গত সপ্তাহে, জম্মু ও কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র পহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত হন। এই ঘটনার পর ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দেয়। এর মধ্যে রয়েছে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য বন্ধ করা ও ভিসা কার্যক্রম স্থগিত করা।
নয়াদিল্লি ২২ এপ্রিলের হামলার জন্য ইসলামাবাদকে দায়ী করে সিন্ধু নদীর পানি বণ্টন চুক্তিতে অংশগ্রহণ স্থগিত করেছে এবং পাকিস্তানে নিজেদের কূটনৈতিক মিশন কমিয়ে দিয়েছে।
অন্যদিকে, ইসলামাবাদ ভারতের অভিযোগ অস্বীকার করে হামলার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছে। পাশাপাশি প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তান তৃতীয় দেশগুলোর মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে।
উল্লেখযোগ্য যে, ২০১৯ সাল থেকেই ভারত-পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য স্থগিত রয়েছে।
উভয় দেশই প্রধান স্থল সীমান্ত ওয়াঘা-আটারি ক্রসিং বন্ধ করে দিয়েছে।
তবে সরকারি পরিসংখ্যানে এই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ন্যূনতম দেখালেও, বিশেষজ্ঞদের মতে কোটি কোটি ডলারের একটি গোপন ও বিকল্প পথে চলা বাণিজ্য এখনো অব্যাহত রয়েছে।
তবে প্রকৃত বাণিজ্যের পরিমাণ কত? স্থল সীমান্ত বন্ধ হওয়ায় কি তা প্রভাবিত হবে?
অতীতে কি ভারত-পাকিস্তান মুক্তভাবে বাণিজ্য করত?
হ্যাঁ। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের দেশভাগের পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক শুরু হয়।
১৯৯৬ সালে ভারত পাকিস্তানকে ‘মোস্ট ফেভারড নেশন’ (MFN) মর্যাদা দিলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য জোরদার হয়। WTO-র নিয়ম অনুসারে, MFN মর্যাদা পাওয়া দেশকে সব বাণিজ্যিক সুবিধা সমভাবে দিতে হয়।
তবে পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে দ্বিপাক্ষিক উত্তেজনার কারণে বাণিজ্য কখনোই পূর্ণমাত্রায় এগোয়নি—অন্তত আনুষ্ঠানিকভাবে নয়।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে দু’দেশের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ২.৪১ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরে ছিল ২.২৭ বিলিয়ন ডলার। এই সময় ভারতে পাকিস্তানে ১.৯২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল এবং আমদানি করেছিল ৪৮৮.৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য।
কিন্তু ২০১৯ সালে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন ভারতীয় আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য নিহত হলে ভারত পাকিস্তানের এমএফএন মর্যাদা বাতিল করে।
এরপর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য অর্ধেকে নেমে আসে—২.৪১ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে দাঁড়ায় ১.২ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৯ সালে পাকিস্তান ভারতে যে ৫৪৭.৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল, তা ২০২৪ সালে নেমে দাঁড়ায় মাত্র ৪৮০,০০০ ডলারে।
বর্তমানে ভারত-পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে কতটুকু বাণিজ্য করে?
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ভারতের পাকিস্তানে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৪৭.৭ মিলিয়ন ডলার। একই সময়ে পাকিস্তান থেকে ভারতে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৪২০,০০০ ডলারের পণ্য।
ভারতের প্রধান রপ্তানি পণ্যের মধ্যে রয়েছে: ওষুধ, পেট্রোলিয়াম, প্লাস্টিক, রাবার, জৈব রাসায়নিক, রঞ্জক, শাকসবজি, মশলা, চা-কফি, দুগ্ধজাত পণ্য ও সিরিয়াল।
অন্যদিকে, পাকিস্তান রপ্তানি করে তামা, কাচপাত্র, জৈব রাসায়নিক, সালফার, ফলমূল, বাদাম ও কিছু তেলবীজ।
ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইনজীবী শান্তনু সিং আল জাজিরাকে বলেন, ভারত থেকে পাকিস্তানের প্রধান আমদানি পণ্য হলো ওষুধ, ফলে বাণিজ্য স্থগিতের সরাসরি প্রভাব পড়বে পাকিস্তানের ওষুধ খাতে।
তিনি আরও বলেন, ওয়াঘা-আটারি ইন্টিগ্রেটেড চেক পোস্ট (ICP) বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাণিজ্যের খরচ বাড়বে। কারণ এটি ছিল একমাত্র স্থলবন্দর যা দিয়ে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পণ্য আদান-প্রদান হতো।
“স্থলবন্দর সাধারণত কম খরচে সহজ পরিবহন সুবিধা দেয়। এখন এই বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাণিজ্যের খরচ বাড়বে। এতে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আফগানিস্তান, কারণ তাদের অনেক পণ্য এই পথ দিয়েই যেত। এছাড়া ICP-র আশপাশে যে স্থানীয় অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল তাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে,” বলেন সিং।
তবে কি প্রকৃত বাণিজ্যের পরিমাণ আরও বেশি?
