মানুষের মানসিক সুস্থতা বৃদ্ধির উপায় হিসেবে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বাইবলিওথেরাপি। তবে এর কার্যকারিতা নির্ভর করে সঠিক বই নির্বাচন এবং ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের ওপর।
২০১৭ সালের গ্রীষ্মে কঠিন সময় পার করছিলেন এলিজাবেথ রাসেল। তিনি কানেকটিকাটের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গ্রন্থাগারিক। তার দুই কিশোরী মেয়ের বিবাহবিচ্ছেদের কঠিন সময় এবং নিজের দীর্ঘমেয়াদি বিষণ্ণতা মিলিয়ে ভীষণ চাপের মধ্যে ছিলেন তিনি। রাসেল বলেন, ‘সত্যিই, তখন খুব চাপের মধ্যে ছিলাম।’
এই সময় তিনি ইন্টারনেটে ‘সৃজনশীল বাইবলিওথেরাপি’ নামে একটি ধারণার সাথে পরিচিত হন। সেখানে কল্পকাহিনী নির্ভর কিছু বই মানসিক উন্নতির জন্য সুপারিশ করা হয়। এ সময় তিনি যুক্তরাজ্যের সাসেক্সে বসবাসকারী বাইবলিওথেরাপিস্ট এলা বার্থাউডের নামের সাথে পরিচিত হন। তিনি ছিলেন The Novel Cure বইটির সহ-লেখক। আগ্রহী রাসেল সাথে সাথে বিষয়টি অনুশীলনে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন।
বার্থাউড প্রথমে রাসেলের পাঠাভ্যাস এবং জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে জানতে চান। পরে তিনি রাসেলকে তার জীবনের প্রেক্ষাপটে উপযোগী কিছু বইয়ের একটি তালিকা পাঠান। এর মধ্যে ন্যান্সি পার্লের George and Lizzie-এর মতো বই ছিল। ওই বইয়ের চরিত্ররা জটিল বৈবাহিক সিদ্ধান্তের মুখোমুখি হয়। রাসেল বলেন, ‘আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।’ কাল্পনিক চরিত্রদের গল্প পড়ে এবং তাদের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে তিনি নিজের অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করতে পেরেছেন। এরপর তার নিজেকে কম একাকী অনুভব হতো। এ বিষয়ে তিনি বলেন, এটা আমার ভেতরে এমন একটি অন্তর্দৃষ্টি সৃষ্টি করেছিল, যা আমার বড্ড প্রয়োজন ছিল।
যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে বাইবলিওথেরাপি জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে। এতে কল্পকাহিনী ছাড়াও নন-ফিকশন এবং স্ব-উন্নয়নধর্মী বইপত্র সুপারিশ করা হয়। এতে মানুষজন সুস্থতা বৃদ্ধি, জীবনসংশ্লিষ্ট কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং কিছু মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার সফল মোকাবেলা করতে সক্ষম হচ্ছে।
যদিও স্ব-উন্নয়নধর্মী বইয়ের উপকারিতা বহু আগেই প্রতিষ্ঠিত। তবে ‘সৃজনশীল বাইবলিওথেরাপির’ সমর্থকেরা কল্পকাহিনীর ক্ষেত্রেও অনুরূপ উপকারের কথা বলছেন। তারা যুক্তি দেন, জীবনের প্রতিফলনধর্মী সমৃদ্ধ কল্পজগতে নিমগ্ন হলে পাঠক আবেগ প্রক্রিয়াকরণ, মোকাবেলার কৌশল আবিষ্কার কিংবা কিছু সময়ের জন্য মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
