বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭১ সালে যে উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছিল, মাত্র চার বছরের মধ্যেই সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তা নিভে গিয়েছিল। গত বছর একটি গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শুরু হওয়া বাংলাদেশের ‘দ্বিতীয় মুক্তি’ আরও দ্রুত ব্যর্থতার পথে হাঁটছে। ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্রদের নেতৃত্বে এক আন্দোলনে পদচ্যুত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি টানা ১৫ বছর ধরে দেশ শাসন করছিলেন এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শাসন পদ্ধতি ছিল আরও বেশি কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছিল। এরপর দেশের দায়িত্ব নেয় অন্তর্বতী সরকার, যার নেতৃত্বে আছেন ক্ষুদ্রঋণ আন্দোলনের পথিকৃৎ ও জাতীয় নায়ক মুহাম্মদ ইউনূস। সে সরকার দেশের গণতন্ত্র পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। প্রায় এক বছর পার হতে চলেছে, এখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।
সত্যি বলতে, মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর অন্তর্বতী সরকার অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মুখে দায়িত্ব নিয়েছে। বছরের পর বছর অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। সর্বত্র ছিল খোলামেলা দুর্নীতি; বিরোধীদের ওপর হামলা চালানো ছিল সাধারণ ঘটনা। এক সময় চমৎকার প্রবৃদ্ধির পর দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়েছিল; তরুণদের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ ছিল বেকার। অনেক বিক্ষুব্ধ আন্দোলনকারী প্রতিশোধ নেওয়ার শপথ করেছিল, তারা যাকেই শেখ হাসিনার সরকারের সহযোগী মনে করেছিল, তাকেই শাস্তি দিতে চেয়েছিল।
তবে নতুন সরকার কিছু অগ্রগতি দেখাতে পেরেছে। তারা সাবধানী ভাষায় বলেছে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের পরিকল্পনা আছে। অর্থনীতি ধীরগতি হলেও স্থিতিশীল। মূল্যস্ফীতি কমেছে। আন্তর্জাতিক ঋণদাতারা অর্থ সাহায্য করছে।
কিন্তু অন্তর্বতী সরকারের অনেক পদক্ষেপই ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে। বৈদেশিক নীতিতে বাংলাদেশ এখন চীনের দিকে ঝুঁকছে, যেখানে বিনিয়োগ, বাণিজ্য এবং তুলনামূলকভাবে সস্তা অস্ত্রের আশ্বাস পাচ্ছে। এতে আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক ঝুঁকিতে পড়ছে, অথচ আমেরিকা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানির বাজার এবং ট্রাম্প প্রশাসনের তহবিল কমানোর আগ পর্যন্ত অন্যতম প্রধান সাহায্যদাতা ছিল। শুধু তাই নয়, চীনের দিকে ঝুঁক এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানো ভারতের কাছেও অসন্তোষের কারণ হয়েছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক, যা গত গ্রীষ্ম পর্যন্ত উন্নতির দিকে যাচ্ছিল, এখন খারাপের দিকে যাচ্ছে। সম্প্রতি ভারত বাংলাদেশের জন্য লাভজনক এক ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তি বাতিল করেছে এবং বাংলাদেশি অভিবাসীদের ফেরত পাঠিয়েছে। এখন তারা গুরুত্বপূর্ণ নদী-সম্পর্কিত একটি চুক্তি পুনর্বিন্যাস করতে চাইছে।
মুহাম্মদ ইউনূসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো দেশের রাজনীতি ঢেলে সাজানো। এর অর্থ, দেশের যেসব দল পরস্পরের সঙ্গে সর্বদা বিরোধে জড়িয়ে থাকে, তাদের মধ্যে নির্বাচনসহ রাজনৈতিক কাঠামোর নতুন নিয়ম নিয়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছানো। কিন্তু ইতোমধ্যেই দেখা যাচ্ছে, রাজনীতিকদের ধৈর্য ফুরিয়ে আসছে। রাজনৈতিক বিরোধ আবার রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ছে। জুনের মাঝামাঝি একদল লোক ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে কারচুপির অভিযোগে অভিযুক্ত সাবেক নির্বাচন কমিশনারের ওপর হামলা চালিয়েছে।
মে মাসে অন্তর্বতী সরকার একটি বড় ভুল করেছে। তারা আওয়ামী লীগকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করেছে, ফলে আগামী বছরের নির্বাচনে দলটি অংশ নিতে পারবে না। আদালত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতায় থাকার সময় যেসব অপরাধ হয়েছে, তার বিচার করছে—এটা ঠিক আছে। তবে অনেকের মধ্যে আশা ছিল, সাধারণ কর্মীদের সুযোগ দেওয়া হবে নতুন করে দল গোছানোর।
এই নিষেধাজ্ঞা সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সংশোধন এনে কার্যকর করা হয়েছে, যা আইনগত দিক থেকে বিতর্কিত। এতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহুদিন ধরে চলে আসা পুরোনো অপকৌশলের গন্ধ পাওয়া যায়, যেখানে ক্ষমতাসীনরা সব সময় বিরোধীদের দমন করতে নানা পথ খুঁজে নেয়। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে আবার সেই প্রতিশোধ আর পাল্টাপাল্টির দুষ্টচক্রে ঠেলে দিতে পারে।
বাংলাদেশের নেতৃত্বের উচিত আওয়ামী লীগের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া এবং তাদেরকে সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়া। অনেক নাগরিকের কাছে এটা অপ্রীতিকর মনে হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো এই দলে সবাই কলুষিত নয়। সংখ্যালঘুসহ অনেক শ্রেণির মানুষের মধ্যেও দলটির উল্লেখযোগ্য সমর্থন রয়েছে। বছরের পর বছর ভোটের নামে যে নাটক হয়েছে, তার পর মানুষ অন্তত যাকে খুশি তাকে ভোট দেওয়ার অধিকারটা তো পেতে পারে।
আওয়ামী লীগ অবাধ নির্বাচনের সুযোগ পেলেও হয়তো জিততে পারবে না। তবে সংসদে তাদের উপস্থিতি থাকলে বিরোধী দল আরও শক্তিশালী হবে, যা ক্ষমতাসীনদেরও নিয়ন্ত্রণে রাখবে। নতুন বাংলাদেশ গড়তে গেলে প্রতিশোধ নয়, দরকার মীমাংসা।
দ্য ইকোনমিস্ট থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান ফারুক