শায়খ ইবনুল কালাম
বর্তমানে অনেক বাবা-মা চান যে তাদের সন্তানরা পারিবারিক ব্যবসার দায়িত্ব কাঁধে নিক। যেন ভবিষ্যতে তারা দক্ষতার সাথে সেটি চালিয়ে নিতে পারে। তবে সন্তানকে কেবল কর্মচারি হিসেবে না রেখে পার্টনার বা অংশীদার হিসেবে ব্যবসায় যুক্ত করলে এবং সেটিকে শরিয়াহসম্মতভাবে সুনির্দিষ্ট চুক্তির মাধ্যমে করলে ভালো। কারণ, স্পষ্টতা না থাকলে ভবিষ্যতে উত্তরাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব, ঝগড়া ও পারিবারিক অশান্তি দেখা দিতে পারে।
ব্যবসায় পার্টনার করার দু’টি বৈধ উপায় রয়েছে। প্রথমটি হলো, বিনিময়ের মাধ্যমে শেয়ার প্রদান। সন্তান নিজের অর্থ দিয়ে বা বাবার কাছ থেকে ধার নিয়ে বিনিয়োগ করে শেয়ার কিনে নেবে। এরপর যদি ধার নিয়ে থাকে, তাহলে সেটি পরিশোধ করে দেবে। বাকি বাবার জন্য ওই ঋণ মাফ করে দেয়ারও সুযোগ রয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো, উপহার হিসেবে শেয়ার প্রদান। বাবা সন্তানের প্রতি ভালোবাসা ও ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা করে ব্যবসার নির্দিষ্ট অংশ গিফট করবেন।
এই দুই পদ্ধতির যেকোনো একটি অনুসরণ করে লিখিত ও সাক্ষ্যযুক্ত চুক্তি করা জরুরি। ইসলামের নির্দেশনায় আমরা দেখি- অর্থনৈতিক লেনদেন যত কাছের আত্মীয়ের সাথেই হোক না কেন, তা স্পষ্ট ও প্রামাণ্য হতে হয়। সুতরাং সন্তান যদি নির্দিষ্ট শেয়ারের মালিক হিসেবে পার্টনার হয়, তাহলে সেই অংশে তার একক মালিকানা থাকবে এবং বাবার মৃত্যুর পরও তাতে তার মালিকানা বাকি থাকবে। আর অন্য অংশে সে অন্যান্য উত্তরাধিকারীদের মতো ভাগ পাবেন।
আল্লাহ তায়ালা কুরআন শরিফে বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন পরস্পরের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঋণ লেনদেন করো, তখন তা লিখে রাখো।’ (সূরা আল-বাকারা: ২৮২)।
এই আয়াতের ভিত্তিতে ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম মূলনীতি হলো- লেনদেন লিখিতভাবে দলিল করতে হবে, যেন ভবিষ্যতে ভুল বোঝাবুঝি বা বিবাদ না হয়। সন্তানের সাথে ব্যবসায়িক অংশীদারিত্বও এক ধরনের লেনদেন। তাই এটি লিখিতভাবে করা জরুরি।
অপর আয়াতে এসেছে, ‘…তোমরা যখন ক্রয়-বিক্রয় করো, তখন সাক্ষী রাখো।’ (সূরা আল-বাকারা: ২৮২)। ব্যবসা বা বিনিয়োগের ব্যাপারেও ইসলামের স্পষ্ট নির্দেশ- সাক্ষী রাখা ও প্রমাণ রাখা আবশ্যক। কারণ এতে দ্বন্দ্বের পথ রুদ্ধ হয়।
হাদিস শরীফে এসেছে, আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সন্তানদের মাঝে ন্যায়বিচার করো।’ (সহীহ বুখারী: ২৫৮৭)।
এক সাহাবি তার ছেলেকে কিছু সম্পদ দিতে চাইলেন। রাসূল সা. জিজ্ঞেস করলেন, তিনি অন্য সন্তানদেরও অনুরূপ দিচ্ছেন কিনা? তিনি না বললে, রাসূল সা. ওই দান দিতে নিষেধ করলেন এবং বললেন, এটা ইনসাফ নয়। অর্থাৎ কোনো সন্তানকে ব্যবসার শেয়ার দিলে সেটা স্পষ্টভাবে, ন্যায়ের ভিত্তিতে ও দলিলসহ করতে হবে।
