বাংলাদেশে ইসলাম

বাংলাদেশে ইসলামের আগমন : জলপথে নাকি স্থলপথে

আহমেদ নিঝুম

বাংলাদেশে ইসলামের আগমন ও প্রসারের পথ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রশ্ন আলোচনায় রয়েছে: ইসলাম কি প্রধানত স্থলপথে, না সমুদ্রপথে বাংলাদেশে এসেছে? বিশেষত, এই প্রশ্নের এক জনপ্রিয় উত্তর হল—বাংলাদেশ যেহেতু হানাফি মাজহাব অধ্যুষিত, তাই এখানে সমুদ্রপথে ইসলাম ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়নি। কারণ, দক্ষিণ আরবীয় উপকূল—যেখান থেকে সমুদ্রপথে ইসলাম প্রসার ঘটেছিল—সেসব অঞ্চলে শাফেয়ি মাজহাবের প্রভাব ছিল। এই যুক্তির ভিত্তিতে কেরালা, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপের মত শাফেয়ি অধ্যুষিত উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর সাথে বাংলাদেশের পার্থক্য তুলে ধরা হয়।

তবে এ যুক্তির ঐতিহাসিক ভেতরগহনতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এই ধরণের সরলীকরণ বাস্তব ইতিহাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ইতিহাসের বৃহৎ প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, ইসলাম শুধুমাত্র স্থলপথে নয়, বরং সমুদ্রপথেও বাংলাদেশে এসেছে। তবে জলপথে আগত ইসলামের বাহকরা কেন কেরালার মত শাফেয়ি প্রভাব ফেলতে পারেননি, তা বোঝার জন্য আমাদের ইসলামি ইতিহাসের ভেতরে প্রবেশ করতে হবে।

১. বৃহত্তর ইয়েমেন ও হানাফি প্রভাব

সমুদ্রপথে যেসব আরব বণিক, সুফি ও দাঈরা উপমহাদেশে আসতেন, তাদের অনেকেই ছিলেন বৃহত্তর ইয়েমেন অঞ্চলের বাসিন্দা। আজকের সৌদি আরব, ইয়েমেন ও ওমানের দক্ষিণাংশ মিলিয়ে যাকে ‘তিহামা’ ও আশেপাশের অঞ্চল বলা হয়—সেখানকার মানুষেরা ইসলামি ইতিহাসের শুরুর দিকে হানাফি মাজহাব গ্রহণ করেন। বিশেষত, নবম শতকের আগে থেকেই সেখানে হানাফিদের দৃঢ় অবস্থান দেখা যায়। কাজেই এই অঞ্চলের মুসলমানরা যদি বাংলার উপকূলে এসে ইসলাম প্রচার করে থাকেন, তাহলে তারা যে শাফেয়ি না হয়ে হানাফি হবেন, তা একেবারেই স্বাভাবিক।

২. মঙ্গলীয় আগ্রাসন ও মধ্যএশিয়ান স্কলারশিপের স্থানান্তর

ঈসায়ী বারোশ শতকের দিকে চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে মধ্যএশিয়ায় ভয়াবহ মঙ্গলীয় ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়। বিশেষত বুখারা, সামরকন্দ, হেরাত, নিশাপুরের মত জ্ঞানকেন্দ্রগুলো মঙ্গোলদের আক্রমণে পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে। এই ধ্বংসযজ্ঞের ফলে মধ্যএশিয়ার অসংখ্য হানাফি আলেম, ফকীহ, ক্বারী ও মুফাসসির হিজরত করতে বাধ্য হন। তাদের একটি বড় অংশ দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে দিল্লি সালতানাতের ছায়ায় এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন।

এ ঘটনাকে আমরা ‘ব্রেইন-ড্রেইন’ বললেও, এর মধ্য দিয়ে হানাফি মাজহাবের চিন্তা-চর্চা এবং ইনটেলেকচুয়াল নেতৃত্ব স্থায়ীভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় স্থানান্তরিত হয়। এই অভিবাসনের ফলে হানাফি মাজহাব এখানে মূলধারার ইসলামি চিন্তারূপে প্রতিষ্ঠা পায়।

