বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

যেভাবে ইসরাইলের একচ্ছত্র নেতা হয়ে ওঠেন বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যেভাবে ইসরাইলের একচ্ছত্র নেতা হয়ে ওঠেন, এ বিষয়ে মিডল ইস্ট আই একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন করেছে। এতে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু শুরু জীবন থেকে ইসরাইলের একচ্ছত্র নেতা হয়ে ওঠা পর্যন্ত দীর্ঘ জার্নি নিয়ে সবিস্তর আলোচনা করা হয়েছে। প্রতিবেদনটির গুরুত্ব বিবেচনায় টুডেনিউজ বিডি ডটনেট টিম এর অনুবাদ পাঠকদের জন্য তৈরি করেছে। নিম্নে পুরো প্রতিবেদনটির বাংলা অনুবাদ দেয়া হলো,

১৯৪৮ সালে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসরাইলের ইতিহাসে অন্য যেকোনো নেতার চেয়ে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় রয়েছেন। তিনি ইসরাইলে জন্ম নেওয়া প্রথম নেতা, যার চরিত্র, বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গি দেশের জনগণকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে এবং তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ইসরাইলকে গঠন করেছে।

ফিলিস্তিনি সার্বভৌমত্বের ধারণার প্রতি অনেক ইসরাইলির একগুঁয়েমির প্রতীক হয়ে উঠেছেন তিনি; এতটা স্পষ্ট জাতীয়তাবাদী মনোভাব অন্য কোনো নেতার মধ্যে দেখা যায়নি।

ইসরাইলের অর্থনীতিতে গাজা যুদ্ধের প্রভাব

এর অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। ১৯৯৫ সালের নভেম্বরে, অসলো চুক্তির বিরোধী এক ডানপন্থী ইসরাইলি কর্মীর হাতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইতজাক রাবিন নিহত হওয়ার কয়েক মাস আগেই নেতানিয়াহু ‘রাবিনের মৃত্যু’ স্লোগান দিয়ে একটি ব্যঙ্গাত্মক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া আয়োজন করেছিলেন। পরে রাবিনের বিধবা স্ত্রী তাঁকে ‘দানবীয়’ এবং ‘দুঃস্বপ্ন’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন।

২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সম্মত হলেও, তিনি জেরুজালেমের পূর্ণ ইসরাইলি সার্বভৌমত্ব ও ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সামরিকীকরণের ওপর জোর দিয়ে আলোচনাকে ভেঙে দেন।

তিনি দুর্নীতির অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন, যেগুলো তিনি অস্বীকার করেছেন, এবং বিচার বিভাগের সংস্কার আনার চেষ্টা করেছেন। এসব পদক্ষেপ তাঁর মিত্রদের মধ্যে জনপ্রিয়তা কমিয়ে দিয়েছে এবং বিরোধীদের মধ্যে চরম ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।

ট্রাম্পের গাজা থেকে বাস্তুচ্যুতির পরিকল্পনা নতুন নাকবার সঙ্কেত

২০২৪ সালের ‘দ্য বিবি ফাইলস’ ডকুমেন্টারিতে বিক্ষোভে বক্তৃতা দেওয়া তাঁর শৈশবের বন্ধু উজি বেলার বলেন, ‘তিনি বাম এবং ডান উভয় দিকেই মিথ্যা বলেন। বিবির কাছে মিথ্যা বলা কোনো খারাপ বিষয় নয়। এবং এতে তিনি কোনো রকম সমস্যাও অনুভব করেন না।’ সাবেক প্রধানমন্ত্রী (এবং লিকুদ নেতা) ইতজাক শামির একবার তাঁকে ‘ধ্বংসের দেবদূত’ বলে বর্ণনা করেছিলেন।

তবে সম্ভবত ইসরাইলিদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা থেকে হামাসের নেতৃত্বে চালানো হামলা প্রতিরোধে নেতানিয়াহুর ব্যর্থতা, যেখানে ১,১০০ জনেরও বেশি ইসরাইলি নিহত হয়েছিল। তিনি সেদিনই যুদ্ধ ঘোষণা করেন, যার পরবর্তী ১৫ মাসে ইসরাইলি হামলায় ৪৬ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়।

ইসরাইল লেবানন, ইয়েমেন ও সিরিয়ায় আক্রমণ, বোমা হামলা ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। ২০২৪ সালের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে।

৮৯ শতাংশ ইসরাইলিই মনে করে, গাজায় তারা ব্যর্থ : জরিপ

রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দলের সাবেক মধ্যপ্রাচ্য দূত অ্যারন ডেভিড মিলার মিডল ইস্ট আইকে বলেন, নেতানিয়াহু সম্পর্কে মত যা-ই হোক না কেন, তিনি ইসরাইলের ইতিহাসে সবচেয়ে দক্ষ রাজনীতিক।

মিলার বলেন, ‘তিনি সবচেয়ে কৌশলী, সবচেয়ে দক্ষ ও সবচেয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, যে কারণে তিনি দীর্ঘ সময় ধরে ইসরাইলি রাজনীতিতে একটি প্রাসঙ্গিক এবং বিশ্বাসযোগ্য শক্তি হিসেবে টিকে থাকতে পেরেছেন।’

তাহলে প্রশ্ন হলো—বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কীভাবে এমন প্রভাব বিস্তার করেছেন, বিশেষ করে রাজনীতিতে প্রবেশের আগে এবং আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে?

