টুডেনিউজ বিডি ডটনেট
পৃথিবী একটি দারুল আসবাব—একটি কারণনির্ভর জগত। এখানে প্রতিটি ঘটনার পিছনে কোনো না কোনো উপাদান, প্রক্রিয়া বা ব্যাখ্যা রয়েছে, যা মানব বোধ ও বিচারবুদ্ধির আলোকে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যারূপে প্রতিভাত হয়। যেমন, প্রকৃতির পরিবর্তনকে আমরা মৌসুম বা জলবায়ুর কারণে সহজেই বুঝতে পারি। এই রীতিনীতিই দুনিয়ায় জবাবদিহি, ন্যায়বিচার ও দায়বদ্ধতার ভিত্তি তৈরি করেছে। ফলে আমরা নির্দিষ্ট ঘটনার জন্য নির্দিষ্ট দায় নির্ধারণ করতে পারি এবং একটি সামাজিক ভারসাম্য গড়ে উঠেছে।
আল্লাহ এই নিখুঁত দারুল আসবাব নীতি মানব সমাজের কল্যাণের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু অনেকেই বাহ্যিক ব্যাখ্যা পেলেই সেটাকেই চূড়ান্ত ধরে নেয়। তারা ‘কেন’ বা ‘কোথা থেকে’ প্রশ্ন না করে শুধু ‘কীভাবে’ প্রশ্নের সীমিত উত্তরেই সন্তুষ্ট থাকে। কিন্তু বস্তুগত ব্যাখ্যা সবসময় পূর্ণ সমাধান দেয় না। কারণ এসব ব্যাখ্যা শুধুমাত্র বাহ্যিক উপাদান বা প্রক্রিয়ার প্রথম স্তরে গিয়ে থেমে যায়। অথচ সেই উপাদানগুলোও এক অনন্ত শৃঙ্খলের অংশ, যার সূচনা হয়েছে এক অদৃশ্য, অলৌকিক কুদরতি শক্তি থেকে—যা একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসতে পারে।
এই কারণেই বলা যায়, আল্লাহ আমাদের অগোচরে কুদরতি সাহায্য সবসময় প্রস্তুত করে রাখেন। আমাদের কর্তব্য হলো, সেই কুদরতি সাহায্যের বাহ্যিক উপকরণ—সবব—সঠিকভাবে ব্যবহার করা এবং মুসব্বব (ফলাফল) তৈরি করা। যেমন, মাটির নিচে ফসল আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন, কিন্তু ফসল উৎপন্ন করতে হলে আমাদের সঠিক সময়ে বীজ বপন ও পরিচর্যা করতে হয়। কেবল মাটির ওপর বসে উপবাস করলে রিজিক আসবে না।
এই একই নিয়ম হক ও বাতিলের সংঘাতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন, বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের জুলুম থেকে মুক্ত করতে আল্লাহ সরাসরি হস্তক্ষেপ না করে মুসা (আ.)-কে সবব বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন। ইউসুফ (আ.)-কেও কূপ থেকে অলৌকিকভাবে নয়, বরং ব্যবসায়ী ও রাজকীয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মিশরের শাসক বানানো হয়েছিল। একটি ঘটনার সাথে অন্য একটি ঘটনার সূক্ষ্ম সম্পর্কই আল্লাহর দারুল আসবাব নীতির নিদর্শন।
সরাসরি আসমানি সাহায্য আসে কখন? বদরের যুদ্ধেই তার নিদর্শন পাওয়া যায়। সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রাসূলুল্লাহ ﷺ-ও যুদ্ধ করেছেন, পরিশ্রম করেছেন, কৌশল অবলম্বন করেছেন। তারপর আল্লাহ আসমানি সাহায্য পাঠিয়েছেন, যখন রাসূল ﷺ ও সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের সক্ষমতার সবটুকু দিয়ে দিয়েছে এবং তাঁদের অন্তরের ইখলাস পূর্ণতা পেয়েছে। সাহাবিদের এক-চতুর্থাংশ শহিদ হয়েও গেছেন, কারণ আল্লাহর নিয়ম দুনিয়ায় বদলায় না।
ফিরে তাকালে, আজকের মুসলিম উম্মাহ কি সেই সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ও ইখলাসের কাছাকাছিও যেতে পেরেছে? এখনও মুসলিম দেশগুলোতে কোকাকোলা, পেপসি, ম্যাকডোনাল্ডস ও কেএফসি সমানভাবে চলছে। এই অবহেলা ও বিলাসিতা কি আমাদের আসমানি সাহায্য পাওয়ার উপযুক্ত করে তুলেছে? গাজাবাসী সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও আমরা বাকি মুসলিম উম্মাহ নিজেদের গাফিলতি দিয়ে সেই দরজাকে বন্ধ করে রেখেছি।
وَإِنِ اسْتَنصَرُوكُمْ فِي الدِّينِ فَعَلَيْكُمُ النَّصْرُ- এই আয়াতে আল্লাহ আমাদের জন্যও দায়িত্ব নির্ধারণ করেছেন। সুতরাং ফিলিস্তিনের ওপর হামলার জন্য যেমন ইসরায়েল দায়ী, তেমনি আমাদেরও এক অংশ দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। ফিলিস্তিনিদের শাহাদাত তাদের পুরস্কার হলেও, আমাদের জন্য তা অভিশাপ—কারণ আমরা নিজেরা সেই দায় মাথায় নিয়েও নির্লিপ্ত।
আল্লাহ দুনিয়ার দারুল আসবাব নিয়ম অনুসারে আমাদের মধ্যেই এই সমস্যার সমাধান রেখেছেন। তা জানতে চাইলে আঙ্গুল তুললেই দেখা যাবে—আরব বিশ্বের দিকে। বিশ্ববাজারে মুসলিমদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো খনিজ সম্পদ, বিশেষ করে আরব দেশগুলোর হাতে থাকা তেল ও গ্যাস। এই সম্পদ তাদের বিলাসিতার জন্য নয়, বরং কাফেরদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে কুদরতি উপহার। আল্লাহ আজকের যুগে মুসলমানদের এমন আসবাব দিয়েছেন, যা বদরের ময়দানে সাহাবিদের ছিল না।
এখন সময় এসেছে এই আসবাবগুলো কাজে লাগানোর। বিশ্ববাজারে আরব দেশের অবস্থান দিয়ে আমেরিকা ও ইসরায়েলকে চাপে ফেলা সম্ভব। কূটনৈতিক বয়কট, অর্থনৈতিক প্রতিরোধ আর রাজনৈতিক কৌশলের মাধ্যমেই ইয়াহুদিদের থামিয়ে দেওয়া সম্ভব। তখনই বাহ্যিক আসবাবের পরিণতিতে আসমানি সাহায্য আসবে—কারণ, সবব ফুরিয়ে গেলে তবেই মুসব্বব আসবে। না হলে আমরা কেবল দুর্বল আত্মপ্রবঞ্চনা নিয়ে অভিশপ্ত হয়ে যাব, আর মসজিদে আকসা হয়ে উঠবে ইয়াহুদিদের স্বপ্নের থার্ড টেম্পল।