সরকারি তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তানে ভারতের রপ্তানি ৪৪৭.৬৫ মিলিয়ন ডলার হলেও, বিশেষজ্ঞদের মতে প্রকৃত রপ্তানির পরিমাণ অনেক বেশি। কারণ ব্যবসায়ীরা তৃতীয় দেশের মাধ্যমে পণ্য পাঠিয়ে নিষেধাজ্ঞা ও যাচাই-বাছাই এড়িয়ে চলেন এবং উচ্চ মূল্যে পুনঃলেবেল করে বিক্রি করেন।
ভারতভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (জিটিআরআই) জানিয়েছে, এই অনানুষ্ঠানিক রপ্তানির পরিমাণ বছরে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার।
এই গোপন বাণিজ্য কীভাবে চলে?
জিটিআরআই জানায়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, শ্রীলঙ্কার কলম্বো এবং সিঙ্গাপুরের বন্দর ব্যবহার করে বিকল্প পথ বের করা হয়।
জিটিআরআই-র প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব এক লিঙ্কডইন পোস্টে বলেন, “ভারতীয় পণ্য প্রথমে পাঠানো হয় দুবাই, সিঙ্গাপুর বা কলম্বোতে। এসব পণ্য ট্রানজিট হাবের বন্ডেড গুদামে রাখা হয়, তখনো শুল্ক আরোপ হয় না। এই সময়েই কাগজপত্র ও লেবেল পরিবর্তন করা হয়। এরপর সেগুলো পাকিস্তানে রপ্তানি করা হয় ‘নতুন’ উৎস দেশ—যেমন ভারত নয়, বরং সংযুক্ত আরব আমিরাতের নামে।”
শ্রীবাস্তব আরও বলেন, “যদিও এই ধরনের বাণিজ্য সবসময় বেআইনি নয়, এটি একটি ধূসর কৌশল। এটি দেখায় কীভাবে বাণিজ্য নীতির তুলনায় বাস্তব ব্যবসা অনেক দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়।”
তিনি আরও বলেন, আনুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এই ধরণের বাণিজ্য “পুনঃরপ্তানির অতিরিক্ত দামের পরেও লাভজনক হয় এবং এতে যুক্তিসঙ্গত অস্বীকৃতি বজায় রাখা যায়—‘আনুষ্ঠানিকভাবে’ কোনো বাণিজ্য নেই, তবুও বাণিজ্য চলতে থাকে।”
এই ধরনের বাণিজ্য কি অন্যত্রও দেখা যায়?
হ্যাঁ। বৈদেশিক বাণিজ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এড়াতে পণ্য অন্য বন্দরে পাঠিয়ে নতুনভাবে চালান রপ্তানি করা একটি প্রচলিত কৌশল।
উদাহরণস্বরূপ, ভারতের অর্থনীতিবিদ এবং ম্যাসাচুসেটস আমহার্স্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জয়তি ঘোষ জানান, ইউক্রেন যুদ্ধের পর ভারত এমন একটি কেন্দ্র হয়ে উঠেছে, যেখানে রাশিয়া থেকে আসা জ্বালানি নতুন রুটে ইউরোপে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। রাশিয়া থেকে জ্বালানির আমদানি বেড়েছে, এবং ভারত ২০২৩ সালে দৈনিক গড়ে ১.৭৫ মিলিয়ন ব্যারেল রাশিয়ান অপরিশোধিত তেল আমদানি করেছে, যা ২০২২ সালের তুলনায় ১৪০ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালে ভারতের মোট অপরিশোধিত তেলের প্রায় ৪০ শতাংশ এসেছে রাশিয়া থেকে, যেখানে ২০২১ সালে এই হার ছিল মাত্র ২ শতাংশ।
অন্যদিকে, বাণিজ্য বিশ্লেষক বিশ্বজিৎ ধর বলেন, চীনও বহু বছর ধরে ভারতের সাথে এমনভাবেই ব্যবসা করছে—দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মাধ্যমে পণ্য পাঠিয়ে। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও মায়ানমারসহ আরও কয়েকটি দেশ।
“চীন যদি সরাসরি ভারতে পণ্য পাঠাত, তাহলে উচ্চ শুল্ক দিতে হতো। কিন্তু ভারতের সঙ্গে আসিয়ান চুক্তি থাকায় ওই দেশগুলোর মাধ্যমে চীন পণ্য পাঠিয়ে শুল্ক কমাচ্ছে,” বলেন ধর। “ব্যবসায়ীরা সবসময়ই বাজারের চাহিদা মেটাতে সহজ ও লাভজনক পথ খোঁজে।”
পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে এই অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্য কি চলতেই থাকবে?