নেতানিয়াহুকে পশ্চিমতীর উড়িয়ে দেয়ার স্বাধীনতা দিলেন ট্রাম্প

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রথম ইসরাইলে জন্ম নেয়া নেতা

ইসরাইলের নেতাদের মধ্যে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ছিলেন প্রথম যিনি এই দেশেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এর আগে অনেক নেতা ইউরোপ থেকে এসেছিলেন, যেখানে তারা এবং তাঁদের পরিবার ইহুদি-বিরোধিতার শিকার হয়েছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, ইসরাইলের ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিন হলোকাস্টে তাঁর বাবা-মা উভয়কেই হারিয়েছিলেন।

এই ধরনের অভিজ্ঞতা ১৯ শতকের শেষদিকে আবির্ভূত ইহুদিবাদকে প্রভাবিত করে এবং ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর দুটি প্রধান ধারায় রূপ নেয়, যা পরবর্তীকালে ইসরাইলি রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে।

শ্রমিক ইহুদিবাদ ছিল মূলত সমাজতান্ত্রিক ধারার, যারা ফিলিস্তিনে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ছিল। এর প্রবক্তাদের মধ্যে ছিলেন ইসরাইলের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন-গুরিয়ন।

নেতানিয়াহুর পদত্যাগ চায় ৬৩ শতাংশ ইসরাইলি

অন্যদিকে, মেনাচেম বেগিনের মতো নেতাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত সংশোধনবাদী ইহুদিবাদ বৃহত্তর ‘ঐতিহাসিক সীমানা’ পর্যন্ত ইহুদি রাষ্ট্র বিস্তারের পক্ষে ছিল, যার মধ্যে জর্ডান নদীর উভয় তীরও পড়ে। এ ধারার আদর্শিক নেতা ছিলেন জেভ জাবোটিনস্কি।

জাবোটিনস্কি বলেছিলেন, ‘[আরবদের সঙ্গে] চুক্তিতে পৌঁছানোর একমাত্র উপায় একটি লৌহ প্রাচীর – এমন একটি শক্তি গঠন করা, যেটি আরব প্রভাব দ্বারা ভেঙে যাবে না।’ তিনি ইরগুন নামক সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা ছিলেন এবং ১৯৪০ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত এ গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেন।

এই ধারার মধ্যেই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর জন্ম ১৯৪৯ সালের ২১ অক্টোবর তেল আবিবে। তাঁর পরিবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসার তিন বছর পর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মা জিলা সেগাল অটোমান-শাসিত ফিলিস্তিনে বেড়ে ওঠেন এবং তাঁর বাবা বেনজিয়ন নেতানিয়াহু জন্মগ্রহণ করেন ওয়ারশতে। পরিবারটি ধর্মনিরপেক্ষ হলেও বাইবেলের ইতিহাস তাদের আদর্শ গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

সিরিয়াকে বিভক্ত করার পরিকল্পনা ইসরাইলের

ইতিহাসবিদ বেনজিয়ন ছিলেন জাবোটিনস্কির ব্যক্তিগত সচিব। তাঁর পরামর্শদাতার মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন যে বেন-গুরিয়ন ব্রিটিশ এবং আরব উভয়ের সঙ্গেই খুব বেশি সমঝোতা করছেন—যাদের বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পরাজিত করতে হবে, ইসরাইল গঠনের জন্য।

১৯৯৮ সালে নিউ ইয়র্কের সাংবাদিক ডেভিড রেমনিক লিখেছিলেন, ‘যেখানেই আমি জেরুজালেমে গিয়েছি, সবাই বলেছে—বিবিকে বুঝতে হলে, আপনাকে তাঁর পিতাকে বুঝতে হবে।’

ফিলিস্তিনি আরবদের প্রতি বেনজিয়নের মনোভাব ছিল জীবনভর আপোষহীন। ২০০৯ সালে, মৃত্যুর তিন বছর আগে, ১০২ বছর বয়সে তিনি ইসরাইলি পত্রিকা ‘মারিভ’-এর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘[ইসরাইলি] আরবদের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা যদি সুযোগ পায়, তবে তারা আমাদের নিশ্চিহ্ন করতে চাইবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাইবেলে মরুভূমির মানুষের চেয়ে খারাপ চরিত্র আর নেই। কেন? কারণ তারা কোনো আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রাখে না, মরুভূমিতে যা খুশি তাই করে। সংঘাতপ্রবণতা আরবদের মূলে আছে—তারা মূলত শত্রু।’

