বিবাহ, সমতা, কুফু,

বিবাহে কেন সমতা বিধান জরুরি

মাওলানা আহমেদ সাঈদ

সামাজিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বিকাশের জন্য পরিবার গঠনের উদ্দেশ্যে বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি। বিবাহের মাধ্যমে গড়ে ওঠা পবিত্র বন্ধন শুধু পরিবার গঠনেই সহায়ক নয়। বরং এটি নৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষা প্রদান করে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তিনিই মানুষকে সৃষ্টি করেছেন পানি থেকে। অতঃপর তিনি তার বংশগত ও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছেন। তোমার রব সর্বশক্তিমান।’ (সুরা ফুরকান, আয়াত : ৫৪)

ইমাম বুখারি (রহ.) এই আয়াতকে ‘কুফু’ অধ্যায়ের শুরুতে উল্লেখ করেছেন। আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি (রহ.) ব্যাখ্যা করেছেন, বংশ ও শ্বশুর-জামাতার সম্পর্কের সাথে কুফুর সম্পর্ক আছে এবং ভবিষ্যৎ বংশ রক্ষার জন্য কুফু রক্ষা করা জরুরি।

গবেষণায় দেখা গেছে, বিবাহবিচ্ছেদ ও দাম্পত্য কলহের কারণগুলোর সাথে ইসলামের কুফু বিধানের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। বর-কনের মধ্যে সমতা রক্ষা না হলে বিবাহবিচ্ছেদ বা কলহের আশঙ্কা বেড়ে যায়। (ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা)

ইমাম খাত্তাবি (রহ.) বলেন, দ্বীনদারী, আজাদি, বংশ ও জীবিকা—এই চারটি বিষয়ে কুফু বিচার্য। কেউ কেউ দোষ-ত্রুটিমুক্ত থাকা ও আর্থিক সচ্ছলতাকেও কুফুর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ইমাম মালিক (রহ.) দ্বীনদারীকে কুফুর প্রধান মানদণ্ড আখ্যা দিয়েছেন। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) ধন-সম্পদকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। হানাফি মাজহাবে বংশমর্যাদা ও আর্থিক অবস্থা বিশেষভাবে বিবেচ্য। স্বামী-স্ত্রীর বংশগত বা আর্থিক বৈষম্য তাদের পরস্পরকে অন্তর দিয়ে গ্রহণে বাধা হতে পারে। বাস্তবতা বিবেচনায় দ্বীনদারী ছাড়াও বংশমর্যাদা, জীবিকা ও আর্থিক অবস্থার বিচার অন্যায় নয়। বিশেষত মেয়েদের বিবাহ দেয়ার সময় কুফু দেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নমানের পাত্রের সাথে উচ্চমানের পাত্রীর বিবাহ দেয়া অনুচিত।

আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা উত্তম নারী গ্রহণ করো এবং সমতা বিবেচনায় বিবাহ করো। আর বিবাহ দিতেও সমতার প্রতি লক্ষ রাখো।’ (ইবনে মাজাহ)

বর্তমানে বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। এর কিছু কারণ হলো- ইসলামী বিধান যথাযথভাবে না মানা; যেমন পাত্র-পাত্রী দেখা, নির্বাচন, সম্মতি, অভিভাবকের মতামত, কুফু রক্ষা, মোহরানা আদায় ইত্যাদি। পর্দা লঙ্ঘন করে অবাধ মেলামেশা এবং পারস্পরিক অধিকার-দায়িত্ব পালনে অবহেলা।

অন্যদিকে স্বামীর বেকারত্ব, সীমিত আয়, স্ত্রীর বিলাসিতার মোহ, স্বামীর স্ত্রীর অর্থের ওপর নির্ভরতা ও কর্তৃত্ব খাটানোর প্রবণতা ইত্যাদিও বিবাহবিচ্ছেদের কারণ। বর-কনের মানসিক অপরিপক্বতা, সামাজিক মর্যাদা ও শিক্ষা বিবেচনা না করা, আবেগের বশবর্তী হয়ে কিংবা অর্থের কারণে বিবাহও দাম্পত্য কলহের কারণ হয়। ব্যক্তিত্বের বৈপরীত্য ও আনুগত্যের অভাবও বিবাহবিচ্ছেদে ভূমিকা রাখে। দারিদ্র্য, অপসংস্কৃতি, নৈতিকতার অবনতি ও মূল্যবোধের অবক্ষয় বিবাহবিচ্ছেদের আরেকটি কারণ। স্বামী-স্ত্রীর বয়সের ব্যাপক পার্থক্যও শারীরিক সমস্যার একটি বড় কারণ।

কুফুর প্রধান দিকগুলো হলো—গোত্র, দ্বীনদারী ও আদর্শ, পেশা ও অর্থনীতি। গোত্রগত দিকটি আরবদের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। উচ্চ বংশের নারী নীচ বংশের পুরুষের অধীনে থাকতে ঘৃণা বোধ করতে পারে। তবে অনারবদের ক্ষেত্রে ধর্মীয় দিকটাই মুখ্য। কারণ অনারবদের মধ্যে বংশের স্বাতন্ত্র্য অনেকাংশে বিলুপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাকওয়া ও ইসলামই কুফুর প্রধান মানদণ্ড। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহর কাছে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যে সর্বাধিক তাকওয়া অবলম্বনকারী।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ১৩)

অর্থনৈতিক দিক থেকে যিনি স্ত্রীকে দেনমোহর ও ভরণ-পোষণ দিতে সক্ষম, তিনিই কুফু বিবেচিত হবেন। ধনসম্পদের তারতম্য বিবেচ্য নয়। কারণ সম্পদ চিরস্থায়ী নয়। যে দেনমোহর ও ভরণ-পোষণে অক্ষম, সে নির্ধন নারীর কুফু নয়। পেশাগত দিক থেকেও সমতা বিবেচনা জরুরি। যেমন ঝাড়ুদার, নাপিত, তাঁতি, ধোপা ইত্যাদির সঙ্গে আতর বিক্রেতা, কাপড় বিক্রেতা, মুদ্রা ব্যবসায়ীদের মেয়েদের কুফু হবে না। তবে নিজ নিজ শ্রেণির মধ্যে কুফু রক্ষা করা উচিত।

লেখক : শিক্ষক, মাদরাসাতুত তাকওয়া ঢাকা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top