৩. শাফেয়ি প্রভাব ও উপমহাদেশে তাদের ঐতিহ্য

তবে এই ইতিহাসের ভেতরেও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক লক্ষণীয়—ভারতবর্ষে শাফেয়ি স্কলারশিপও কখনোই অনুপস্থিত ছিল না। হযরত ইমাম নববী (রহ.), ইমাম ইবন হাজার আল-আসকালানী (রহ.)-এর মত শাফেয়ি মুহাদ্দিসদের প্রভাব ভারতবর্ষের মুহাদ্দিসদের উপর প্রবলভাবে পড়েছিল। বিশেষ করে, হাদীসচর্চা ও তাযকিয়া বিষয়ক চিন্তায় শাফেয়ি আলেমদের গভীর প্রভাব লক্ষণীয়।

আল্লামা আব্দুল হাই হাসানি তার ‘নুযহাতুল খাওয়াতির’ গ্রন্থে হিন্দুস্থানে শাফেয়ি আলেমদের বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। এসব ঐতিহাসিক প্রমাণের আলোকে বলা যায়, স্থলপথে আগত আলেমদের ভেতরেও বিভিন্ন মাজহাবের অনুসারী ছিলেন।

এমনকি, একটি ঐতিহাসিক অনুমান অনুযায়ী, অনেক শাফেয়ি আলেম পরবর্তীতে আহলে হাদিস ধারায় যুক্ত হন, কারণ হাদীসপ্রধান চিন্তাধারার সাথে শাফেয়ি মাযহাবের একটা অন্তর্নিহিত মিল রয়েছে।

৪. মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, কেরালায় শাফেয়ি প্রাধান্য

যেসব অঞ্চলে শাফেয়ি মাজহাব প্রভাব বিস্তার করেছে—মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, কেরালা—সেগুলোতে মধ্যএশীয় হানাফি স্কলারশিপ কখনো পৌঁছায়নি। ফলে বৃহত্তর ইয়েমেন থেকে আগত শাফেয়ি দাঈরা সেখানে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হন। অপরদিকে, বাংলায় সেই সময় হানাফি স্কলারশিপ ইতোমধ্যেই শক্ত ভিত্তি গড়ে ফেলেছিল। এই কারণে ইয়েমেনি শাফেয়িদের পক্ষে বাংলায় প্রভাব বিস্তার করা কঠিন হয়ে পড়ে।

৫. ইতিহাসবিরোধী যুক্তির সমালোচনা

বাংলাদেশে হানাফি মাজহাবের প্রাধান্য মানেই যে ইসলাম শুধুমাত্র স্থলপথেই এসেছে—এই সিদ্ধান্ত নিছকই একটি লজিক্যাল ফলাসি। ইতিহাস বলে, সমুদ্রপথে ইসলাম এসেছিল; তবে সেই পথের দাঈরা ছিলেন হানাফি। আবার, স্থলপথেও বিভিন্ন মাজহাবের আলেম এসেছেন। কাজেই শুধুমাত্র মাজহাব দিয়ে ইসলামের আগমনপথ নির্ধারণ করা অনৈতিহাসিক।

বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস একপথী নয়—বরং বহু পথী। স্থলপথের পাশাপাশি সমুদ্রপথেও ইসলাম এসেছিল। তবে শাফেয়ি মাজহাবের প্রভাব বাংলাদেশে কেন কেরালার মত হয়নি—তার ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে ইয়েমেনের প্রাচীন মাজহাব-চরিত্র ও মধ্যএশীয় হানাফি অভিবাসনের ভেতরে।

ইতিহাসের গভীরে না গিয়ে একরৈখিকভাবে ‘হানাফি মানেই স্থলপথ’ কিংবা ‘শাফেয়ি মানেই সমুদ্রপথ’—এমন সরল যুক্তি ইতিহাসতত্ত্বের অবমাননা। একটি দেশের মাজহাবিক চরিত্র বোঝার জন্য কেবল ফিকাহ নয়, রাজনৈতিক, ভৌগোলিক, অভিবাসন ও জ্ঞানচর্চার ইতিহাস—সবকিছুর দিকে তাকাতে হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশে ইসলামের আগমন একটি বহুস্তরীয়, বহুপথী ও জটিল ঐতিহাসিক বাস্তবতা—যা গবেষণার জন্য খোলা এক বিশাল দ্বার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top