২০১৬ সালে দ্য ল্যানসেট-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দু’জন গবেষক দাবি করেন, সাহিত্যে নিমগ্ন হওয়া ‘অস্থির মনকে উপশম, পুনরুদ্ধার ও পুনরুজ্জীবিত করতে পারে’ এবং উদ্বেগসহ অন্যান্য মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে। অনেক দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সীমিত সুযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কল্পকাহিনীর এ ধরনের সম্ভাবনা বেশ আকর্ষণীয়।
নাটক, কবিতা বা কল্পকাহিনী যারা পড়েছেন, তারা জানেন, গল্প আবেগ ও মননে গভীর প্রভাব ফেলে। তবে এর মানে এই নয় যে সব ধরনের কল্পকাহিনী সবার মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটায়। এই প্রতিবেদনের জন্য সাক্ষাৎকার দেয়া অনেক বিশেষজ্ঞ এই থেরাপির সম্ভাবনা নিয়ে যতটা না আশাবাদী, তার চেয়ে বেশি সতর্ক। তারা বলেন, নির্দিষ্ট মানসিক অবস্থায় এটির কার্যকারিতা এখনো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়। এমনকি কিছু বই ক্ষতিকরও হতে পারে।
বর্তমান গবেষণাগুলো আরো সূক্ষ্ম এক চিত্র তুলে ধরে। যেখানে দেখা যায়, কল্পকাহিনী সাধারণভাবে সুস্থতা বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। তবে তা নির্ভর করে পাঠক, বই এবং পাঠকের পাঠ-অভিজ্ঞতার ধরণে। লন্ডন ইন্টারডিসিপ্লিনারি স্কুলের কম্পিউটেশনাল কগনিটিভ সায়েন্টিস্ট জেমস কার্নি বলেন, ‘ধারণাটি হচ্ছে বই এমন এক সাংস্কৃতিক বস্তু, যা সব কিছু ভালো করে তুলবে। আমি মনে করি, কিছু নির্দিষ্ট মানসিক অবস্থা এবং কিছু ব্যক্তিত্বের জন্য এটি সত্যি হতে পারে। কিন্তু এটি কোনো সর্বজনীন ওষুধ নয়।’
অনেকে বাইবলিওথেরাপির শিকড় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় খুঁজে পান। ওই সময় সৈন্যদের ট্রমা কমাতে তাদের কল্পকাহিনী ও নন-ফিকশন পড়তে দেয়া হতো। তবে কার্নি বলেন, ১৯৯০-এর দশকে এই ধারণার পুনরুত্থান ঘটে। আজ এটি বিভিন্ন রূপে দেখা যায়। যেমন বার্থাউডের মতো থেরাপিস্টরা প্রতি সেশনে ১০০ পাউন্ড (প্রায় ১৩০ মার্কিন ডলার) ফিতে বইয়ের সুপারিশ দেন। আবার কিছু জিপি যেমন অ্যান্ড্রু শুম্যান তাদের রোগীদের মাঝে ফিকশন পড়ার পরামর্শ দেন। শুম্যান হলেন এনএইচএস চিকিৎসক এবং বাইবলিওথেরাপির দাতব্য সংস্থা রিলিট-এর উপদেষ্টা। তিনিই ২০১৬ সালের ল্যানসেট প্রবন্ধের সহ-লেখক।
শুম্যান বলেন, যদিও ফিকশন-নির্ভর বাইবলিওথেরাপি এককভাবে চিকিৎসার বিকল্প নয়, তবে অন্য থেরাপির সাথে মিলিয়ে এটি শক্তিশালী ও কার্যকর হয়ে উঠতে পারে। রাসেল যোগ করেন, এর একটি বড় সুবিধা হচ্ছে, মানুষ এটি নিজের সময় ও মানসিক প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করে করতে পারে। পাঠক বইয়ের কাছে তখনই যেতে পারেন, যখন তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকেন। আর যদি কখনো অভিভূত বোধ করেন, তখন বইটি বন্ধ রাখাও সম্ভব।
