বাবরি মসজিদ : বাবর থেকে বিজিপি

মাসুম বিল্লাহ

পানিপথের প্রথম যুদ্ধে ইব্রাহিম লোদীকে পরাজিত করে দিল্লির মসনদে বসেন জহিরুদ্দীন মুহাম্মদ বাবর। সয়ময়টা ১৫১৬ সালের ২১ এপ্রিল।

মুঘল সম্রাট বাবর ক্ষমতায় আসার পর তার আদেশে সেনাপতি মীর বাকী ৯৩৫ হিজরি মুতাবেক ১৫২৮–২৯ সালে ভারতের ফৈজাবাদ জেলার অযোদ্ধা শহরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। সম্রাটের নামের দিকে সম্পৃক্ত করে মসজিদের নাম দেয়া হয় বাবরী মসজিদ।

মসজিদ নির্মাণের পর থেকে দীর্ঘ ৪০০ বছর পর্যন্ত কোনো প্রকার বিতর্ক ছাড়াই বাবরি মসজিদে মুসলিম জনতা যথারীতি নামাজ আদায় করতে থাকে। এই দীর্ঘ সময়ে ঐতিহাসিকভাবে সুপ্রমাণিত প্রমাণের ভিত্তিতে বাবরি মসজিদ নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামার কোনো তথ্য পাওয়া যায় না।

বিবাদের সূচনা
দীর্ঘ চার শতাব্দী ধরে চলে আসা মসজিদ নিয়ে হঠাৎ করে শুরু হলো বিতর্ক। সেসময় ভারতবর্ষে শুরু হয়েছে ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিকতা। আস্তে আস্তে গ্রাস করে নিচ্ছিল মুসলিমদের শাসনাধীন ভারতবর্ষ। তখনও মুঘল সাম্রাজ্যের বাতি নিভু নিভু জ্বলছিল। ঠিক তখন ১৮২২ সালে একজন হিন্দুর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, বাবরি মসজিদ যেখানে নির্মাণ করা হয় সেটা মূলত রামের জন্মস্থান।

হিন্দুদের পুরান, মহাভারতসহ অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থে রামের জন্মস্থান হিসেবে অযোদ্ধার কথা উল্লেখ করা হলেও ঠিক কোন জায়গাটিতে তার জন্ম হয়েছিল সে কথার কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। রামের জন্মস্থানে কোনো মন্দির থাকার বিষয়টিও হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থ ঐতিহাসিক নথিপত্রে পাওয়া যায় না।

এত বছর পর হঠাৎ এই দাবি কেন উঠলো? এর পেছনে মূল কারণ ছিল ব্রিটিশদের কূটকৌশল। ভারতবর্ষের হিন্দু মুসলিম এক হয়ে যেনো ব্রিটিশদেরকে বিতাড়িত করতে উদ্বুদ্ধ না হতে পারে, সে লক্ষ্যে হিন্দু মুসলিম বিভাজন তৈরির জন্যই মূলত এই কাজটি করে ব্রিটিশ বেনিয়ারা।

হিন্দুদের পক্ষ থেকে বাবরি মসজিদের স্থানটি রামের জন্মস্থান হওয়ার দাবি জানানোর পর উক্ত স্থানের দখল নিয়ে ১৮৫৩ অথবা ১৮৫৮ সালে শুরু হয় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা। ধূর্ত ব্রিটিশ বেনিয়ারা সেই দাঙ্গার অবসান না করে খুবই নিপুনভাবে চতুরতার আশ্রয় নেয়। হিন্দু মুসলিম বিবাদকে জিইয়ে রাখার জন্য মসজিদের জায়টিকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দেয়। মসজিদের ভবন এবং তৎসংলগ্ন ভূমিকে মুসলমানদের জন্য দেয়া হয়, আর মসজিদের চত্ত্বরকে দেয়া হয় হিন্দুদের পূজা-অর্চনার জন্য। দুই দলের জন্য নির্ধারিত সীমার মাঝখানে বেড়া দিয়ে দেয়া হয়।