ইসরাইলের বড় শত্রু এখন নেতানিয়াহু

ইসরাইলি আলোচক ও বিশ্লেষক ড্যানিয়েল লেভি মিডল ইস্ট আইকে বলেন, নেতানিয়াহুর আদর্শিক বিশ্বদৃষ্টিকে অবমূল্যায়ন করা যাবে না, যেটি তাঁর শৈশবে গঠিত হয়েছিল। তাঁকে কেবল সুবিধাবাদী হিসেবেও দেখা ঠিক হবে না।

লেভি বলেন, ‘রাজনৈতিক বাতাস যদি তাঁর ক্যারিয়ারের জন্য অন্য দিকে বইত, তাহলেও তিনি কোনো দিন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নেতানিয়াহু হতেন না।’

নেতানিয়াহু কেন আবার গাজায় হামলা শুরু করলেন

বৃহত্তর ইসরাইল : স্বদেশকে প্রসারিত করুন

বেনজিয়ন ইসরাইলি রাষ্ট্রের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের প্রতি ছিলেন সম্পূর্ণ নিবেদিত। তবে তাঁর সন্তানেরা, বিশেষ করে বেনিয়ামিন, এটি প্রথমে দূর থেকে অনুভব করতেন।

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, তাঁর ভাই ইয়োনি (ইয়োনাতান) এবং অন্য ভাইবোনেরা শৈশবের বড় একটি অংশ পেনসিলভানিয়ায় কাটান, যেখানে তাঁদের বাবা ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৮ এবং আবার ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত একটি ইহুদি কলেজে পড়াতেন।

নেতানিয়াহু মনে করতেন তিনি আট বছর বয়সে নিউ ইয়র্কে আসার সময় কেবল হিব্রু ভাষায় কথা বলতেন, কিন্তু পরে তাঁর এক বন্ধু তাঁকে ‘সম্পূর্ণ আমেরিকানো’ হিসেবে বর্ণনা করেন। প্রতি গ্রীষ্মে ইসরাইলে গেলেও, তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ যুক্তরাষ্ট্রে দেখতেন।

মার্কিন ইহুদিরা কেন ইসরায়েল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে

বেনজিয়নের প্রভাব তাঁর মনে ‘উদারপন্থী, ডেমোক্র্যাট-ভোটার আমেরিকান ইহুদিদের’ প্রতি ঘৃণা তৈরি করে। ১৪ বছর বয়সেই তিনি ইসরাইলে থাকা তাঁর বামপন্থী বন্ধুদের সমাজতন্ত্রের কুফল সম্পর্কে বক্তৃতা দিতে শুরু করেন এবং তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবনে এই বাগবিতণ্ডাগুলিকে বহন করে চলেন।

শৈশবের একটি দুর্ঘটনা তাঁর ঠোঁটে একটি চিহ্ন রেখে যায়, যা তিনি ঢাকার চেষ্টা করতেন, কিন্তু যা তাঁর বিরোধীদের কাছে তাঁর চিরচেনা ট্রেডমার্ক হাসি হিসেবে ধরা দিত।

নেতানিয়াহুর বড় ভাই ইয়োনির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কও কালের সঙ্গে গভীর হয়। উজি বেলার বলেন, ‘ইয়োনি ছিল পরিবারের তারকা। মা-বাবাও তা অস্বীকার করেননি। তারা শক্তি ও ক্ষমতার খুব কদর করতেন।’

মার্কিন-ইসরাইল সম্পর্ক কি তবে ভেঙ্গে যাচ্ছে

১৯৬৭ সালে, ইসরাইল যখন মিশর, সিরিয়া ও জর্ডানের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তখন নেতানিয়াহু দেশে ফিরে এসে অংশ নেন। তিনি ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন।

এই যুদ্ধকে তিনি ‘ইসরাইলের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিজয়’ হিসেবে বর্ণনা করেন। যুদ্ধটি তাঁর এবং দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় ছিল। তখনও পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম ও গাজা যথাক্রমে জর্ডান ও মিশরের নিয়ন্ত্রণে ছিল, যেগুলিকে সংশোধনবাদীরা বৃহত্তর ইসরাইলের অংশ হিসেবে দেখতেন। কিন্তু ১৯৬৭ সালে ইসরাইল সেগুলি এবং সিনাই দখল করে। এ যুদ্ধ সংশোধনবাদী ইহুদিবাদীদের কাছে সম্প্রসারণ ও সুযোগের দ্বার খুলে দেয়।

