বাংলাদেশ, টাকা, সম্পাদকের বাছাই, টাকায় মন্দিরের ছবি, ইসলামী ঐতিহ্য,

বাংলাদেশের টাকায় মন্দিরের ছবি নিয়ে কেন বিরোধিতা করছি

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রকাশিত এক নতুন নোটে হিন্দু মন্দিরের ছবি অন্তর্ভুক্ত হওয়াকে কেন্দ্র করে জনমনে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, এটি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং জাতীয় আত্মপরিচয়ের ওপর একটি পরিকল্পিত আঘাত।

প্রথমত, বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ, যেখানে প্রায় ৯০% মানুষ মুসলমান। সুতরাং রাষ্ট্রীয় প্রতীক, পতাকা, সংবিধান কিংবা মুদ্রার মতো প্রতীকী জায়গায় সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় পরিচয়ের প্রতিফলন থাকা খুবই স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। উদাহরণস্বরূপ, ভারত কিংবা ইউরোপীয় দেশগুলোর মুদ্রায় সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও পরিচয়ের প্রতিফলনই দেখা যায়। মুসলিম কিংবা ভিন্নধর্মীয় কোনো চিহ্ন সেসব জায়গায় অনুপস্থিত। ফলে বাংলাদেশের মতো একটি ইসলামী মূল্যবোধ-ভিত্তিক রাষ্ট্রে হঠাৎ করে একটি হিন্দু মন্দিরের ছবি যুক্ত করা বেশিরভাগ মানুষের কাছে অস্বাভাবিক এবং বিতর্কিত বলে বিবেচিত হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসেও ইসলামী চেতনা ও মুসলিম আত্মমর্যাদার বিষয়টি বারবার উঠে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে একটি আত্মপরিচয় রক্ষার লড়াই, যেখানে বাঙালি মুসলমানের সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় অধিকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই রাষ্ট্রের জন্ম ও বিকাশে শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, মসজিদ—এসব চিহ্ন বহু বছর ধরে স্বাভাবিকভাবেই রাষ্ট্রীয় প্রতীকে প্রতিফলিত হয়েছে। অথচ স্বাধীনতার পর এত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর ভিন্নধর্মীয় কেউ এই প্রতীকে অভিযোগ করেননি। ফলে এখন হঠাৎ করে এই ধরনের বিতর্ক তৈরি করা এবং টাকায় মন্দিরের ছবি যুক্ত করা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন উঠছে—এই সাহস কারা পেল? কে বা কারা এর পেছনে প্ররোচক?

তৃতীয়ত, এই ঘটনাকে শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় ইস্যু নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব বলেও দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ভারতীয় প্রভাব সবসময় একটি আলোচিত বিষয়। সাম্প্রতিক সময়ে সেই প্রভাব অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে বলে দাবি করা হলেও, টাকার নোটে মন্দিরের ছবি সংযোজনকে অনেকেই ভারতের হিন্দুত্ববাদী আদর্শের প্রতিফলন বলে মনে করছেন। প্রশ্ন উঠছে, এটি কি সীমান্তের ওপার থেকে কোনো বার্তা পাঠানোর চেষ্টা? বিশেষ করে যখন জানা যায়, সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীতে একটি নাস্তিক ও ইসলামবিদ্বেষী গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরেই সক্রিয় রয়েছে, তখন সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়—এটি কি তাদের কোনো সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র?

সংশ্লিষ্ট মহলের দাবি, এটি নিছক কাকতালীয় নয়, বরং একটি পরিকল্পিত এবং দীর্ঘমেয়াদি নকশা—যার লক্ষ্য বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজের আত্মপরিচয় মুছে ফেলা এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মাধ্যমে এক ধরনের ‘সামাজিক রূপান্তর’ চাপিয়ে দেওয়া।

এই প্রেক্ষাপটে বিরোধিতাকারীরা জোরালোভাবে দাবি করছেন, টাকার নোট থেকে মন্দিরের ছবি অবিলম্বে বাদ দিতে হবে এবং এই সিদ্ধান্তে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত, তাদের পরিচয় প্রকাশ করে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তাদের মতে, এটি শুধুই একটি নোটের ছবি নয়—এটি একটি রাষ্ট্রের দর্শন, সংস্কৃতি, এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় পরিচয়ের প্রতিফলন। এই আত্মপরিচয়ের উপর কোনো আঘাত বরদাস্ত করা হবে না বলেও তারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন।

বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম প্রধান দেশে রাষ্ট্রীয় প্রতীকে ইসলামী ঐতিহ্য ও পরিচয়ের প্রতিফলন থাকা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি এ ধরনের সিদ্ধান্তকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি হওয়া অনিবার্য। একে একপেশে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে চাপিয়ে দেওয়া সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হিসেবে দেখছেন দেশের এক বিশাল জনগোষ্ঠী। ফলে জাতীয় ঐক্য ও ধর্মীয় সংবেদনশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবনা-পর্যালোচনার প্রয়োজন অনস্বীকার্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top