কাশ্মীর হামলার পর ভারতের কর্মকর্তারা পরোক্ষ রপ্তানির তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছেন এবং এই রুট বন্ধ করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। একইভাবে পাকিস্তানও তৃতীয় দেশের মাধ্যমে বাণিজ্য নিষিদ্ধ করেছে, যা ইঙ্গিত দেয় তারা এই ‘গোপন বাণিজ্য’ সম্পর্কে সচেতন।
তবুও এই ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করা কঠিন, কারণ এটি সরকারি নয় বরং ব্যক্তিগত পর্যায়ে হয়—যেখানে যুক্ত থাকে আমদানিকারক, রপ্তানিকারক ও মধ্যস্থ ব্যবসায়ীরা।
“পাকিস্তানের কাস্টমস কর্মকর্তাদের দায়িত্ব হচ্ছে পণ্যের উৎপত্তিস্থল নির্ধারণ করা এবং নিশ্চিত করা যে এটি কোনও অগ্রহণযোগ্য উৎস থেকে এসেছে কি না,” বলেন শান্তনু সিং।
তিনি বলেন, “এটি সাধারণত আমদানিকারকের দায়িত্ব হয় প্রমাণ দেখানো যে পণ্যটি যথাযথ উৎস থেকে এসেছে। এখন পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষকে দেখতে হবে যে পণ্যটি সত্যিই তৃতীয় দেশে উৎপাদিত, নাকি কেবল ভারতীয় পণ্যকে পুনঃলেবেল করে ঢোকানো হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “এই ফাঁকি ঠেকাতে পাকিস্তানের কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে নজরদারি বাড়াতে হবে।”
এই বাণিজ্য বন্ধ করা কি সম্ভব?
ব্যবসায়ীরা সহজে লাভজনক বাজার ছেড়ে দিতে চায় না। “এই বাণিজ্য চলবেই, কারণ ভারত ও পাকিস্তানের সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস, জীবনধারা অনেকটাই একরকম। ফলে পাকিস্তানে ভারতীয় পণ্যের চাহিদা সর্বদাই থাকবে,” বলেন সিং। “এই চাহিদা কোনও না কোনওভাবে পূরণ হবে।”
তিনি বলেন, “তৃতীয় দেশের মাধ্যমে বাণিজ্য নিষিদ্ধের কৌশল কেবল তখনই কার্যকর হবে, যদি ব্যবসায়ীরা সততা বজায় রাখে এবং ভারত সরকারের বার্তা বুঝতে পারে।”
কিন্তু বিশ্বজিৎ ধর মনে করেন, “যদি ব্যবসায়ীরা অসৎ হতে চায়, তাহলে এই ধরণের গোপন বাণিজ্য বন্ধ করা সম্ভব নয়।”
এর আগে কি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্য নিয়ে দ্বন্দ্ব হয়েছে?
হ্যাঁ। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য স্থগিত করেছিল। পরে ১৯৬৬ সালের তাসখন্দ চুক্তিতে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধার হলে বাণিজ্য ধীরে ধীরে চালু হয়।
১৯৭১ সালের যুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার সময়েও বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি দ্বন্দ্বের শান্তিপূর্ণ সমাধানে জোর দেয়, যা বাণিজ্য স্বাভাবিকীকরণের পথ খুলে দেয়। তবে পরবর্তী কয়েক দশকে সম্পর্ক বেশিরভাগ সময়েই অচল ছিল।
২০১৯ সালের পুলওয়ামা হামলা আবার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বড় ধাক্কা দেয়। ভারত পাকিস্তান থেকে আমদানিকৃত পণ্যে ২০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে।
এর ছয় মাস পর, আগস্টে ভারত একতরফাভাবে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে এবং অঞ্চলটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে।
পাকিস্তান, যে কখনোই ভারতকে “মোস্ট ফেভারড নেশন” মর্যাদা দেয়নি, তখন ভারতের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও কমিয়ে আনে এবং সব ধরনের বাণিজ্য স্থগিত করে। এরপর থেকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য পুনরায় চালুর কোনও আলোচনা হয়নি।
সূত্র : আল জাজিরা