ব্রিটিশ কর্তৃক নির্ধারিত সীমারেখা মেনে হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায় পূজা-নামাজ করে যাচ্ছিল। পরবর্তীতে ১৮৮৫ সালে হিন্দু সন্তদের নেতা মহন্ত রঘুবীর দাস ওই মসজিদ লাগোয়া উঠোনে রামমন্দির নির্মাণের অনুমতি চেয়ে ফৈজাবাদ ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে মামলা করে। কিন্তু আদালত তার মামলা বাতিল করে দেয়।

বাবরি মসজিদ দখলের মিথ্যা ষড়যন্ত্র
এরপর থেকে ধাপে ধাপে বিভিন্ন সময়ে বাবরি মসজিদের জায়গা দখল কেন্দ্র করে হিন্দু মুসলিমদের মাঝে সংঘর্ষ এবং উত্তেজনা চলতে থাকে। সেই বিতর্ক চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে ভারত স্বাধীন হওয়ার দুই বছর পর। ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর রাতের আঁধারে অভিরাম দাস নামে এক তরুণ হিন্দু সন্ন্যাসী বাবরি মসজিদের ভিতরে রামচন্দের মূর্তি রেখে আসে। গবেষক ও লেখক অরিন্দম সেন বলেন, খুব কৌশলে পরিকল্পনা এঁটেই মসজিদের ভেতরে ওই মূর্তি নিয়ে আসা হয়েছিল।

‘মন্দির বিতর্কের পাঁচ দশক’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন,
‘কথিত আবির্ভাবের ঠিক আটদিন আগে থেকে অযোধ্যায় শুরু হয়েছিল রামনাম সংকীর্তন। বলা হয়েছিল, আটদিন সংকীর্তনের শেষে নাকি শ্রীরামচন্দ্র অবির্ভূত হবেন। বাস্তবেও ঠিক সেটাই হলো– আর কোথায় তিনি আবির্ভূত হলেন? একেবারে সোজা মসজিদের ভেতরে!’

পরবর্তীতে মুসলিমরা অভিরাম দাসের বিরুদ্ধে মামলা করলেও হিন্দুপ্রধান বিচারকার্যের কারণে সেই মামলা থেকে নিষ্পত্তি পায় অভিরাম দাস।

‘অযোধ্যা – দ্য ডার্ক নাইট’ নামের গ্রন্থেও ১৯৪৯ সালের ২২/২৩ ডিসেম্বর রাতের সেই নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহের পূর্বাপর বর্ণনা করেছেন অনুসন্ধানী দুই লেখক কৃষ্ণা ঝা ও ধীরেন্দ্র কুমার ঝা।

তাদের গবেষণা বলছে, রামের মূর্তি আবির্ভাবের পরদিন স্থানীয় থানায় যে এফআইআর দায়ের হয়, তাতে মসজিদের ভেতরে ঢুকে মূর্তি রেখে আসার জন্য মূল অভিযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল অভিরাম দাস নামে এক তরুণ হিন্দু সন্ন্যাসীকে। কিন্তু এই ঘটনা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট ছিল যে অভিরাম দাস-ই এই জঘন্য কাজ করেছে। তাই তো পরবর্তীতে তাকে হিন্দুরা ‘রামজন্মভূমি উদ্ধারক’ বা ‘উদ্ধারক বাবা’ উপাধিতে ভূষিত করে। সেই ঘটনার ঠিক ৩২ বছর পরে অভিরাম দাস যখন প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে প্রয়াত হয়, তখন অযোধ্যায় সরযূ নদীতে জলসমাধির সময়ও মুহুর্মুহু আওয়াজ উঠেছিল রামজন্মভূমি উদ্ধারক অমর রহে!

