টুডেনিউজ বিডি ডটনেট
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন এসেছে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক রদবদল ও বৈশ্বিক অস্থিরতার পটভূমিতে, দেশটি ‘পূর্ব দিকে তাকানো’ নীতি গ্রহণ করছে। দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আঞ্চলিক সংযোগ ও কৌশলগত বহুমুখিতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংগঠন (আসিয়ান)-এ যোগদানের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছে। এখন প্রশ্ন শুধু বাংলাদেশ প্রস্তুত কিনা, তাতে নয়; বরং আসিয়ানও কি তার দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীকে গ্রহণের জন্য প্রস্তুত?
আসিয়ানের বাজার বিশাল- ৬৮০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের আবাসস্থল, যার সম্মিলিত জিডিপি ৪.৫ ট্রিলিয়ন ডলারেরও অধিক। বৃহৎ শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাঝে এই ব্লক একপ্রকার রক্ষাকবচের ভূমিকা পালন করে এবং ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক রূপান্তর ও আঞ্চলিক সহযোগিতার সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে দ্বিতীয়বার মুক্তি অর্জনকারী, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সাথে লড়াইরত এবং ঐতিহ্যবাহী অংশীদারদের সাথে টানাপোড়েনের সম্মুখীন বাংলাদেশ জন্য আসিয়ান এক কৌশলগত সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
আসিয়ান বাংলাদেশকে নতুন প্রবৃদ্ধির দিগন্ত উন্মোচনে সহায়তা করতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৮৫ শতাংশেরও বেশি রফতানি তৈরি পোশাক খাতনির্ভর, যা মূলত ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাকেন্দ্রিক। কিন্তু বৈশ্বিক পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে। পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বাংলাদেশ তার অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধাগুলো হারাতে পারে। ফলে রফতানিতে ৭ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত পতন ঘটতে পারে। এই বাস্তবতায় আসিয়ানের দিকে ঝুঁকে পড়া শুধু আকাঙ্ক্ষিত নয়, বরং অপরিহার্য।
আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রগুলো ইতোমধ্যেই বাণিজ্য উদারীকরণ, প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ ও বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে সংযুক্ত হয়ে নিজেদের অর্থনীতিকে পুনর্গঠিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ভিয়েতনাম আসিয়ান ও আঞ্চলিক ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব (আরসিইপি)-এর সক্রিয় সদস্য হওয়ার সুবাদে ইলেকট্রনিক্স উৎপাদনের কেন্দ্র ও বৈদেশিক বিনিয়োগের অন্যতম প্রধান গন্তব্যে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশও একই ধরনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা লালন করছে। ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃষি-প্রক্রিয়াকরণ শিল্প ইতোমধ্যে পরিপক্বতার এক স্তরে পৌঁছেছে। তবে আঞ্চলিক সংযুক্তির অভাবে এ খাতগুলোর প্রসার ব্যাহত হচ্ছে। আসিয়ানের সদস্যপদ বাংলাদেশকে এই বৃহৎ বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেবে, বাণিজ্য বৈচিত্র্য আনবে এবং বহুপক্ষীয় আলোচনায় শক্তিশালী অবস্থান নিশ্চিত করবে। বাংলাদেশ বাণিজ্য ও শুল্ক কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে, আরসিইপি-এ যোগদান করলে বাংলাদেশের রফতানি ১৭ শতাংশ এবং জিডিপি ০.২৬ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
কৌশলগত সংযোগ ও ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত, যার বঙ্গোপসাগরের প্রতি বিস্তৃত প্রবেশাধিকার রয়েছে। বাংলাদেশ আসিয়ানকে ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে সংযুক্ত করার সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করতে পারে। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর এবং এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের মতো অবকাঠামো প্রকল্প দেশটিকে একটি লজিস্টিক হাবে পরিণত করতে পারে, যা আঞ্চলিক সংযোগ জোরদার করবে এবং সংকীর্ণ সামুদ্রিক পথের ওপর আসিয়ানের নির্ভরতা কমাবে।
এছাড়া আসিয়ানের সদস্যপদ বাংলাদেশকে ভূ-রাজনৈতিকভাবে আরো শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাবে। দেশটি ভারতকেন্দ্রিক কৌশলের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে এবং চীনের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা সুসমন্বিত করতে পারবে। আসিয়ান-নেতৃত্বাধীন প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সাথে কৌশলগত সহযোগিতার সুযোগ পাবে।
তরুণ কর্মশক্তি ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার তরুণ জনগোষ্ঠী, যার ৬৫ শতাংশেরও বেশি ৩৫ বছরের কমবয়সী। আসিয়ান কাঠামোর আওতায় শ্রম গতিশীলতা চুক্তির ফলে কৃষি, নির্মাণ, স্বাস্থ্যসেবা ও আইসিটি খাতে বাংলাদেশের কর্মীরা নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ পেতে পারে। একইসাথে, বাংলাদেশ আসিয়ান সদস্য দেশগুলো থেকে দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সুযোগ গ্রহণ করতে পারবে।
চ্যালেঞ্জসমূহ
রোহিঙ্গা সঙ্কট
বাংলাদেশের আসিয়ানে যোগদানের পথে অন্যতম প্রধান বাধা রোহিঙ্গা সঙ্কট। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের আহ্বান জানিয়ে আসছে, যাতে ২০১৭ সাল থেকে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া ১০ লাখের বেশি শরণার্থীকে ফিরিয়ে নেয়া হয়। তবে, আসিয়ানের ঐক্যমত্যভিত্তিক নীতির কারণে এটি একটি জটিল কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ
আসিয়ানের মুক্ত বাণিজ্য কাঠামোর আওতায় বাংলাদেশের নবীন শিল্পগুলো ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো দেশের সাথে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে পারে। তবে প্রতিযোগিতার আশঙ্কায় পিছিয়ে থাকার পরিবর্তে বাংলাদেশকে গবেষণা ও উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে দেশটি প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত হতে পারে।
আসিয়ানে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি কোনো তাৎক্ষণিক সমাধান নয়। বরং এটি একটি কৌশলগত পদক্ষেপ, যা অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্তিশালী করতে পারে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশ আসিয়ান ও সার্কের মধ্যে একটি সেতু হতে পারে।’ এর ফলে আসিয়ান এশিয়ার দু’টি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের সংযোগস্থলে এসে দাঁড়াবে এবং বাংলাদেশের জন্য এটি একটি কৌশলগত মাইলফলক হয়ে উঠবে।
তবে উচ্চাকাঙ্ক্ষা যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা সংস্কারের জন্য প্রস্তুত, নেতৃত্ব দিতে সক্ষম এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার সুবিধাভোগী নয়, বরং সক্রিয় অবদানকারী হতে আগ্রহী।
সূত্র : দ্য ডিপ্লোমেট