অপর হাদিসে এসেছে, ‘যা সন্দেহজনক, তা বর্জন করো; আর যা সন্দেহমুক্ত, তার ওপর অটল থাকো।’ (তিরমিযি: ২৫১৮)।
অনেক সময় দেখা যায়, সন্তান বাবার ব্যবসায় কাজ করছে। কিন্তু কোনো লিখিত চুক্তি নেই। বাবা মারা গেলে ভাইয়েরা বলে, ‘সে তো শুধু কর্মচারি ছিল, কোনো শেয়ারে তার অধিকার নেই।’ তখন ঝগড়া শুরু হয়। ইসলামের শিক্ষা হলো- সন্দেহজনক অবস্থা এড়াতে। তাই শুরু থেকেই চুক্তি ও সাক্ষ্য নিশ্চিত করতে হবে।
কাওয়ায়িদুল ফিকহের একটি মূলনীতি আছে। الضرر يزال তথা ক্ষতি দূর করতে হবে। অপর মূলনীতি হলো, العقود مبنية على التراضي তথা চুক্তিগুলো পারস্পরিক সম্মতির ওপর ভিত্তি করে হয়।’ এসব নীতিমালা অনুযায়ী, সন্তানকে ব্যবসার অংশীদার করতে হলে সেটা স্বচ্ছ, ন্যায্য ও লিখিত চুক্তির মাধ্যমে হওয়া উচিত।
সন্তানকে ব্যবসার পার্টনার বানানো একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। এটি করতে গিয়ে যদি শারিয়ার নিয়ম মানা না হয়, ভবিষ্যতে তা পরিবারে ফাটল সৃষ্টি করতে পারে। তাই এখন থেকেই করণীয় হলো, স্পষ্ট চুক্তি, সাক্ষ্য ও লিখিত দলিল, ন্যায্যতা ও ইনসাফ, সন্দেহমুক্তভাবে শরিয়াহর নির্দেশ অনুসরণ।
বাবার ব্যবসায় ছেলেকে যুক্ত করার সময় যদি তার ভূমিকা—সে কি কেবল সহকারী, বেতনভুক্ত কর্মচারি, না ব্যবসার অংশীদার—এই বিষয়টি স্পষ্ট না করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তা উত্তরাধিকার নিয়ে বিরোধ, পারিবারিক অশান্তি এবং এমনকি ভাইদের মধ্যে শত্রুতার কারণ হতে পারে। এমনও হতে পারে যে একজন ভাই বাবা জীবিত থাকতেই ব্যবসায় বছরজুড়ে শ্রম ও সময় দিয়েছে, কিন্তু মৃত্যুর পর সে বাবার ব্যবসার অন্যান্য ভাইদের মতোই অংশ পায়—এতে সে নিজেকে অবহেলিত মনে করে। আবার উল্টোভাবে, সে পুরো ব্যবসাটাই নিজের বলে ধরে নেয়, যা অন্য ভাইদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। উভয় রকমের অবস্থাই হতে পারে।
এসব সমস্যা এড়াতে শরিয়তের নির্দেশ হলো—ছেলেকে ব্যবসায়ে যুক্ত করার সময় লিখিতভাবে ও স্পষ্টভাবে ঠিক করে নিতে হবে যে, সে কর্মচারি না পার্টনার। কর্মচারি হলে তার নির্ধারিত বেতন থাকবে এবং ব্যবসার মালিকানা পিতার থাকবে। আর যদি পার্টনার করা হয়, তাহলে তাকে নির্দিষ্ট শেয়ার দিয়ে শরিয়াহসম্মত পার্টনারশিপ চুক্তি করতে হবে।
অর্থাৎ, সন্তানকে ব্যবসায় যুক্ত করার আগে তার দায়িত্ব, মালিকানা ও অধিকারগুলো শরিয়াহ অনুযায়ী নির্ধারণ করলেই ভবিষ্যতের ঝগড়া, বঞ্চনা এবং অন্যায় এড়ানো সম্ভব।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিক বোঝাপড়ার সাথে ইনসাফ ও আমানের পথ অনুসরণ করার তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক : পরিচালক, নদওয়াতুল হানাফিয়া বাংলাদশে