এরপর পশ্চিম তীর, গাজা, সিনাই ও পূর্ব জেরুজালেমে ইহুদি বসতি স্থাপন ত্বরান্বিত হয়—যদিও আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তা অবৈধ ছিল। এটি তখন থেকেই ডানপন্থীদের মূল ইস্যু হয়ে দাঁড়ায় এবং আজও তা বহাল।

ঢাকায় ‘মার্চ ফর গাজা’: নেতানিয়াহু, ট্রাম্প ও মোদির ছবিতে জুতা মেরে ক্ষোভ প্রকাশ

নেতানিয়াহু একবার যুক্তরাষ্ট্রে বলেন, ‘জুডিয়া ও সামারিয়ায়, ইহুদি জনগণ কোনো বিদেশি দখলদার নয়।’ তিনি ২০১১ সালে কংগ্রেসে এই শব্দগুলো উচ্চারণ করেন, পশ্চিম তীরকে ইসরাইলের পূর্বপুরুষদের ভূমি বলে অভিহিত করে।

তিনি বলেন, ‘আমরা ভারতে ব্রিটিশ নই, কঙ্গোতে বেলজিয়ান নই। এটাই আমাদের পূর্বপুরুষদের ভূমি—ইসরাইলের ভূমি, যেখানে আব্রাহাম এক ঈশ্বরের ধারণা এনেছিলেন, যেখানে দাউদ গোলিয়াথের মুখোমুখি হয়েছিলেন এবং যেখানে ইশাইয়া চিরন্তন শান্তির দর্শন দিয়েছিলেন।’

এটি ছিল না তাঁর একমাত্র যুদ্ধ। ১৯৭২ সালে নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান, কিন্তু ১৯৭৩ সালে ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধের সময় মিশর ও সিরিয়ার পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে লড়াই করতে ইসরাইলে ফিরে আসেন।

তিনি সেনাবাহিনীর অভিজাত ইউনিট সায়েরেত মাতকালে কাজ করতেন, যেটি তৎকালীন শ্রেণীবদ্ধ ইউনিট ছিল। সেখানে তাঁর ভাই ইয়োনাতান, ইদ্দো এবং তাঁর ভবিষ্যৎ প্রতিপক্ষ ডালিয়া রবিন (ইতজাক রবিনের কন্যা) ছিলেন।

নেতানিয়াহুর মাধ্যমেই কি মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্যবাদ পুনর্গঠন করবেন ট্রাম্প

সায়েরেত মাতকাল ছিল ১৯৭২ সালে তেল আবিব বিমানবন্দরে হাইজ্যাকারদের হাত থেকে সাবেনা বিমান উদ্ধার অভিযানসহ নানা অভিযানে যুক্ত। এ ইউনিট PLO ও ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর গ্রুপের সদস্যদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডেও অংশ নেয়, যারা ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিকে ইসরাইলি ক্রীড়াবিদদের গণহত্যার জন্য দায়ী ছিল।

নেতানিয়াহু পরে তাঁর ভাই ইয়োনির উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেন, ‘জাতি কতটা শক্তিশালী এবং সংকটের মুহূর্তে কতটা মহান হতে পারে।’

তুরস্কের কাছে এফ-৩৫ বিক্রির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে কেন তদবির করছেন নেতানিয়াহু

ইয়োনি নেতানিয়াহু : ভাইদের দল

১৯৭৬ সালের জুনের শেষদিকে, তেল আবিব ও প্যারিসের মধ্যবর্তী একটি এয়ার ফ্রান্স ফ্লাইট হাইজ্যাক করে পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইন – এক্সটার্নাল অপারেশনস। তারা ইসরাইল ও অন্যান্য দেশে আটক ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের মুক্তির দাবি জানায়। বিমানটি উগান্ডার এন্টেবে বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে হাইজ্যাকারদের সহায়তা করেছিল স্বৈরশাসক ইদি আমিন ও তার সৈন্যরা। জিম্মিদের উদ্ধার অভিযানে নেতৃত্ব দেন ইয়োনি নেতানিয়াহু—যিনি ছিলেন ইসরাইলি বাহিনীর একমাত্র নিহত সদস্য।

তার মৃত্যুর পর, ইয়োনিকে গোটা ইসরাইলে মহান সম্মাননা দেওয়া হয় এবং তিনি একপ্রকার পৌরাণিক মর্যাদা অর্জন করেন। নেতানিয়াহুর জীবনীকার আনশেল ফেফার বলেন, তিনি আজও ইসরাইলের সবচেয়ে সাহসী যুদ্ধনায়ক হিসেবে বিবেচিত হন।

মিশরের অর্থনীতিকে যেভাবে চাপে ফেলছেন নেতানিয়াহু

ইয়োনির স্মরণসভায় বক্তব্য দিতে গিয়ে তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী শিমন পেরেস—যিনি পরে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন—বলেন, ‘একটি গুলি ইসরাইলের শ্রেষ্ঠ পুত্রদের একজন, সবচেয়ে সাহসী যোদ্ধাদের একজন এবং প্রতিশ্রুতিশীল কমান্ডারদের একজন, মহৎ ইয়োনাতান নেতানিয়াহুর তরুণ হৃদয় ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।’