বাবরি মসজিদে মূর্তি রেখে আসার পর ভারতব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এই ঘটনা। সাধারণ হিন্দুদেরকে জানানো হয়, বাবরি মসজিদে রামের মূর্তির আবির্ভাব হয়েছে। হিন্দুদের অন্ধভক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশব্যাপী জনসংযোগ গড়ে তোলা হয়। দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ বাবরি মসজিদের চত্বরে এসে শ্রীরামের ভজন-পূজন শুরু করে দেয়। তখন শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কার কথা বলে ভারত সরকার বাবরি মসজিদে তালা লাগিয়ে নামাজ বন্ধ দেয়। সেই ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৯২ সালে ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলা পর্যন্ত বাবরি মসজিদে আর কখনো নামাজ পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি।

তবে সদ্যস্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু ও তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল দুজনেরই ইচ্ছে ছিল মসজিদের ভেতর থেকে রামলালার মূর্তিটি সরিয়ে ফেলা হোক। সে মর্মে প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু মসজিদ থেকে মূর্তি সরানোর নির্দেশ দেয় এবং এহেন আচরণের কারণে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে।

কিন্তু উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী ও প্রভাবশালী ব্রাহ্মণ নেতা গোবিন্দবল্লভ পন্থের জন্য তা সম্ভব হয়নি। সে ভয় পাচ্ছিল, রামের মূর্তি সরালে রাজ্যের হিন্দুরা ক্ষুব্ধ হবে এবং দু’বছর পরের সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসকে তার ফল ভুগতে হবে। অর্থাৎ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার কৌশল হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সমর্থন আদায়ের জন্য গোবিন্দবল্লভ প্রধানমন্ত্রীর সেই নির্দেশ বাস্তবায়ন না করে ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের খলনায়ক হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করে।
১৯৫৯ সালে তৃতীয় হিন্দু গোষ্ঠী হিসেবে নির্মোহী আখড়া জমির দখল চেয়ে ফৈজাবাদ আদালতে মামলা করে।
তার ঠিক দু’বছরের মাথায় ১৯৬১ সালে মসজিদের অধিকার ফিরে পেতে পাল্টা মামলা ঠোকে উত্তরপ্রদেশের সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড। বাবরি মসজিদের ভেতর থেকে রামলালার মূর্তি সরানোরও আর্জি জানান তারা। তালা ঝোলানোর পরবর্তী সাড়ে তিন দশক অযোধ্যা ও লাগোয়া ফৈজাবাদে মোটামুটি শান্তি বজায় ছিল।

বাবরি মসজিদ নিয়ে রাজনীতি
মসজিদ বা মন্দিরের দখল নিয়ে বিরোধ থাকলেও দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তখন পর্যন্ত সরাসরি এই বিতর্কে পক্ষ নেয়নি। কিন্তু সেই ধারার অবসান ঘটে ১৯৮৪ তে, যখন অযোধ্যাতে রামমন্দির গড়ার লক্ষ্যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ একটি প্রভাবশালী কমিটি গড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। স্থির হয়, সেই রামমন্দির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবে বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডভানি।

এরই মধ্যে ১৯৮৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ফৈজাবাদ ডিস্ট্রিক্ট সেসন জজ কে এম পান্ডে এক ‘জঘন্যতম’ রায় ঘোষণা করে। বাবরি মসজিদের তালা খুলে দিয়ে হিন্দুদের ‘পূজা ও দর্শনে’র অনুমতি প্রদান করে হিন্দুত্ববাদী আদালত। ইউ সি পান্ডে নামে এক আইনজীবী মামলা করেছিল, তালা ঝোলানোর নির্দেশ কোন আদালত দেয়নি, সেটা দিয়েছিল ফৈজাবাদ জেলা প্রশাসন– তাই তা বেআইনি এবং বাতিল করা হোক।

রায় ঘোষণার মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে তা কার্যকর করা হয় – সঙ্গে সঙ্গে হাজার হাজার হিন্দু ভক্তর ঢল নামে বাবরি মসজিদের প্রাঙ্গণে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, সাড়ে তিন দশক ধরে বন্ধ থাকা তালা হঠাৎ করে খুলে দেয়ার জন্য আদালত কেন রায় দিল? এর উত্তর মিলবে রাজীব গান্ধীর মন্ত্রিসভার সদস্য আরিফ মহম্মদ খানের বক্তব্যে। আইএএনএসকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,

‘১৯৮৫ সালে সুপ্রিম কোর্টে শাহবানো মামলার রায়ের পর সরকার যখন ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের’ দাবির কাছে নতি স্বীকার করল, তখন সেটা ব্যালান্স করার জন্য এবং হিন্দু সম্প্রদায়কেও দেখানোর দরকার ছিল যে, সরকার তাদের দাবিদাওয়ার প্রতিও সহানুভূতিশীল। ঠিক এই কারণেই শাহবানো মামলার মাত্র কয়েক মাস পরেই বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেয়া হয়েছিল বলে আমার বিশ্বাস।’

