধরাশায়ী মোদি, প্রভাব ফেলবে তার আগ্রাসী নীতিতে?

দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। সম্প্রতি পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত উত্তেজনা, কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে সামরিক অবনমন এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ভারতের কিছু ব্যর্থতা মোদি প্রশাসনের আত্মবিশ্বাসে বড় ধাক্কা দিয়েছে। ফলে প্রশ্ন উঠছে, দীর্ঘদিন যাবত উপমহাদেশে ‘ত্রিশূল’ প্রতীকের আধিপত্য কায়েম রাখা ভারত কি এবার তার দম্ভ ও ধমকের জোর হারাতে বসেছে?

এই প্রশ্নের উত্তর শুধু ভারত বা পাকিস্তানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর বহুলাংশে নির্ভর করছে বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ, ভৌগোলিকভাবে কৌশলগত এবং রাজনৈতিকভাবে অনিশ্চিত একটি দেশের কূটনৈতিক দূরদর্শিতার ওপর।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার গত এক দশকে দেশটির সামরিক সক্ষমতা, কূটনৈতিক দাপট এবং ‘অখণ্ড ভারত’ নীতিকে সামনে রেখে একরকম ভয় দেখিয়ে, কখনো একচেটিয়া প্রভাব খাটিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোকে চাপে রেখেছিল। বিশেষত বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান এমনকি মালদ্বীপের মতো ছোট দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নানা উপায়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ বহুবার উঠেছে।

তবে সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনায় ভারতের সেই আগ্রাসী ও একাধিপত্যমূলক অবস্থানের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে গেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত উত্তেজনায় ভারতের সামরিক বাহিনীর কৌশলগত ব্যর্থতা, কাশ্মীর নীতির আন্তর্জাতিক সমালোচনা, পশ্চিমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা সম্পর্কের টানাপোড়েন, সব মিলিয়ে একটি ভিন্ন বাস্তবতা তৈরি হয়েছে।

উপমহাদেশের রাজনীতিতে ভারতীয় আধিপত্য একধরনের ‘ধমকের কূটনীতি’তে পরিণত হয়েছিল। প্রতিবেশী সরকার পরিবর্তনে গোপন সমর্থন, অভ্যন্তরীণ নীতিনির্ধারণে চাপ প্রয়োগ, পানি ও সীমান্ত প্রশ্নে অস্পষ্ট অবস্থান—এসব কৌশলের জোরেই দিল্লি নিজের কর্তৃত্ব ধরে রেখেছিল। এখন সেই কর্তৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হলে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর সামনে এক নতুন সম্ভাবনার জানালা খুলে যেতে পারে।

তবে প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশ কি এই মুহূর্তে সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর মতো রাজনৈতিক ঐক্য, কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও বাস্তব বিশ্লেষণ শক্তি রাখে?

রাজনৈতিক দলগুলোর গলার স্বরে সাম্প্রতিক কিছু পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলছে। বিশেষত, ভারতের প্রতি অতীতের অতিরিক্ত নির্ভরতা ও অনুগত সুর কিছুটা বদলাচ্ছে। বিভিন্ন মহল থেকে ‘ইন্টেরিম পলিসি’, ‘স্বার্থভিত্তিক ব্যালান্স’ এবং ‘কৌশলগত স্বাধীনতা’র কথা উঠে আসছে। এসবই আলামত যে রাজনীতিতে ভারসাম্যের নতুন বোধ জেগে উঠছে।

ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ধর্মীয় প্রতীকী রাজনীতির বিস্তার ছিল মোদি সরকারের অন্যতম কৌশল। ‘সিন্দুর’, ‘ত্রিশূল’ কিংবা ‘রাম মন্দির’—এসবই একটি বৃহত্তর ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক প্রকল্প। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এসব প্রতীকের আড়ালে বাস্তবিক উন্নয়ন, নিরাপত্তা এবং কূটনীতির দৈন্য ঢেকে রাখা সম্ভব নয়।

বিজেপির এই প্রতীকী রাজনীতি এখন তার নিজের ঘাড়েই ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আঞ্চলিক কূটনীতিতে যেখানে প্রভাব ছিল মুসলিমবিরোধী বক্তব্য, এখন আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে সেই অবস্থান পরিবর্তনে বাধ্য হচ্ছে দিল্লি। কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে বিশ্ব মঞ্চে ভারতকে বেশ কয়েকবার অস্বস্তিকর অবস্থানে পড়তে হয়েছে। ফলে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এই ‘সিন্দুর নীতি’র ভবিষ্যত নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

এই ভূরাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জন্য করণীয় এখনই নির্ধারণ করা জরুরি। এই মুহূর্তে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র—তিনটি প্রধান শক্তির প্রভাব বলয়ের মাঝে বাংলাদেশ অবস্থান করছে। এমন একটি পরিবেশে কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রেখে ‘কোনো পক্ষের পূর্ণ অনুগামী না হয়ে’ বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া সময়ের দাবি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, সীমান্ত নিরাপত্তা, অভিবাসন সমস্যা, নদীর পানি বণ্টন, ট্রানজিট, বাণিজ্য ও জ্বালানিখাতে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ চুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় আধিপত্য মোকাবিলাই হতে পারে প্রথম ধাপ।

সামনে জাতীয় নির্বাচন। এই সময়ে বিদেশি প্রভাব নিয়ন্ত্রণে রাখার পাশাপাশি জনমতকেও বুঝতে হবে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর। কারণ জনগণও এখন অনেক বেশি সচেতন ও সংবেদনশীল এসব আঞ্চলিক শক্তি-পরিবর্তনের প্রভাব বিষয়ে।

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারতের আধিপত্য একসময় এক অপরিহার্য বাস্তবতা ছিল। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা আর নিশ্চয়তা নয়। এখন সময় বাংলাদেশের কূটনৈতিক কণ্ঠস্বরকে শক্তিশালী করে তুলবার—স্বাধীন, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একটি রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার।

যদি আমরা এই মুহূর্তে কৌশলগত স্থিরতা ও সাহসিকতা দেখাতে পারি, তাহলে শুধু ভারতের নয়—পুরো উপমহাদেশের ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান নতুন করে সংজ্ঞায়িত হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top