২০১৬ সালে নেতানিয়াহু বলেন, ইয়োনির মৃত্যু তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এমনকি এটিকে তিনি তার ‘রাজনৈতিক জীবনের সূচনা’ বলেও আখ্যায়িত করেন। মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার সময় তিনি যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন এবং নিউ ইয়র্কের ইথাকা থেকে সাত ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে তার বাবা-মাকে এই ‘অবর্ণনীয় যন্ত্রণার ভিয়া ডোলোরোসা’ পাড়ি দিয়ে তা জানাতে হয়।

‘যদিও ইয়োনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন, তিনি কখনোই এটি শুধুই একটি সামরিক সংঘাত মনে করেননি,’ লিখেছেন নেতানিয়াহু। ‘তিনি এটিকে সভ্যতা ও বর্বরতার মধ্যকার এক রাজনৈতিক ও নৈতিক লড়াই হিসেবেও দেখতেন। এখন আমি নিজেও সেই লড়াইয়ে সম্পৃক্ত।’

ফেফার উল্লেখ করেন, নেতানিয়াহু পরিবার পরবর্তী বছরগুলোতে ইয়োনির উত্তরাধিকার নিয়ে একপ্রকার আবেগপ্রবণ আচরণ করে। তারা দীর্ঘকাল ধরে সায়েরেত মাতকাল-এর অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত থাকেন—এন্টেবে অভিযানে ইয়োনির ভূমিকাকে প্রাধান্য দেওয়ার উদ্দেশ্যে।

গাজা যুদ্ধ নেতানিয়াহুর টিকে থাকার কৌশল : শিন বেট প্রধান

নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও মিত্র মোশে আরেন্স পরবর্তীতে বলেন, পরিবারটি এই উত্তরাধিকার নিয়ে এমনভাবে ‘আচ্ছন্ন’ হয়ে পড়েছিল যে তারা অভিযানের প্রকৃত পরিকল্পনাকারী ড্যান শোমরনের বিরুদ্ধে ইয়োনির কৃতিত্ব ‘চুরি’ করার অভিযোগ তুলে তাকে অবমাননা করার চেষ্টা করেছিল।

ফেফার বলেন, ‘ইয়োনির উত্তরাধিকার যতই মর্যাদার হোক না কেন, বেনিয়ামিনের জন্য তা কখনোই যথেষ্ট ছিল না। তার কাছে জাতীয় ইতিহাস, পারিবারিক ইতিহাস এবং নিজের ব্যক্তিগত ইতিহাস—সবই একাকার।’

কেন হামাস আত্মসমর্পণ করবে না

বেন নিতাই : মার্কিন মুক্তবাজার

পরবর্তী কয়েক বছরে, নেতানিয়াহু নিজেকে পুনঃউপস্থাপন করেন এক বিশেষজ্ঞ হিসেবে—যিনি যুদ্ধ নয়, বরং সন্ত্রাসবাদ ও আরব সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর হুমকি নিয়ে কথা বলেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ইয়োনাতান নেতানিয়াহু ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ টেররিজম।

একই সঙ্গে তিনি একাডেমিক আগ্রহে বস্টনের এমআইটিতে পড়াশোনা শুরু করেন। এমআইটির স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক লিওন বি. গ্রোইসার স্মরণ করেন, তার অফিসে প্রথমবার ২৩ বছর বয়সী নেতানিয়াহুর আগমন ঘটে। পরে তিনি তার ফ্যাকাল্টি অ্যাডভাইজর হন।

‘তিনি খুব স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে তার স্নাতক সম্পন্ন করার জন্য চার বছর সময় নেই,’ বলেন গ্রোইসার। ‘তিনি সাহসিকতা নয়, বাস্তবতা হিসেবে বলেছিলেন। অতিরিক্ত পরিশ্রমে তিনি এগিয়ে যান এবং দুর্দান্ত ফল করেন।’ ১৯৭৩ সালের যুদ্ধের মাঝখানে অংশ নিয়েও নেতানিয়াহু আড়াই বছরে স্থাপত্যে ডিগ্রি অর্জন করেন।

গাজায় টেকসই যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনা কতটুকু?

যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন নেতানিয়াহু নিজের নাম পরিবর্তন করে ‘বেন নিতাই’ রাখেন—যা ইসরাইলের ‘মাউন্ট নিতাই’র প্রতি ইঙ্গিতবাহী এবং তার পিতার লেখালেখির ছদ্মনামের প্রতিধ্বনিও বটে। যদিও তিনি দাবি করেন, নাম পরিবর্তনের কারণ ছিল আমেরিকানদের জন্য উচ্চারণ সহজ করা; কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা পরবর্তীতে বলেন, এতে বোঝা যায় তিনি দেশে ফেরার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রেই স্থায়ী হতে চেয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের সময় এ নিয়ে নেতানিয়াহুর ‘অন্ধকার অতীত’ নিয়ে সন্দেহও উঁকি দেয়।

১৯৭৬ সালের গ্রীষ্মে, তার ভাইয়ের মৃত্যুর মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে, নেতানিয়াহু বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপে অর্থনৈতিক পরামর্শক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইল দুই দেশেই যাতায়াত করেন। এখানেই তিনি মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রবল সমর্থক হয়ে ওঠেন এবং ইসরাইলের লেবার পার্টির সমাজতান্ত্রিক নীতির ঘোর বিরোধিতায় নামেন।

পরবর্তী কয়েক দশকে ক্ষমতায় এসে তিনি ব্যাপক বেসরকারিকরণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তিনি প্রভাবশালী হিস্টাড্রুট ট্রেড ইউনিয়নকে উপহাস করে বলেন ‘বলশেভিক ডাইনোসর’, বৈদেশিক মুদ্রার নিয়ম শিথিল করেন এবং ইসরাইলকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।

গাজায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই : নেতানিয়াহু

বিসিজিতে থাকাকালে তার পরিচয় হয় মিট রমনির সঙ্গে—যিনি পরে ২০১২ সালে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হন। রমনি একবার স্মৃতিচারণ করে বলেন, নেতানিয়াহু তাকে একটি মৌলিক শিক্ষার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন—একজন অতিরিক্ত ওজনের সেনাকে কাঁধে নিয়ে দৌড়ানো একজন সৈনিক তার সতীর্থদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। তখন নেতানিয়াহু বলেন, ‘সরকার হলো তোমার কাঁধে থাকা লোকটা।’

তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারকে—আরেকজন ছোট সরকারের প্রবক্তা—‘ইসরাইল ও ইহুদি জনগণের একনিষ্ঠ বন্ধু’ বলে প্রশংসা করেন।

যুক্তরাষ্ট্রে থাকলেও তিনি ইসরাইলের পক্ষে সক্রিয়ভাবে প্রচার চালান, এবং মিডিয়ার মাধ্যমে সেই প্রচারণা চালান—যার শক্তিকে তিনি ক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে চিনতে শেখেন।

ইসরাইলের ভেতরেই বাজছে ভাঙনের সুর

১৯৭৮ সালে, তখন ‘বেন নিতাই’ নামধারী নেতানিয়াহু বোস্টনের ‘দ্য অ্যাডভোকেট’ টিভি বিতর্ক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। সেখানে তিনি যুক্তি দেন, মধ্যপ্রাচ্যে সংকটের মূল কারণ ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অভাব নয়—বরং আরব রাষ্ট্রগুলোর ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি।

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের বিরোধিতা করা উচিত। কারণ একদিকে এটি ২২তম আরব রাষ্ট্র ও দ্বিতীয় ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের দাবি, যা একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্রের বিনিময়ে করা অন্যায্য দাবি।

‘আমি বিশ্বাস করি, আমাদের টিকে থাকার জন্য লড়তে হবে। যদি লড়াই করতে হয়, আমি লড়ব, তবে আশা করি তা আর করতে না হয়।’

গাজা যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে গণস্বাক্ষর ১ লাখ ৪০ হাজার ইসরাইলির

রাষ্ট্রদূত বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু : ক্ষমতার দালাল

১৯৮০ সালের মধ্যে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইসরাইলে ফিরে আসেন। সে সময় তিনি রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়েন এবং ‘রিম ইন্ডাস্ট্রিজ’ নামের একটি আসবাবপত্র কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন।

তবে মাত্র দুই বছর পর তাঁর জীবনে নাটকীয় পরিবর্তন আসে।

লিকুদ পার্টির প্রবীণ রাজনীতিক মোশে আরেন্স—যিনি বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পারিবারিক বন্ধু এবং তাঁর চেয়ে দুই দশক বড়—তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিজের ডেপুটি করার প্রস্তাব দেন। দুজনেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছেন এবং এমআইটি থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেছেন। ১৯৮২ সালে নেতানিয়াহু এই প্রস্তাবে রাজি হন।

এ সময় আন্তর্জাতিক মহলে ইসরাইলের ভাবমূর্তি তলানিতে। ওই গ্রীষ্মেই ইসরাইল পিএলও-কে নির্মূল করতে লেবাননে আক্রমণ চালায় এবং হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। সবচেয়ে কুখ্যাত ঘটনা ছিল বৈরুতের সাবরা ও শাতিলা শরণার্থী শিবিরে গণহত্যা, যেখানে ইসরাইলি সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে খ্রিস্টান মিলিশিয়ারা প্রায় ৩,৫০০ ফিলিস্তিনি ও লেবানিজ নারী, শিশু ও পুরুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে।

