হামাস, ইসরাইল, হোয়াইট হাউস, নেতানিয়াহু, ফিলিস্তিনি

বিভিন্ন দেশে থাকা হামাসের শীর্ষ নেতাদের উপর আক্রমণ চালাতে পারে ইসরাইল

আগামী সপ্তাহে হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাতের প্রস্তুতি নিচ্ছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তবে এ সময় জোরালো গুঞ্জন উঠছে যে বিদেশে অবস্থানরত হামাসের শীর্ষ নেতাদের টার্গেট করতে পারে ইসরাইল।

আশঙ্কা করা হচ্ছে যে গাজা, আলজেরিয়া, লেবানন এবং সম্ভবত কাতারেও অবস্থানরত হামাসের শীর্ষ কর্মকর্তাদের হত্যার চেষ্টা করতে পারে ইসরাইল। যদিও যুক্তরাষ্ট্র গাজায় নতুন যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ দিচ্ছে।

গত মাসে ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ কাতারের দোহায় অবস্থানরত হামাসের সিনিয়র রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য খলিল আল-হাইয়াকে হত্যার হুমকি দেন। তিনি আরো জানান, গাজাভিত্তিক হামাসের সামরিক শাখার কমান্ডার ইজ্জ আল-দীন আল-হাদ্দাদকেও লক্ষ্যবস্তু করা হবে।

ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম ম্যারিভ গত জুন মাসে জানায়, ইসরাইলের কাছে হামাসের একটি ‘হিট-লিস্ট’ রয়েছে। এতে হাইয়ার পাশাপাশি লেবাননের সাবেক মুখপাত্র ওসামা হামদান এবং আলজেরিয়ায় হামাসের প্রতিনিধি সামি আবু জুহরি রয়েছেন।

হামাসের রাজনৈতিক ও সামরিক শাখা আলাদা সত্তা হিসেবে গঠিত। ২০১২ সাল পর্যন্ত দলটির রাজনৈতিক নেতৃত্ব সিরিয়ার দামেস্কে ছিল। তবে গৃহযুদ্ধের কারণে সিরিয়ার সরকারের সাথে বিরোধ শুরু হলে তারা দামেস্ক ত্যাগ করে।

২০১১ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার অনুরোধে কাতার হামাসের নির্বাসিত নেতৃত্বকে আশ্রয় দিতে রাজি হয়।

মিসরের কায়রোতেও হামাসের একটি অফিস ছিল। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে হামলার পর সেটি এখনো সচল কিনা তা স্পষ্ট নয়। হামাসের রাজনৈতিক নেতারা তুরস্কেও সময় কাটান বলে জানা যায়। তবে সেখানে তাদের কোনো আনুষ্ঠানিক অফিস আছে কিনা, তাও নিশ্চিত নয়।

বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ‘টাইমস’ জানায়, কাতারি কর্মকর্তারা হাইয়াসহ হামাস নেতাদের ব্যক্তিগত অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। অস্ত্র জমা দিতে বলা অন্যান্য কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন হামাসের শূরা কাউন্সিলের প্রধান মুহাম্মদ ইসমাইল দারবিশ এবং রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য জাহের জাবারিন।

তবে মিডল ইস্ট আই স্বাধীনভাবে এই প্রতিবেদন যাচাই করতে পারেনি।

কাতার : যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র

যদি ইসরাইল কাতারে হাইয়াকে হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে, তাহলে তা হামাসের বিরুদ্ধে অভিযানকে আরো বিস্তৃত করে তুলবে। সম্প্রতি পর্যন্ত ইসরাইল মূলত গাজা, পশ্চিমতীর, ইরান ও লেবাননে হামাস নেতাদের লক্ষ্যবস্তু করছিল।

গাজার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে বিদেশে ইসরাইলের প্রথম বড় আক্রমণ ছিল বৈরুতে হামাসের সিনিয়র নেতা ও আল-কাসসাম ব্রিগেডের প্রতিষ্ঠাতা সালেহ আল-আরৌরির হত্যাকাণ্ড। কিন্তু কাতারে হামাস সদস্যদের লক্ষ্যবস্তু করা গুরুতর কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, এটি কেবল মধ্যপ্রাচ্যের নয়, যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মিত্র দেশ। এখানেই অবস্থিত মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ডের আঞ্চলিক সদর দফতর আল-উদেইদ ঘাঁটি।

গত মাসে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের একটি গোপন বিমান হামলার প্রতিক্রিয়ায় আল-উদেইদ ঘাঁটি লক্ষ্য করেছিল। সেই হামলার আগে মার্কিন ও ইরানি কর্মকর্তারা পরোক্ষভাবে সমন্বয় করেন, যেখানে কাতার মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে। এর পর যুক্তরাষ্ট্র কাতার থেকে বিমান ও ভারী সরঞ্জাম সৌদি আরবে স্থানান্তর করে।

