সম্পাদকীয় ডেস্ক
একটি বিষয় একইসাথে দুটি পরস্পরবিরোধী অবস্থায় থাকতে পারে না—যেমন কিছু চুরি করা এবং তা ক্রয় করা, কাউকে অপমান করা এবং সম্মান করা, কিংবা ধর্ষণ ও বিয়ে—এই সবকিছুই পরস্পরবিরোধী এবং একই সাথে একই ব্যক্তির বেলায় একই সময়ে ঘটতে পারে না। কিন্তু আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতা কিছু ধারণা তৈরি করছে যা এই মৌলিক যুক্তিবোধকে চ্যালেঞ্জ করে, যার মধ্যে একটি হলো ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’। তাদের মতে, স্ত্রী যদি মানসিক, মৌখিক বা শারীরিকভাবে সম্মত না হন, তাহলে স্বামীর সাথে তার শারীরিক সম্পর্কও ধর্ষণের পর্যায়ে পড়ে। এমনকি স্বামী যদি স্ত্রীর ওপর কোনো মানসিক চাপ দেয়—যেমন অন্য বিয়ের হুমকি, তালাকের ভয়—তাও ধর্ষণের আওতায় পড়ে। অথচ এখানে শারীরিক নির্যাতনের কোনো বিষয়ই নেই, কেবল সম্মতির অভাব থাকলেই সেটি ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
ইতিহাসে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ নামে কোনো অপরাধ বা ধারণা ছিল না। যুগে যুগে বিয়ের মাধ্যমে নারী স্বামীর সহবাসের অধিকারকে স্বীকার করে নিয়েছে। এই ধারণাটি মূলধারায় আসে ১৯৭০-৮০’র দশকে দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদী আন্দোলনের সময়। ১৯৭৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Nebraska রাজ্যে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ প্রথম আইনি অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। এরপর ধীরে ধীরে এটি বিভিন্ন দেশের আইনেও প্রবেশ করে। অথচ এই একই সমাজে কোনো নারী তার স্বামী ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে ইচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক করলে, তা অপরাধ নয়। কারণ, তাদের আইনের ভিত্তি হলো “ব্যক্তির ইচ্ছা”—যা দৃশ্যমান বা প্রমাণযোগ্য নয়। ফলে কেউ ইচ্ছায় কিছু করেও পরে অস্বীকার করলে তা অপরাধে রূপ নিতে পারে, এবং একজন নির্দোষ পুরুষ শাস্তি পেতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, Penal Code 1860-এর ধারা ৩৭৫ অনুযায়ী, যদি স্ত্রী ১৩ বছরের বেশি বয়সী হন, তাহলে তার সঙ্গে স্বামীর শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণ বলা যাবে না যদি তার সম্মতি না থাকে। বাংলাদেশের আইনে এখনো বৈবাহিক ধর্ষণ নামে কিছু নেই। তবে মানবাধিকার কর্মী ও নারীবাদী সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে এটি আইনত অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। ইসলাম এই বিষয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে। বিয়ের মাধ্যমে স্ত্রী ও স্বামী উভয়ে পরস্পরের যৌন অধিকার স্বীকার করে নেয়। এটি পারস্পরিক অধিকার ও দায়িত্ব। স্বামী বা স্ত্রী কেউই অকারণে অপর পক্ষকে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্রস্বরূপ, অতএব তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেমন ইচ্ছা আসো।’ (সূরা আল-বাকারা: ২২৩)
পুরুষদের শরীরে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা নারীদের তুলনায় ৭–১০ গুণ বেশি। এই হরমোন যৌন চাহিদা ও উদ্দীপনার জন্য মূল ভূমিকা পালন করে। পশ্চিমা গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষরা দিনে গড়পড়তায় ৫-৬ বার যৌন চিন্তা করেন এবং যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে নারীদের তুলনায় অনেক বেশি আগ্রহী হন। ফলে স্বাভাবিকভাবে স্ত্রী যদি যৌন চাহিদা পূরণে অস্বীকৃতি জানায়, তবে দাম্পত্য সম্পর্কে দূরত্ব, বিরোধ, এমনকি বিবাহ বিচ্ছেদও ঘটতে পারে। অনেক স্বামী এতে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন, যা স্ত্রী ও সন্তানের জন্য ক্ষতিকর হয়। এক্ষেত্রে সমাজে ধর্ষণ, শিশুর প্রতি যৌন সহিংসতা, ও উত্ত্যক্ততা বাড়ে। বৈধ চাহিদা অপূর্ণ থাকলে পুরুষেরা বিয়ে বিমুখ হয়, পরিবারবিহীন প্রজন্ম গড়ে ওঠে, এবং সমাজে বিকৃত যৌনতা বিস্তার লাভ করে—যার উদাহরণ পশ্চিমা বিশ্ব।
তাই যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে কথা বলা জরুরি হলেও সেটি হওয়া উচিত নির্যাতনের নির্দিষ্ট বাস্তবতায়; শুধু সম্মতির যুক্তিতে নয়। বৈধ বৈবাহিক সম্পর্ককে ‘ধর্ষণ’ বলে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো ইসলামি শরিয়াহ ও সমাজের জন্য একটি হুমকি। ইসলামী দৃষ্টিকোণ ও একটি সুস্থ সমাজব্যবস্থা উভয়ের পক্ষ থেকেই marital rape-এর মতো ধারণা গৃহীত হতে পারে না।