২০১৩ সাল থেকে যুক্তরাজ্যের অলাভজনক সংস্থা দ্য রিডিং এজেন্সির ‘রিডিং ওয়েল’ প্রোগ্রাম ডিমেনশিয়া ও বিষণ্ণতার মতো মানসিক অবস্থার জন্য উপযুক্ত বইয়ের তালিকা তৈরি করে আসছে। এই তালিকাগুলো সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ এবং এসব অবস্থার বাস্তব অভিজ্ঞতা থাকা ব্যক্তিদের সহায়তায় প্রস্তুত করা হয়। সংস্থাটির স্বাস্থ্য ও সুস্থতাবিষয়ক প্রধান জেমা জলি এই তথ্য জানান।
তিনি বলেন, এর লক্ষ্য হলো মানুষকে সত্যিকারভাবে সহায়ক বইয়ের নির্দেশনা দেয়া, বিশেষ করে যখন মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে অসংখ্য বই রয়েছে এবং অনেক সময় ‘ভালো সাহিত্য’ হিসেবে যা প্রচার করা হয়, তা আদতে বিভ্রান্তিকর। ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের স্থানীয় গ্রন্থাগারগুলোর সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রোগ্রামটি চালু হওয়ার পর থেকে ৩.৯ মিলিয়নেরও বেশি বই ঋণের সুযোগ তৈরি করেছে বলে জানান তিনি। এমনকি যুক্তরাজ্যের কিছু স্বাস্থ্য সংস্থা পর্যন্ত বাইবলিওথেরাপির গুরুত্ব বিবেচনায় নিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, খাওয়ার ব্যাধির মতো ক্ষেত্রে কিছু স্ব-সহায়ক বইকে ক্লিনিকাল গাইডলাইনের মধ্যে থেরাপিউটিক উপকরণ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
তবে যেভাবে কল্পকাহিনীর সুপারিশ সব পাঠকের জন্য উপযোগী নাও হতে পারে, তেমনি নির্দিষ্ট কোনো মানসিক অবস্থা বা জীবনের পর্যায়ের জন্য প্রণীত স্ব-সহায়ক বইও সবার উপকারে নাও আসতে পারে। যদি কারো নির্দিষ্ট স্বাস্থ্যসংক্রান্ত উদ্বেগ থাকে, তাহলে অবশ্যই তাদের জিপির পরামর্শ নেয়া উচিত।
তারপরও পাঠ্যাভ্যাস মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে সহায়ক। এই ধারণার পেছনে কিছু জটিল বৈজ্ঞানিক ভিত্তি রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা নিয়মিত আনন্দের জন্য বই পড়েন না, তাদের তুলনায় নিয়মিত পাঠকেরা কম চাপ অনুভব করেন। তারাই বিষণ্ণতা ও একাকীত্বে ভোগেন কম এবং সামাজিকভাবে বেশি সংযুক্ত ও আত্মবিশ্বাসী হন। এমনকি তারা দীর্ঘজীবীও হতে পারেন। যুক্তরাজ্যের সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী গিউলিয়া পোয়েরিও ২০২০ সালের এক প্রবন্ধে এভাবেই ব্যাখ্যা করেন। তবে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলেন, আসলে কি গল্পপাঠ সুস্থতা উন্নত করে, নাকি যারা আগে থেকেই সুস্থ, তারাই বেশি গল্প পড়ে?