বাবরি মসজিদের তালা খুলে দেয়ার যখন রায় প্রদান করা হয় তখন প্রধানমন্ত্রী ছিল কংগ্রেস নেতা রাজিব গান্ধী। যদিও সে পরবর্তীতে মুসলমানদের সমর্থন ঠিক রাখার জন্য উক্ত মামলার বিষয়ে নিজের জড়িত না থাকার কথা জানিয়ে বলে, আমাকে সে বিষয়ে আদালত কিছুই জানায়নি। আমার অজান্তেই এটা হয়েছে।

১৯৮৬তে বিজেপির আদর্শিক অভিভাবক হিসেবে পরিচিত আরএসএস সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিল, অযোধ্যায় রামজন্মভূমিস্থল ও তৎসংলগ্ন এলাকার পুরোটাই হিন্দুদের রাম জন্মভূমি ট্রাস্টের হাতে তুলে দেয়া হোক। এক্ষেত্রে তারা আদালতের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা না করে সরকারিভাবে হিন্দুদের হাতে বাবরি মসজিদের জায়গা দিয়ে দেয়ার দাবি জানায়।

১৯৮৪র নির্বাচনে সারা দেশে মাত্র দু’টি আসন পাওয়া বিজেপি মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে ১৯৮৯ তে ৮৬ জন এমপি-র শক্তিশালী দল হয়ে ওঠার পেছনে অযোধ্যা আন্দোলনের বড় ভূমিকা ছিল।

ইন্ডিয়া আফটার গান্ধী’-তে ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ লিখেছেন, রাজনৈতিক এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য বিজিপি মসজিদ-মন্দিরের দ্বন্দ্ব উষ্কে দেয়।

রথযাত্রা ও দাঙ্গার ইতিবৃত্ত
সেই লক্ষ্যেই ঘোষণা করা হলো, গুজরাটের সোমনাথ মন্দির থেকে শুরু করে দেশের আটটি রাজ্যে ৬০০০ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে রামের জন্মস্থান অযোধ্যা পর্যন্ত একটি ‘রথযাত্রা’র আয়োজন করা হবে – যা শুরু হবে ১৯৯০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর।

আরও জানানো হলো, রথযাত্রায় নেতৃত্ব দেবে বিজিপি নেতা লালকৃষ্ণ আডভানি।
পূর্ব ঘোষণা মুতাবেক লালকৃষ্ণ আডভানির নেতৃত্বে শুরু হলো রথযাত্রা। তবে লালকৃষ্ণ আডভানির রথ অযোধ্যায় পৌঁছনোর ঠিক এক সপ্তাহ আগেই সমস্তিপুরে সেটিকে আটকে দেয় আডভানিকে বিহারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব। আডভানি আটক হলেও হাজার হাজার করসেবক (তথা হিন্দুধর্মের স্বেচ্ছাসেবক) অযোধ্যা অভিমুখে রওনা হয়ে যায়।

পাশের রাজ্য উত্তরপ্রদেশের মুলায়ম সিং যাদবের সরকার তখন অন্তত দেড় লক্ষ করসেবককে আটক করেছিল। কিন্তু আরও প্রায় লাখখানেক অযোধ্যায় ঢুকে পড়ে এবং তিনদিন ধরে তাদের সাথে নিরাপত্তা বাহিনীর রক্তাক্ত সংঘাত চলে। সেই সংঘর্ষে যে জনাবিশেক করসেবক নিহত হওয়ায় দেশের বিভিন্ন শহরে আন্দোলন করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ। পুরো দেশব্যাপী হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।

