ইরান, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল, ফোরদো পারমাণবিক স্থাপনা

ফোরদোয় মার্কিন হামলা : ইরানের পরমাণু সক্ষমতা ধ্বংস, নাকি ইসরাইলকে যুদ্ধ থেকে সরিয়ে আনার কৌশল?

সৈয়দ মূসা রেজা

ইরানের বার্তা সংস্থা তাসনিম পলিটিক্যাল গ্রুপে খবরে এ প্রশ্নটিই তুলেছেন আবদুল্লাহ আব্দোল্লাহি। তিনি আরো বলেছেন, রোববার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছেন, তারা ইরানের নাতাঞ্জ, ইসফাহান ও ফোর্ডো পরমাণু স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এক বার্তায় তিনি দাবিও করেছেন, ফোরদো ধ্বংস হয়ে গেছে।

নাতাঞ্জে হামলা, তা নাশকতা হোক কিংবা সামরিক হামলা, নতুন কিছু নয়। গত ১০ দিনেও একাধিকবার নাতাঞ্জের স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে দখলদার ইসরাইল। তবে ফোরদোর নাম এবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে। কারণ, ফোরদো হলো একটি উচ্চ-নিরাপত্তার চাদরে আচ্ছাদিত ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক কেন্দ্র। এই কেন্দ্রের গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের কাছে অপরিসীম।

এই হামলার বিশ্লেষণ করতে গেলে কিছু ‘বাস্তববাদী’ বিষয় মাথায় রাখার প্রয়োজন রয়েছে। প্রথমত, বাঙ্কার-বাস্টিং বোমা ব্যবহার করে হামলা চালানো হলে নিঃসন্দেহে কিছুটা ক্ষতি হবেই। এর আগে, নাতাঞ্জে এমনি ক্ষতি হয়েছিল স্টাক্সনেট নামের ম্যালওয়্যার হামলায়। বা সেখানে স্থাপনা উড়িয়ে দিয়ে। তবে আসল প্রশ্ন হলো, এই হামলার ‘কৌশলগত প্রভাব’ কতটা?

যদি এই বোমা হামলা ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা একেবারে ধ্বংস করে দেয়, তবে নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের উদ্দেশ্য সফল। কিন্তু বিষয়টা এতটা সহজ নয়। কারণ, পারমাণবিক শক্তির পেছনে তিনটি প্রধান স্তম্ভ থাকে, ‘জ্ঞান’, ‘প্রযুক্তি’ ও ‘স্থাপনা’। এছাড়া, পারমাণবিক কর্মক্ষমতা নির্ভর করে সমৃদ্ধ উপকরণ এবং যন্ত্রপাতির ওপরও।
এখানেই মূল তফাৎ। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারাও একাধিকবার স্বীকার করেছেন, যদি কোনো দেশের জ্ঞান বা মেধা নিজস্ব হয়, তবে তা বোমা মেরে ধ্বংস করা সম্ভব নয়। ২০০৯ সাল থেকেই ইসরাইল চেষ্টা করেছে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করতে। শহীদ আলি মোহাম্মাদির মতো বিজ্ঞানীদের হত্যার মাধ্যমে এই হীন তৎপরতার শুরু। কিন্তু যদি বিজ্ঞানী হত্যা করলেই পারমাণবিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেত, তাহলে আজকের দিনে মার্কিন এই বিমান হামলার দরকারই পড়ত না।

প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ইরানের যে সেন্ট্রিফিউজ আছে, সেগুলো পুরোটাই দেশীয়ভাবে তৈরি। নিজেদের সম্পদ। একসময় স্টাক্সনেট ভাইরাস কিছু সেন্ট্রিফিউজ নষ্ট করেছিল ঠিকই, কিন্তু তাতে কর্মসূচি ধ্বংস হয়নি। আজকের ইরান যে সেন্ট্রিফিউজ ব্যবহার করছে, সেগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা সেই পুরনো সেন্ট্রিফিউজগুলোর চেয়ে ৫০ গুণ বেশি।

আর সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মতো উপকরণ? চিত্র ও তথ্য বলছে, ইরান এরইমধ্যে এই ধরনের উপকরণ বিভিন্ন জায়গায় সরিয়ে নিয়েছে। তাই এ বিষয়ে ক্ষতির সম্ভাবনাও সীমিত।

সুতরাং ফোরদে এই বোমা হামলায় ক্ষতি যে হয়নি তা নয়, কিন্তু একটি কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র যাকে ‘পরমাণু শক্তির ধ্বংস’ বলে দাবি করছে, তা আজ আর সম্ভব নয়। ইরান এই পর্যায় বহু আগেই পার হয়ে এসেছে। যদিও ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত হিসাব জানতে কিছুটা সময় লাগবে। যেসব দেশ হামলা চালিয়েছে তারা স্বভাবতই নিজেদের লক্ষ্যপূরণের দাবি করবে, তবে সত্যিকারের চিত্র জানতে হলে আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে।

তাহলে প্রশ্ন, যদি পরমাণু কর্মক্ষমতা ধ্বংস সম্ভব না হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র কেন এই হামলা চালাল? প্রথম কারণটি প্রতীকী, ফোরদো নামটি আমেরিকার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তারা বিশ্বকে দেখাতে চায় যে ওয়াশিংটন এই কেন্দ্র আঘাত করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আরো একটি কারণ আছে, যেটি এখন ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে, ইসরাইলকে যুদ্ধ থেকে বের করে আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র একটি কৌশলগত ‘জয়’ উপহার দিতে চায়।

ইসরাইলের জন্য এখন প্রয়োজন এই চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে নিজেকে সরিয়ে আনার একটি ‘বড় সাফল্য’ ঘোষণা করা। ‘ফোরদো ধ্বংস হয়ে গেছে’ এমন দাবি করলে তারা বলতে পারবে, ইরানের পরমাণু স্থাপনাগুলোকেই তারা গুঁড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইসরাইলের চেয়ে এই সত্য আর কেউ ভালো জানে না যে ইরানের পরমাণু শক্তিকে সত্যিকার অর্থে ধ্বংস করা সম্ভব নয়।

তবে এই কথাও ভুলে গেলে চলবে না, একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ফোরদোসহ অন্যান্য পরমাণু স্থাপনাগুলোতে যেভাবে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে, তা হালকাভাবে নেয়া উচিত নয়। আবার অন্যদিকে এটাকে যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইলের লক্ষ্যপূরণ বলেও ধরে নেয়া চলবে না। বহু বছর আগেই ওবামা সরাসরি ইসরাইলকে জানিয়েছিলেন, ‘ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ধ্বংসের প্রকৃত কোনো সামরিক বিকল্প নেই।’ অথচ তখনো যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বাঙ্কার-বাস্টার বোমা ছিল।

সুতরাং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, অপক্ষপাতদুষ্ট একটি জবাব দেয়া। প্রতিপক্ষ যদি নাটক করে, বাহাদুরি দেখায়, তাতে কিছু আসে-যায় না। কিন্তু ইরানের প্রতিক্রিয়া হতে হবে বাস্তব, নির্ভেজাল এবং শক্তিশালী।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top