পোয়েরিও বলেন, স্ব-সহায়ক বইয়ের ক্ষেত্রে সুবিধাগুলো তুলনামূলকভাবে স্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, স্ব-সহায়ক বই উদ্বেগ ও বিষণ্ণতাগ্রস্ত ব্যক্তিদের উপকার করতে পারে। আবার ২০০৬ সালের আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, খাওয়ার ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীদের বিষণ্ণতা, অতিরিক্ত আত্মশুদ্ধির অভ্যাস এবং খারাপ অনুভূতি কমাতে এসব বই অন্যান্য মনস্তাত্ত্বিক থেরাপির মতোই কার্যকর ছিল।
তবে গল্পভিত্তিক সাহিত্য থেকে উপকার পাওয়া কিছুটা জটিল। গবেষণায় দেখা গেছে, বইপাঠ সহানুভূতি বাড়াতে সাহায্য করে, প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব কমায়, মানুষের আচরণে সদাচার বাড়ায় এবং আত্মবিশ্বাস জোগায়। শিশুদের ক্ষেত্রেও আচরণে সামান্য উন্নতি দেখা গেছে, যেমন ছেলেদের মধ্যে আক্রমণাত্মকতা হ্রাস পায়। এটি কিছু নির্দিষ্ট স্বাস্থ্য ও বিকাশগত সমস্যায় আক্রান্ত শিশুদের নিজেদের অনুভূতি প্রকাশে সহায়তা করতে পারে।
তবে নির্দিষ্ট মানসিক সমস্যার সমাধানে গল্পের ভূমিকা এখনো স্পষ্টভাবে প্রমাণিত নয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য গবেষক এমিলি ট্রোসিয়াঙ্কো বলেন, অনেকে মনে করেন, গল্পে নিজের অভিজ্ঞতার মতো চরিত্র সম্পর্কে পড়লে পাঠকের মধ্যে পরিচিতির অনুভব তৈরি হয়। সেই চরিত্র চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করলে পাঠকও নিজ জীবনে তা অনুকরণ করতে পারেন। এটাকে অনেকেই ‘ক্যাথারসিস’-এর অভিজ্ঞতা মনে করেন।
কিন্তু বাস্তবে এটি ঘটে কিনা, তা নিয়ে গবেষণা খুব কম হয়েছে বলে তিনি জানান। ট্রোসিয়াঙ্কো বলেন, ‘আমি মনে করি, এটা আসলে যতটা সরলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, বাস্তবে বিষয়টি তত সহজ নয়। মানুষ যখন নিজের অভিজ্ঞতার মতো কঠিন গল্প পড়ে, তখন ভেতরে যা ঘটে তা অনেক জটিল।’
উপাখ্যানগতভাবে অনেকেই বলেন, গল্প তাদের মানসিক অবস্থায় সহায়তা করেছে। যেমন, দ্য রিডিং এজেন্সির ২০২২ সালের বার্ষিক জরিপে অংশ নেয়া ৮১ শতাংশ মানুষ বলেন, ‘রিডিং ওয়েল’ প্রোগ্রামের বইগুলো তাদের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত চাহিদা বুঝতে সহায়তা করেছে।
জলি বলেন, জরিপে অনেকে এভাবে অনুভূতি প্রকাশ করেছেন যে আমি বুঝতে পেরেছি যে আমি একা নই। কেউ বলেছেন, আমি শিখেছি কিভাবে নিজেকে সাহায্য করতে হয়।
তবে সৃজনশীল বাইবলিওথেরাপি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কার্যকর চিকিৎসা কিনা, তা প্রমাণে প্রতিটি অবস্থার জন্য বড় আকারে গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করেন গবেষক জেমস কার্নি। এসব গবেষণায় উপন্যাসপাঠকারী অংশগ্রহণকারীদের সাথে প্লাসিবো গ্রুপের তুলনা করা দরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিদ্যমান গবেষণা এই মান পূরণ করে না। যেমন, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি)-এর ক্ষেত্রে -যেখানে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন কাল্পনিক জগত রোগীদের আবেগ প্রক্রিয়া করতে সাহায্য করতে পারে- ২০১৭ সালের একটি গবেষণা পর্যালোচনায় দেখা যায়, এখনো উচ্চমানের কোনো গবেষণা এর উপকারিতা যথাযথভাবে প্রমাণ করতে পারেনি।
তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, নির্দিষ্ট ধরণের কল্পকাহিনী মানসিকভাবে ক্ষতির কারণ হতে পারে। ২০১৮ সালে এমিলি ট্রোসিয়াঙ্কো যুক্তরাজ্যের খাওয়ার ব্যাধি বিষয়ক দাতব্য সংস্থা ‘বিট’-এর সাথে যৌথভাবে প্রায় ৯০০ জনের ওপর একটি জরিপ পরিচালনা করেন, যাদের বেশিরভাগই খাদ্যাভ্যাসজনিত ব্যাধিতে ভুগছিলেন। অংশগ্রহণকারীদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কল্পকাহিনীর বই তাদের মেজাজ, আত্মসম্মান, খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের অভ্যাস এবং শরীর সম্পর্কে ধারণার ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে।
যারা খাদ্যাভ্যাসের ব্যাধিযুক্ত চরিত্র রয়েছে এমন বই পড়েছিলেন, ট্রোসিয়াঙ্কোর কাছে বিস্ময়করভাবে বলেছিলেন যে এই পাঠে তাদের উপসর্গ আরো খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘যদি আপনার খাদ্যাভ্যাসের ব্যাধি থাকে, তাহলে অন্তত আপনি বুঝতে পারবেন যে এই ধরনের বই আপনার জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।’ আরো উদ্বেগের বিষয় হলো, প্রায় এক ডজন অংশগ্রহণকারী জানান, তারা সক্রিয়ভাবে এই ধরনের বই খুঁজে বের করেছেন।
ট্রোসিয়াঙ্কোর ধারণা, এই বইগুলো সেই একই অনুভূতিগুলোকে ট্রিগার করে, যেগুলো মূলত খাদ্যাভ্যাসের ব্যাধিকে উৎসাহিত করে যেমন শরীর ও খাদ্যাভ্যাস নিয়ে প্রতিযোগিতার মনোভাব। তার অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে, খাদ্যাভ্যাসে সমস্যাগ্রস্ত ব্যক্তিরা এমন সাহিত্যকর্মে মনোযোগ দিতে পারেন না, যা তাদের সমস্যার সাথে সম্পর্কিত নয়। তার ভাষায়, ‘শেষ পর্যন্ত আপনি যা পড়েন, তার সবকিছুই আপনাকে আরো গভীরভাবে সেই সংকীর্ণ আবেশে টেনে নিয়ে যায়।’
তিনি আরো বলেন, ‘এই কারণেই আমি নিজের অভিজ্ঞতার সাথে সম্পর্কিত বিষয় পড়া সবসময়ই সহায়ক। এই সরল এবং আত্মবিশ্বাসী দৃষ্টিভঙ্গি দেখে হতাশ হই। কারণ, এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে বইটির উপর। সাহিত্য জটিল। মানুষ জটিল। তাহলে এর প্রভাব কেন জটিল ও সূক্ষ্ম হবে না বলে ধরে নেয়া হবে?’
জেমস কার্নির আশঙ্কা, যারা আসক্তির সমস্যায় ভুগছেন, তারা মাদকাসক্ত চরিত্রবিশিষ্ট উপন্যাস পড়ে অনুপ্রাণিত হতে পারেন, যেগুলো প্রায়ই আসক্তিকে রোমাঞ্চকরভাবে উপস্থাপন করে। অন্যদিকে এনএইচএস চিকিৎসক অ্যান্ড্রু শুম্যান জোর দিয়ে বলেন, তিনি কেবল তাদের সাথেই ফিকশন নিয়ে আলোচনা করেন, যাদের তিনি ভালোভাবে চেনেন। মানসিকভাবে অস্থির বা আত্মহত্যার চিন্তায় ভোগা রোগীদের ক্ষেত্রে তিনি কখনো ফিকশন পড়ার পরামর্শ দেন না। কারণ, এটি ক্ষতিকরও হতে পারে। আবার অনুপযুক্ত বা অসহায় বোধেরও জন্ম দিতে পারে। ফলে রোগীদের চিকিৎসকের প্রতি আস্থা কমে যেতে পারে।