নেতানিয়াহুই ইসরাইলের শত্রু, তাকে বন্দী করা উচিত : সাবেক সেনাপ্রধান

ওয়াশিংটনে রাষ্ট্রদূতের দপ্তরে কাজ করতে গিয়ে নেতানিয়াহু দ্রুতই গণমাধ্যমের পছন্দের মুখ হয়ে ওঠেন। সিএনএনের উলফ ব্লিটজার ১৯৯৬ সালে ভ্যানিটি ফেয়ার–এ বলেন, “আমি অনেক রাষ্ট্রদূত কভার করেছি, তবে তিনি ছিলেন সেরাদের মধ্যে সেরা।” ল্যারি কিং বলেছিলেন, “তিনি একজন দারুণ অতিথি—যদি তার রসবোধ থাকত, তাহলে তিনি অতুলনীয় হতেন।”

এই সফলতার ধারাবাহিকতায় ১৯৮৪ সালে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জাতিসংঘে ইসরাইলের স্থায়ী প্রতিনিধি নিযুক্ত হন। জিউইশ টেলিগ্রাফিক এজেন্সি তখন লিখেছিল, “তিনি হেরুত পার্টিতে উদীয়মান এক তারা—যদি রাজনীতিতে যান, তবে সেখানে তার ভবিষ্যৎ আছে।”

১৯৮৪ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে জর্ডানের রাষ্ট্রদূত খালিদ মাদাদা পশ্চিম তীরে ইসরাইলি শাসনের তুলনা নাৎসি দখলের সঙ্গে করেন। এর জবাবে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিজেকে হলোকাস্টে নিহত ছয় মিলিয়ন ইহুদির প্রতিনিধি ঘোষণা করে বলেন, “মিথ্যা বলো, কিন্তু কখন থামতে হবে তা শিখে নাও।”

গাজা যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জন করা অসম্ভব : ইসরাইলি সেনাপ্রধান

রাষ্ট্রদূত থাকাকালীনই বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিউ ইয়র্কের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ফ্রেড ট্রাম্পের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন—যাঁর ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প পরে হোয়াইট হাউসের ও নেতানিয়াহু ইসরাইলের শীর্ষ পদে আসীন হন, এবং দুজনই একে অপরের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হয়ে ওঠেন।

১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, তিনি জাতিসংঘের সর্বকনিষ্ঠ প্রতিনিধিদের একজন এবং প্রথম ইসরাইলি বংশোদ্ভূত যিনি তাঁর দেশকে সেখানে প্রতিনিধিত্ব করছেন।

জাতিসংঘে ইসরাইল-বিদ্বেষী মনোভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “যতক্ষণ গণতান্ত্রিক দেশগুলো—বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র—জাতিসংঘে থাকে, ততক্ষণ এই ফোরামে থাকা ইসরাইলের জাতীয় স্বার্থে জরুরি।”

তিনি জাতিসংঘে ‘সোভিয়েত-আরব ব্লক’–এর বিরুদ্ধে অবস্থানের কথা উল্লেখ করেন এবং ইরানের প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করার গর্ব প্রকাশ করেন, যারা ইসরাইলের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়।

সিরিয়ায় সম্ভাব্য সঙ্ঘাত এড়াতে আলোচনায় তুরস্ক ও ইসরাইল

সন্ত্রাসবাদকে তিনি “গণতান্ত্রিক সমাজ ধ্বংসের অস্তিত্বগত হুমকি” হিসেবে বর্ণনা করেন এবং বলেন, “সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো—এটি যুদ্ধের একটি রূপ, এবং আমাদের তা অনুযায়ীই মোকাবিলা করতে হবে। সন্ত্রাসীরা ছাড় চায় না, তারা আত্মসমর্পণ চায়। তাই প্রথম নিয়ম হলো: আত্মসমর্পণ নয়।”

নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ১৯৮৮ সালের আগে মোমেন্ট ম্যাগাজিনে তিনি বলেন, তিনি ইহুদি সংস্থা ও বিশ্ব জায়নিস্ট সংস্থার শীর্ষ পদে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন, যদিও তা দেশের ভেতরেই ছিল।

তবে তাতে তাঁর ইসরাইলে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ কমেনি। “আমি গত পাঁচ বছর দেশের বাইরে কাটিয়েছি। আমি ফিরে যেতে চাই এবং আমার সময়টা ইসরাইলেই কাটাতে চাই।”