আশির দশকের শেষ দিকে যখন রামমন্দির আন্দোলনের পালে জোরালো বাতাস খেলতে শুরু করেছে, ঠিক সে সময় ভারতের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে হিন্দু মহাকাব্য রামায়ণের কাহিনির ওপর আধারিত একটি সিরিয়ালের সম্প্রচার শুরু হয়।
নির্মাতা রামানন্দ সাগরের সেই ‘রামায়ণ’ ১৯৮৭-৮৮ সালে টানা ৭৮ এপিসোড ধরে চলেছিল। প্রতি রোববার সকালে দূরদর্শনে রামায়ণের টেলিকাস্ট শুরু হওয়া মাত্র রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত, কোটি কোটি মানুষ সব কাজ ফেলে টেলিভিশনের সামনে বসে পড়তেন।

সমাজতাত্ত্বিকরা বলে থাকেন, ভারতে রামমন্দিরের পক্ষে জনমত তৈরিতে এই ‘কাল্ট’ সিরিয়ালের একটা বড় অবদান ছিল।

বাবরি মসজিদকে শহিদ করার জন্য অন্তত সুকৌশলে এই ধারাবাহিক চলচিত্রের মাধ্যমে হিন্দুদের জনসংযোগ তৈরি করা হয়। যার ফলে খুব সহজেই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সমর্থন নিয়ে বাবরি মসজিদ শহিদ করা সহজ হয়।

৯ নভেম্বর ১৯৮৯ সালে সরকারের সহায়তায় বিহারের কামেশ্বর চৌপাল বাবরি মসজিদ প্রাঙ্গণে মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে।

বাবরি মসজিদের শাহাদাত
রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য ১৯৮৪ সালে শুরু হওয়া বাবরি মসজিদ ধ্বংসের আন্দোলন দিনকে দিন ব্যাপক হচ্ছিল। বোঝাই যাচ্ছিল খুব দ্রুত বাবরি মসজিদ নিয়ে ভয়ংকর কিছু হতে যাচ্ছিল। ১৯৯০ এর রথযাত্রার পর বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়া কেবল সময়ের ব্যাপার ছিল।

১৯৯২ সালের ডিসেম্বর মাস। আরএসএস, বজ্রং এবং বিজিপির করসেবকরা সরকারের কাছে আবেদন জানায়, বাবরি মসজিদের পাশে সমাবেশের জন্য অনুমতি প্রদানের। হিন্দু নেতারা আশ্বাস দিয়েছিল, তারা মসজিদ স্পর্শ করবে না। তাদের কর্মসূচী মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং সেখানে একটি ধর্মীয় প্রার্থনা আয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
বৃহৎ হিন্দু জনগোষ্ঠীর চাপে পরে প্রশাসন তাদেরকে অনুমতি প্রদান করে। কিন্তু তারা যে পরিকল্পিতভাবে বাবরি মসজিদ শহিদ করার মিশন নিয়ে অগ্রসর হয়েছিল সেটা কারোরই অজানা নয়।

সেই সময়ের ‘দ্য পাইওনীয়ার পত্রিকার সাংবাদিক প্রভীন জৈন বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, আমি অযোধ্যা এসে পৌঁছাই ১৯৯২ সালের ৪ ডিসেম্বর। একজন বিজেপি এমপির সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, ৫ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলার একটা মহড়া হবে।

তিনি আমাকে আরও জানিয়েছিলেন, শীর্ষ নেতারা তাকে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন এই মহড়ায় যেন সাংবাদিকরা কোনভাবেই হাজির থাকতে না পারে।

আমি তখন ছদ্মবেশে এই হিন্দু করসেবকদের সঙ্গে মিশে গেলাম। মসজিদের অল্প দূরেই একটা ফুটবল মাঠের সমান একটা জায়গায় সবাই জড়ো হচ্ছিল। আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। হাজার হাজার মানুষ তখন সেখানে জড়ো হয়েছে যাদের সবার মাথায় পট্টি বাঁধা এবং গায়ে গেরুয়া বসন। ব্যাজ পরা হিন্দু করসেবকরা পুরো জায়গাটি ঘিরে রেখেছে। আমার সামনে তখন অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটে চলেছে। শাবল, কুড়াল, বেলচা এবং লোহার রড নিয়ে তখন লোকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তারা এক বিরাট মাটির ঢিবি ভেঙ্গে ফেলার চেষ্টা করছে। সবকিছুই ঘটছিল খুব পরিকল্পিত এবং সুচারুভাবে। এদের দেখে মনে হচ্ছিল না তারা কেবল স্বেচ্ছাসেবক, যেভাবে পেশাদারী কায়দায় তারা কাজ করছিল তাতে মনে হচ্ছিল কিভাবে একটা বিল্ডিং ভেঙ্গে ফেলতে হবে সেটা তারা ভালোভাবেই জানে। অবশেষে সেই মাটির ঢিবিটা ভেঙ্গে ফেলা হলো। হিন্দু করসেবকরা এরপর সোল্লাসে চিৎকার করতে লাগলো।’

৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২। প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী বাবরি মসজিদের পাশে জড় হতে থাকে বিজিপি, আরএসএস এবং বজ্রং দলের নেতাকর্মীসহ হিন্দু করসেবকরা। লাখ মানুষের সেই সমাবেশে বিজিপির নেতা লালকৃষ্ণ আডবানি, মুরলি মনোহর যোশী, উমা ভারতী, কল্যাণ সিংসহ অন্যান্য হিন্দু সংগঠনের নেতৃবৃন্দরা উস্কানীমূলক বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছিল।

উক্ত ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে সাংবাদিক প্রভীন জৈন বলেন, পরের দিন বাবরি মসজিদের কাছেই একটি ভবনের চার তলায় আমরা সাংবাদিকরা অবস্থান নিয়েছিলাম। সেখান থেকে বাবরি মসজিদ দেখা যায়। সেখানে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এবং বিজেপির নেতারা যে সভামঞ্চ তৈরি করেছেন, সেটিও চোখে পড়ে। প্রায় দেড় লাখ হিন্দু করসেব সেখানে জড়ো হয়েছে। সেখানে থাকা পুলিশ পর্যন্ত করসেবকদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে শ্লোগান দিচ্ছিল। দুপুরের একটু পর জনতা উন্মত্ত হয়ে উঠলো। যে পুলিশ বাহিনী এবং স্বেচ্ছাসেবকরা মসজিদ ঘিরে রেখেছিল, তাদের বেষ্টনি ভেঙ্গে ফেললো জনতা।
কিছু লোক আমরা যে ভবনে ছিলাম, তার চার তলায় উঠে এলো। তারা সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালালো। ক্যামেরা ভেঙ্গে ফেললো। কয়েক মিটার দূরেই যে মসজিদ ভাঙ্গার কাজ চলছে, সেটার কোন ‘ফোটোগ্রাফিক’ প্রমান যেন না থাকে। মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হলো বাবরি মসজিদ। যেদিন এভাবে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা হলো, একজন হিন্দু হয়ে আমি সেদিন লজ্জিত বোধ করছিলাম।‘ সূত্র বিবিসি বাংলা

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর রচিত হলো স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায়। সম্প্রীতির ধারা মুছে দিয়ে শুরু হিন্দু জাতীয়তাবাদের নিকৃষ্ট ধারা। বাবরি মসজিদ শহিদ হওয়াকে কেন্দ্র করে পুরো ভারতব্যাপী ছড়িয়ে পড়লো সংঘর্ষের উত্তাপ। যার জের ধরে ২০০২ সালে সংগঠিত হয় গুজরাটের দাঙ্গা। প্রচলিত গণমাধ্যমগুলো এটাকে দাঙ্গা হিসেবে অভিভূত করলেও প্রকৃতপক্ষে সেটা গুজরাটের মুসলিম গণহত্যা। যেই গণহত্যার নেতৃত্বদানকারীদের একজন হলো ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রায় দুই হাজারের মতো মুসলমানকে শহিদ করে দেয় উগ্রবাদী হিন্দু সম্প্রদায়। মুসলমানদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট পুড়িয়ে দেয়।

বাবরী মসজিদ ধ্বংস পরবর্তী মামলা
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তীতে ২০০৩ সালে লালকৃষ্ণ আডবানি, মুরলি মনোহর যোশী, উমা ভারতী, কল্যাণ সিংসহ একাধিক ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে মামলা হয়। কিন্তু উত্তর প্রদেশের একটি আদালত রায় দেয় যে মসজিদ ধ্বংস করার সাথে সম্পৃক্ত না থাকায় আদভানিকে রেহাই দিয়ে আদালতের জারি করা পূর্ববর্তী আদেশ পুনর্যাচাই করা উচিত।