যুদ্ধের সময় কাতার ও মিসর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়। তবুও ট্রাম্প প্রশাসন চলতি বছরের শুরুতে কয়েক দশকের রীতি ভেঙে সরাসরি হামাসের সাথে আলোচনা করে। অথচ ওয়াশিংটন তাদেরকে উগ্রবাদী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে রেখেছে। এই আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র একজন দ্বৈত মার্কিন-ইসরাইলি নাগরিকের মুক্তি নিশ্চিত করেছে।

ইসরাইলি হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ হাত

নেতানিয়াহুর আমেরিকা সফরকালে হত্যার নির্দেশ দেয়ার রেকর্ড আছে। তাকে ইসরাইলের দীর্ঘ সামরিক বাহিনীর প্রতীক হিসেবেও উপস্থাপন করা হয়। নেতানিয়াহু জাতিসঙ্ঘে ভাষণ দেয়ার ঠিক পরেই ইসরাইল হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করে। তখন নেতানিয়াহুর অফিস একটি ছবি প্রকাশ করে, যেখানে তাকে নিউইয়র্কের একটি সাদামাটা অফিস থেকে হামলার নির্দেশ দিতে দেখা যায়।

২০২৪ সালের জুলাইয়ে তিনি মার্কিন কংগ্রেসে ভাষণ দেয়ার এক সপ্তাহ পর তেহরানে সাবেক হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করা হয়। এছাড়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরাইল গাজায় হামাসের অনেক সিনিয়র নেতাকে হত্যা করেছে। হামাসের সামরিক কমান্ডাররা ইসরাইলের প্রধান লক্ষ্য। মে মাসে তারা হাদ্দাদের পূর্বসূরি মুহাম্মদ সিনওয়ারকে হত্যা করে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরে হামলার পর মুহাম্মদের ভাই ইয়াহিয়া সিনওয়ার ছিল ইসরাইলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ টার্গেট। তাকে ধরতে ইসরাইল এক বছরেরও বেশি সময় অনুসন্ধান চালায়, যুক্তরাষ্ট্র গোয়েন্দা সহায়তা দেয়। অবশেষে ২০২৪ সালের অক্টোবরে রাফায় এক বন্দুকযুদ্ধে তিনি নিহত হন। ইসরাইলি বাহিনী হঠাৎ করেই তখন তার অবস্থান পর্যন্ত পৌঁছে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়।

‘বড় বাধা’ এখনো রয়ে গেছে

হামাস নেতাদের হত্যার পদক্ষেপ গাজায় যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টার মাঝে নতুন চাপ তৈরি করতে পারে। ট্রাম্প সম্প্রতি জানিয়েছেন, ইসরাইল ৬০ দিনের একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। হামাস প্রস্তাবটি গ্রহণ করবে কিনা, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে ইসরাইলের চ্যানেল ১৪ জানিয়েছে, প্রস্তাবে একটি মার্কিন ‘গোপন পার্শ্বচিঠি’ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যাতে ইসরাইলকে যুদ্ধ পুনরায় শুরু করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।

ইসরাইলের লিখিত সম্মতি প্রয়োজন কিনা তা স্পষ্ট নয়। কারণ ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে একবার যুদ্ধবিরতি হয়েও মার্চে ইসরাইল একতরফাভাবে গাজায় হামলা পুনরায় শুরু করে।

টাইমস অব ইসরাইলের সাথে আলাপে দুই আরব কূটনীতিক জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতির ক্ষেত্রে বড় বাধা রয়ে গেছে বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশনকে (জিএইচএফ) ঘিরে। হামাস জাতিসঙ্ঘ-পরিচালিত পুরনো সাহায্য বিতরণ ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার দাবি জানিয়েছে।

গাজায় তিন মাসের পূর্ণ অবরোধের পর মে মাসের শেষের দিকে বিতরণ শুরু করে জিএইচএফ। এ সময় খাদ্য ও ত্রাণ বিতরণের চেষ্টা করতে গিয়ে ইসরাইলি বাহিনীর হাতে ৫৮০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত ও ৪,২০০ জনের বেশি আহত হয়।

আন্তর্জাতিক সংস্থারাও হামাসের উদ্বেগের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে। মঙ্গলবার ১৭০টির বেশি এনজিও একযোগে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল-সমর্থিত জিএইচএফ বাতিল করে জাতিসঙ্ঘের নেতৃত্বে ত্রাণ বিতরণ ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

এখন পর্যন্ত গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনে ৫৬ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

সূত্র : মিডল ইস্ট আই

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top