জলবায়ু, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধে ইসলামের নির্দেশনা

আহমেদ নিঝুম

বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বর্তমান পৃথিবীর অন্যতম ভয়াবহ সংকট। এর কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, কৃষি বিপর্যয়, খরা, বন্যা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস ও আবাসস্থল হুমকির মুখে পড়ছে। এর মূল কারণ হলো মানবসৃষ্ট পরিবেশদূষণ, অপচয় ও অব্যবস্থাপনা। অথচ ইসলাম এই সংকট থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করার জন্য বহু আগেই পরিবেশ রক্ষার নৈতিক, আধ্যাত্মিক ও ব্যবহারিক দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে।

আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন, “তিনিই আকাশসমূহকে তুলাদণ্ড ছাড়াই স্থাপন করেছেন এবং তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন ভারসাম্য রক্ষা করতে” (সূরা রহমান, আয়াত ৭-৮)। এই ‘মিজান’ বা ভারসাম্য রক্ষার নির্দেশ কেবল সামাজিক বা অর্থনৈতিক নয়, বরং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার নির্দেশও বহন করে। মানুষ প্রকৃতির এই ভারসাম্য নষ্ট করলে তা আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধাচরণ হিসেবেই বিবেচিত হয়।

আল্লাহ তাআলা বলেন, “যখন তারা ফিরে যায়, তখন তারা দেশে অনর্থ সৃষ্টি করে, শস্য ও গবাদিপশুর ধ্বংস সাধন করে। অথচ আল্লাহ অনর্থকে পছন্দ করেন না” (সূরা বাকারা, আয়াত ২০৫)। এ আয়াতে ‘অনর্থ সৃষ্টি’ বলতে আধুনিক ভাষায় বন উজাড়, জলবায়ু দূষণ, অতিমাত্রায় কারখানা স্থাপন ও পরিবেশের অবনতি বুঝানো যেতে পারে।

ইসলাম মিতব্যয়িতা ও মধ্যপন্থার ওপর গুরুত্বারোপ করে। কুরআনে এসেছে: “তোমরা খাও ও পান কর, কিন্তু অপব্যয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপব্যয়কারীদের পছন্দ করেন না” (সূরা আরাফ, আয়াত ৩১)। আধুনিক ভোগবাদ ও অপচয়মূলক জীবনধারার ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা ইসলামী মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

রাসুলুল্লাহ (সা.) পরিবেশবান্ধব জীবনাচরণে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তিনি বলেন, “যে ব্যক্তি একটি গাছ লাগায় এবং তা থেকে মানুষ, পাখি কিংবা পশু উপকৃত হয়, তা তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হয়” (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)। সুতরাং বৃক্ষরোপণ কেবল একটি সামাজিক দায়িত্ব নয়, বরং তা আখিরাতে সওয়াবের মাধ্যমও।

মানুষকে আল্লাহ পৃথিবীতে খলিফা বা প্রতিনিধি বানিয়েছেন (সূরা আন-আম, আয়াত ১৬৫)। এটি শাসনের পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও নির্দেশ করে। আধুনিক ভাষায় তা হলো—টেকসই উন্নয়ন, নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার, পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশবান্ধব নীতি গ্রহণ।

রাসুলুল্লাহ (সা.) অপচয় করতেন না। অল্প পানিতে অজু ও গোসল করতেন, খাবার নষ্ট করতেন না, অকারণে প্রাণী হত্যা করতেন না। তার জীবনের প্রতিটি কাজই ছিল পরিবেশবান্ধব। তিনি বলেছেন, প্রবাহিত নদীতেও অজুর সময় অপচয় না করতে (ইবনু মাজাহ, হাদিস : ৪২৫)।

ইসলামের আরও কিছু নির্দিষ্ট নির্দেশনা আছে, যা বাস্তবায়ন করলে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন রোধ করা সম্ভব হতে পারে। যেমন—

১. ভূমির পরিকল্পিত ব্যবহার: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যার কাছে জমি আছে সে যেন চাষ করে, না পারলে যেন অন্যকে চাষের সুযোগ দেয় (মুসলিম, হাদিস : ৩৭৭৩)। এতে পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় থাকে।

২. বৃক্ষরোপণ ও বনায়ন: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কিয়ামত আসার মুহূর্তেও যদি কারো হাতে গাছের চারা থাকে, সে যেন তা রোপণ করে (বুখারি, আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৪৭৯)।

৩. প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার: পানি ও বাতাস অপচয় না করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। অজুর সময় অপচয় রোধের নির্দেশই তার প্রমাণ।

৪. জীবজন্তুর প্রতি দয়াশীলতা: রাসুল (সা.) বলেন, “প্রত্যেক দয়ার্দ্র হৃদয়ের অধিকারীর জন্য পুরস্কার আছে” (বুখারি, হাদিস : ৫৬৬৩)। জীববৈচিত্র্য রক্ষা পরিবেশের ভারসাম্যের জন্য অপরিহার্য।

৫. বায়ুদূষণ প্রতিরোধ: উন্মুক্ত স্থানে মলমূত্র ত্যাগ নিষেধ (আবু দাউদ, হাদিস : ২৬), মৃত জিনিস মাটিতে পুঁতে ফেলা, দুর্গন্ধ পরিহার, হাঁচি-কাশির সময় মুখ ঢেকে রাখা—সবই পরিবেশ রক্ষার নির্দেশনা।

৬. পানিদূষণ প্রতিরোধ: রাসুল (সা.) বলেন, “কেউ যেন আবদ্ধ পানিতে প্রস্রাব না করে অতঃপর সেখানে গোসল না করে” (বুখারি, হাদিস : ২৩৬; মুসলিম, হাদিস : ৬৮২)।

সবশেষে বলা যায়, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কোনো একক জাতি বা ধর্মের সমস্যা নয়। কিন্তু ইসলাম তার অনুসারীদের অনেক আগেই প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় সচেতন করেছে। পরিবেশ-নাশকতা, অপচয়, ভোগবাদ ও অসচেতনতা পরিহার করে ইসলামের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করলে শুধু মুসলিম নয়, গোটা বিশ্ব উপকৃত হবে। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এই নির্দেশনাগুলো অনুসরণই পারে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী নিশ্চিত করতে। কারণ, প্রকৃতি ধ্বংস মানেই মানবজাতির আত্মবিনাশ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top