জেমা জলি বলেন, ‘রিডিং ওয়েল’ প্রোগ্রাম এসব সূক্ষ্মতা সম্পর্কে সচেতন। উদাহরণস্বরূপ, কিছু অবস্থার কাল্পনিক বিবরণ ক্ষতিকর হতে পারে। এই ধরনের গবেষণার ভিত্তিতে দ্য রিডিং এজেন্সি সাধারণত এমন বইয়ের তালিকা তৈরি করে, যেগুলো মেজাজ উন্নত করতে পারে এবং পাঠকদের মানসিক অবস্থার বাইরে বের হওয়ার জন্য উৎসাহিত করে।
খাওয়ার ব্যাধিতে আক্রান্ত প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ‘রিডিং ওয়েল’-এর তালিকায় কেবল এমন বই রাখা হয়, যেগুলো ব্যবহারিক সহায়তা দেয়। খাদ্যাভ্যাস বা শরীরের চিত্র নিয়ে কাল্পনিক গল্প নয়। তবে কিশোরদের জন্য তৈরি তালিকায় কিছু ব্যক্তিগত গল্পভিত্তিক কল্পকাহিনী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা স্বাস্থ্য পেশাজীবী ও তরুণদের মতামতের ভিত্তিতে বেছে নেয়া হয়েছে। কারণ তারা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ বই পড়তে আগ্রহী।
রিডিং ওয়েল প্রোগ্রামে ডিমেনশিয়াবিষয়ক কল্পকাহিনীও বাদ দেয়া হয়েছে। কারণ কিছু রোগী জানিয়েছেন, তারা বাস্তবভিত্তিক গল্প পছন্দ করেন, যা তাদের অবস্থার সূক্ষ্মতা আরো ভালোভাবে তুলে ধরে।
জলি স্বীকার করেন, ‘বই সবার জন্য সমাধান নয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা সবসময় বলি, এটি সবার জন্য একরকমভাবে কাজ করবে এমন কোনো পদ্ধতি নয়। বরং এটি একটি অতিরিক্ত টুল। কিছু মানুষের জন্য তা কার্যকর হতে পারে।’
এর অর্থ এই নয় যে গল্প বলা কোনো নির্দিষ্ট মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে না। বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের দু’টি ছোট দলের উপর চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে, এক বছর ধরে তারা কবিতা ও গল্পের দলগত পাঠে অংশ নিয়ে মানসিক অবস্থার উন্নতি অনুভব করেছেন। কার্নি মনে করেন, কিছু নির্দিষ্ট ধরনের গল্প উদ্বেগে ভোগা ব্যক্তিদের জন্য উপকারী হতে পারে, বিশেষ করে কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন অনির্দেশ্যতাকে। তিনি পরামর্শ দেন যে ঊনবিংশ শতাব্দীর অনেক শার্লক হোমসধর্মী গল্প যেগুলোর চরিত্র ও কাহিনী পূর্বানুমেয়, পাঠকের জন্য সহায়ক হতে পারে। কারণ এতে আপনি বিশ্বকে প্রমাণ দিয়ে বোঝাতে পারেন যে পৃথিবী পূর্বানুমানযোগ্য।’
নির্দিষ্ট রোগের চিকিৎসার বাইরে গল্প, নাটক বা কবিতা পড়া সাধারণ মানসিক সুস্থতারও উন্নতি ঘটাতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, দীর্ঘস্থায়ী ব্যথায় আক্রান্ত এমন ব্যক্তিরা, যারা যুক্তরাজ্যের দাতব্য সংস্থা ‘দ্য রিডার অর্গানাইজেশন’ আয়োজিত জোরে পঠন কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন, তারা জানিয়েছেন যে এতে তারা ভাগাভাগির অনুভূতি, মেজাজের উন্নতি এবং জীবনের মানের উন্নয়ন অনুভব করেছেন।