২০০৯ সালের জুন মাসে মসজিদ ধ্বংস হওয়া সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে থাকা লিবারহান কমিশন তদন্ত শুরু করার ১৭ বছর পর তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়।

নভেম্বর ২০০৯: প্রকাশিত লিবারহান কমিশনের প্রতিবেদনে মসজিদ ধ্বংসের পেছনে বিজেপির শীর্ষ রাজনীতিবিদদের ভূমিকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয় এবং এ নিয়ে সংসদে হট্টগোল হয়।

২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আল্লাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দেয় যে স্থানটির নিয়ন্ত্রণ ভাগাভাগি করে দেয়া উচিত। কোর্টের রায় অনুযায়ী এক-তৃতীয়াংশের নিয়ন্ত্রণ মুসলিমদের, এক-তৃতীয়াংশ হিন্দুদের এবং বাকি অংশ নির্মোহী আখরা গোষ্ঠীর কাছে দেয়া উচিত। যেই অংশটি বিতর্কের কেন্দ্র, যেখানে মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিল, তার নিয়ন্ত্রণ দেয়া হয় হিন্দুদের কাছে। একজন মুসলিম আইনজীবী বলেন যে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবেন।

২০১১ সালের মে মাসে ২০১০ সালে প্রকাশিত রায়ের বিরুদ্ধে হিন্দু ও মুসলিম দুই পক্ষই আপিল করায় হাইকোর্টের পূর্ববর্তী রায় বাতিল করে সুপ্রিম কোর্ট।

২০১৭ সালে আদালত উভয় পক্ষকে বিষয়টি আদালতের বাহিরে মিটমাট করে নেয়ার পরামর্শ দেয়।

অবশেষে ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্ট চূড়ান্ত রায় প্রদান করে। আদালত স্পষ্টভাবে রায় দিয়ে জানায় যে বাবরি মসজিদের জমি রামমন্দির পুনর্গঠনের জন্য হিন্দুদের দেওয়া হবে এবং পাঁচ একর বিকল্প জমি দেওয়া হবে মুসলমানদের।

এই অন্যায় রায়ের পক্ষে আদালতের কাছে কার্যকর কোনো যুক্তি-প্রমাণ ছিল না। কেবল রাজনৈতিক ক্ষমতা বলে অন্যায়ভাবে একচেটিয়া রায় প্রদান করে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট।

২০২০ সালে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এবং বরিষ্ঠ হিন্দু নেতাদের উপস্থিতিতে অযোধ্যায় রাম মন্দিরের ভূমিপুজো অনুষ্ঠিত হয়।

২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মামলায় অভিযুক্ত লালকৃষ্ণ আডবানি, মুরলি মনোহর যোশী, উমা ভারতী, কল্যাণ সিং এবং অন্যান্য ২৮ জনকে সিবিআইয়ের বিশেষ আদালত নির্দোষ বলে মামলা থেকে মুক্ত করে।
অবশেষে ২২ জানুয়ারী ২০২৪, অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের জায়গায় নবনির্মিত রামমন্দিরের গর্ভগৃহে রামলালার প্রাণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলিমদের বিরুদ্ধে চূড়ান্তভাবে অবস্থান নেয় নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজিপি সরকার। সারা বিশ্বের মুসলিম সমাজ এই কাজের নিন্দা জানায় এবং ব্যথিত হয়।

জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের আমীর মাওলানা আরশাদ মাদানী হাফিজাহুল্লাহ একটি বক্তৃতায় বলেন, বাবরী মসজিদ ধ্বংস করে সেই ধ্বংসস্তুপের ওপর যদি একটি নয়, একশো মন্দিরও নির্মাণ করা হয়; কিয়ামত পর্যন্ত এ জায়গা মসজিদই থাকবে। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত পূর্ণ অনুসন্ধান শেষে স্বীকার করেছে যে এটি রামের জন্মভূমি নয়; মসজিদই ছিল। আমি আমৃত্যু বলে যাব যে এটি আল্লাহর মসজিদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top