শেষ হওয়ার জন্যই কি জ্বলে উঠছে ইসরাইল

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু : ইসরাইলি রাজনীতিবিদ

১৯৮৮ সালে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইসরাইলে ফিরে আসেন, লিকুদ পার্টিতে যোগ দেন এবং নেসেটের সদস্য নির্বাচিত হন। ডানপন্থী অনেক নেতার মতো, তিনিও ইসরাইলি সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্য এবং গভীর ইহুদি জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারার প্রবক্তা।

তবে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি একটু ভিন্ন ছিল—তাঁর মতে, সন্ত্রাসবাদের উৎস আঞ্চলিক সরকার নয়, বরং আন্তর্জাতিকভাবে সহানুভূতি পাওয়া এমন এক গোষ্ঠী, যারা তাঁর ভাইকে হত্যা করেছে।

লেবানন দখল এবং সাবরা-শাতিলা গণহত্যায় ইসরাইল আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দার মুখে পড়ে—এমনকি প্রবাসী ইহুদি ও বামপন্থী ইসরাইলিরাও এর বিরোধিতা করেন।

সিরিয়ায় তুরস্কের উপস্থিতি, কেন ভয় পাচ্ছে ইসরাইল

১৯৯১ সালে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ লিকুদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী ইতজাক শামিরকে মাদ্রিদ সম্মেলনে পিএলও-র সঙ্গে আলোচনায় বসতে চাপ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় আসে অসলো চুক্তি (১৯৯৩-৯৫)।

তবে শামিরের বৃহত্তর ইসরাইল গড়ার স্বপ্ন শেষমেশ দলের ভরাডুবি ডেকে আনে। ১৯৯৩ সালে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু লিকুদের নেতৃত্বে আসেন এবং চুক্তি, দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান, এমনকি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠনেরও বিরোধিতা করেন। নিউ ইয়র্ক টাইমস–এ তিনি লিখেছিলেন, “শান্তিকে সুযোগ দেওয়া মানে ভবিষ্যতের সন্ত্রাস ও যুদ্ধের নিশ্চয়তা।”

১৯৯০-এর দশকে ইসরাইল গভীরভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে। অসলো চুক্তি, প্রধানমন্ত্রীর হত্যা ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টির হঠাৎ পরাজয় সেই বিভাজনকে চূড়ান্ত করে তোলে।

আসাদ-পরবর্তী সিরিয়া নিয়ে যে কারণে সঙ্ঘাতে জড়াতে পারে তুরস্ক-ইসরাইল

গত তিন দশকে সেই বিভাজন আরও গভীর হয়েছে। ইসরাইলি জনমত ডান দিকে সরে গেছে, জ্যাভ জাবোটিনস্কি ও বেনজিওন নেতানিয়াহুর মতাদর্শিক ইহুদিবাদ এর ভিত্তি হয়েছে।

একই সময়ে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিজের ক্ষমতাকে আরও সুসংহত করেছেন এবং আধুনিক ইসরাইলের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হয়ে উঠেছেন।

১৯৯৬ সালে তাঁর প্রথম ক্ষমতাগ্রহণের আগে গত ৫০ বছরে ইসরাইলের সাতজন লেবার পার্টির নেতা ছিলেন। এরপরের ৩০ বছরে মাত্র একজন—এহুদ বারাক—মাত্র ২০ মাসের জন্য।

গত ১৫ মাসে তিনি গাজায় একাধিকবার সামরিক অভিযান চালিয়েছেন। অবৈধ বসতি সম্প্রসারণ আরও বেড়েছে। ফিলিস্তিনিদের অধিকার বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে, এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন আরও দূরে সরে গেছে।

সিরিয়াকে কেন ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায় ইসরাইল

বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রতিটি পদক্ষেপ আপসের বিপরীতে গেছে। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে, এবং অভিযোগ রয়েছে তিনি বিচার ব্যবস্থাকে দুর্বল করে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করছেন।

বিরাট আন্দোলনের মুখেও তিনি পিছু হটেননি। গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধকালীন জিম্মিদের মুক্তির চেয়ে হামলা চালানোয় তিনি নিজ দেশেও তীব্র সমালোচিত হন।

অনেকবার তাঁর পতনের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে—কখনো সফল হয়নি। আবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টরা তাঁর প্রতি আরও সহানুভূতিশীল প্রমাণিত হয়েছেন ডেমোক্র্যাটদের তুলনায়।

সিরিয়া কি তবে ইসরাইলে আক্রমণ করে বসবে

শেষ পর্যন্ত ইতিহাস কীভাবে তাঁকে মনে রাখবে?

“ইসরাইল রাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রধানমন্ত্রী,” মন্তব্য করেন বিশ্লেষক মিলার, “এবং কোনো সন্দেহ ছাড়াই—সবচেয়ে খারাপ প্রধানমন্ত্রী।”

সূত্র : মিডল ইস্ট আই

তুরস্ক ও ইসরাইলের মাঝে সঙ্ঘাতের আশঙ্কা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top