ভারতে বিতর্কিত ওয়াকফ বিল ঘিরে পশ্চিমবঙ্গে প্রাণঘাতী বিক্ষোভ, সেনা মোতায়েন

টুডেনিউজ বিডি ডটনেট

ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে সম্প্রতি পাস হওয়া বিতর্কিত ফেডারেল ওয়াকফ সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে দেশটির কর্তৃপক্ষ সেনা মোতায়েন করেছে। সমালোচকরা বলছেন, এই বিলটি মুসলিমদের ধর্মীয় দান—মূল্য ১৪ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি—পরিচালনার অধিকারকে দুর্বল করে দেবে।

টাইমস অফ ইন্ডিয়া জানায়, পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ মুর্শিদাবাদ জেলায় শুক্রবার এবং শনিবার বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করে। এতে তিনজন নিহত হয় এবং ১৫০ জনেরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন রোববার কলকাতা হাইকোর্ট সংশ্লিষ্ট এলাকায় আধাসামরিক সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের “তাৎক্ষণিক” মোতায়েনের নির্দেশ দেয়।

বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ সীমান্ত বিভাগের মহাপরিদর্শক কর্ণী সিং জানান, বাহিনীকে স্বাধীনভাবে কোনো পদক্ষেপ নিতে নয়, বরং স্থানীয় পুলিশকে “সহায়তা” করতে পাঠানো হয়েছে।

উল্লেখ্য, এই মাসের শুরুতে ভারতীয় সংসদের উভয় কক্ষে ব্যাপক বিতর্কের পর ওয়াকফ সংশোধনী বিলটি পাস হয়। ১৯৯৫ সালের মূল আইন অনুযায়ী, ওয়াকফ বলতে এমন ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে বোঝানো হয়—স্থাবর কিংবা অস্থাবর—যা মুসলমানরা ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে স্থায়ীভাবে দান করে থাকে। তবে সংশোধিত আইনে ওয়াকফ সম্পত্তি পরিচালনায় অমুসলিমদের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

সমালোচকদের অভিযোগ, হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করছে, কারণ অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর বিশ্বাস-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অধিকার অক্ষুণ্ণ রয়েছে।

বিজেপি বলছে, সংশোধনী বিলটি ওয়াকফ প্রশাসনে স্বচ্ছতা আনতে এবং দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে লড়াই করার উদ্দেশ্যে আনা হয়েছে। কিন্তু মুসলমানদের আশঙ্কা, নতুন আইনের ফলে ঐতিহাসিক মসজিদ, মাজার, কবরস্থান, দোকান এবং হাজার হাজার একর জমি বাজেয়াপ্ত বা ধ্বংসের ঝুঁকিতে পড়বে।

এই বিলকে মুসলিম সংখ্যালঘুদের ওপর সরাসরি আক্রমণ বলে বর্ণনা করছেন বিরোধীরা। তারা বলছেন, ভারতের ১.৪ বিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ মুসলমান, যাদের অধিকার সংবিধান দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে।

বিরোধী কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন, “এই বিলটি আজকের মুসলমানদের লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছে, কিন্তু ভবিষ্যতে অন্যান্য সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করার জন্য এটি একটি নজির স্থাপন করেছে।”

ধর্মীয় মেরুকরণ ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ধর্মীয় মেরুকরণের মাধ্যমে নির্বাচনী সুবিধা নিচ্ছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। মোদী নিজেকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ধর্মের একজন জোরালো সমর্থক হিসেবে তুলে ধরেছেন।

বিক্ষোভের প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শনিবার শান্ত থাকার আহ্বান জানান এবং বলেন, রাজ্যে তার সরকার এই আইন বাস্তবায়ন করবে না। এক্স (সাবেক টুইটার)-এ দেয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, “এই আইন আমাদের রাজ্যে প্রযোজ্য হবে না। তাহলে দাঙ্গা কেন?”

তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার নির্বাচনী এলাকার জনগণকে “ধর্মের নামে কোনও অ-ধর্মীয় আচরণে” না জড়াতে অনুরোধ করেন এবং আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

অন্যদিকে, পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির নেতা শুভেন্দু অধিকারী দাবি করেছেন, “ধর্মীয় নিপীড়নের” কারণে ৪০০ জনেরও বেশি হিন্দু মুর্শিদাবাদ থেকে পালিয়ে গেছেন। তিনি ব্যানার্জির সরকারকে “উগ্রপন্থী উপাদানদের উৎসাহিত করা” এবং “আইনশৃঙ্খলার ভাঙন অনুমোদন করার” জন্য দায়ী করেছেন।

তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ সৌগত রায় টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে জানান, মুখ্যমন্ত্রী মুসলিম সম্প্রদায়কে শান্ত করার জন্য একটি সভা আহ্বান করেছিলেন। তিনি বলেন, “ওয়াকফ বিল নিয়ে জনগণের অনুভূতি ক্ষুব্ধ। প্রতিক্রিয়া স্বতঃস্ফূর্ত ছিল।”

এই ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা, সংখ্যালঘুদের অধিকার ও রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকা নিয়ে জাতীয় বিতর্ক আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।

সূত্র : আল জাজিরা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top