এই ধরনের সুস্থতার উন্নতি নির্ভর করে মানুষ বইয়ের সাথে জড়িত থাকার ধরনের ওপর। পোয়েরিওর এক গবেষণায় দেখা গেছে, তিনি ও তার সহকর্মীরা ৯৪ জন প্রবীণকে জনপ্রিয় কল্পকাহিনী ও অ-কল্পকাহিনী বইয়ের তালিকা থেকে নির্বাচিত অডিওবুক শোনান। দুই সপ্তাহ পরও অংশগ্রহণকারীরা জানান যে তাদের মানসিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে এবং তারা তাদের জীবনকে আরো অর্থবহ মনে করছেন। তবে কেবল তারাই, যারা বলেছেন যে তারা বইয়ের সাথে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন ও প্রশংসা করেছেন। পোয়েরিও বলেন, যখন মানুষ বইয়ের বিষয়বস্তুর সাথে আবেগগতভাবে জড়িত থাকে -যেমন এটি তাদেরকে বহন করে, তারা নিমগ্ন বোধ করে, এটি তাদের সাথে অনুরণিত হয়- তখনই আমরা সুস্থতার ইতিবাচক প্রভাব দেখি।
কার্নিও একমত যে শুধু কারো হাতে একটি উপন্যাস ধরিয়ে দিলেই তার উপর প্রভাব পড়ে না। তার গবেষণা দেখায়, বই পড়ার পর সে বিষয়ে চিন্তা করা বিশেষত অন্যদের সাথে আলোচনা করা সুস্থতা বৃদ্ধি করে। তিনি বলেন, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা মানুষকে এমন বিষয় নিয়ে ভাবার সুযোগ দেয়, যা সাধারণত তাদের জন্য কষ্টকর হলেও এতে তাদের উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে না।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, ‘যখন আপনি কল্পকাহিনী পড়েন, আপনি হিথক্লিফ বা তার কর্মকাণ্ড নিয়ে উদ্বিগ্ন হন না। কারণ হিথক্লিফ বাস্তব ব্যক্তি নন। কল্পকাহিনী আপনাকে কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং সামাজিক পরিস্থিতিগুলো নিয়ে নিরাপদভাবে অনুশীলনের সুযোগ দেয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘যদি আপনি এটি অন্যদের সাথে ভাগ করে নিতে পারেন, তবে তা আরো বাস্তব মনে হবে, আরো প্রভাব ফেলবে।’
যারা নিজের জন্য বাইবলিওথেরাপির অনুশীলন করতে চান, তাদের জন্য কার্নির পরামর্শ হলো, কোনো গ্রুপ আলোচনার ক্লাব খুঁজে বের করুন। পাবলিক লাইব্রেরি অনুসন্ধানের পরামর্শও তিনি দেন, যেখানে আপনি বিনামূল্যে অনেক বই পড়তে পারেন। যদি কোনো বই আপনার সাথে অনুরণিত না হয়, তাহলে অন্য বই বেছে নিন, ছোট কিছু চেষ্টা করুন, কিংবা কবিতার মতো ভিন্ন কোনো ধারা পড়ুন। আর যদি পড়া আপনার জন্য উপযুক্ত না হয়, পোয়েরিও বলেন, মানসিক সুস্থতা বাড়ানোর জন্য সঙ্গীত বা চিত্রকলার মতো অন্য মাধ্যমও হতে পারে। শুম্যান বলেন, ‘যদি আপনি অনুভব করেন যে এটি আপনাকে সাহায্য করছে, আপনি উপকার পাচ্ছেন, তাহলে আপনি তা চালিয়ে যেতে চাইবেন। কিন্তু যদি এটি কষ্টদায়ক বা হস্তক্ষেপমূলক মনে হয়, তাহলে আপনার তা থামিয়ে দেয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা উচিত।’
রাসেলের ক্ষেত্রে তিনি বিশ্বাস করেন, বাইবলিওথেরাপি মানসিক সুস্থতার উন্নতির একটি কার্যকর পথ। প্রথম সেশনের পর থেকে তিনি বার্থউডের সাথে একাধিক সেশন করেছেন। তিনি ও তার বন্ধুদের বাইবলিওথেরাপি ভাউচার কিনে দিয়েছেন এবং নিজের ছাত্রদের অভিবাসন, ক্ষতি বা অন্যান্য কষ্টের অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করতে সহায়ক এমন বই বেছে নিতে সাহায্য করছেন। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো, আপনি যেন এতটা একা বোধ না করেন, আপনি যেন একটি গভীর নিঃশ্বাস নিতে পারেন এবং ভাবতে পারেন, আমি একা এই যাত্রায় নই ‘
সূত্র : বিবিসি