আহমেদ সাঈদ
২০২৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বিশ্বে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে এই সামরিক সংঘর্ষ কেবল কৌশলগত নয়, বরং আধুনিক অস্ত্র প্রযুক্তির এক অনুশীলনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধের এই পর্যায়ে উভয় দেশই বিভিন্ন দেশের তৈরি উন্নত সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার করছে, যার মধ্যে রয়েছে যুদ্ধবিমান, ক্রুজ মিসাইল, ড্রোন, এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম এবং ব্যালিস্টিক মিসাইল। ভারত ও পাকিস্তান—দুই দেশের ব্যবহৃত অস্ত্রভাণ্ডারের বৈচিত্র্য, উৎস এবং প্রযুক্তি তুলে ধরলে বোঝা যায় যে এই যুদ্ধ অনেক বেশি বহুমাত্রিক।
ভারত প্রধানত ফ্রান্স, রাশিয়া ও ইসরায়েলের তৈরি আধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে। ফ্রান্সের তৈরি Dassault Rafale যুদ্ধবিমান ভারতীয় বিমানবাহিনীর অন্যতম শক্তি হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে। এই বিমান থেকে SCALP ক্রুজ মিসাইল ও AASM Hammer বোমা ব্যবহার করে পাকিস্তানের ঘাঁটিতে আঘাত হানা হয়েছে। এছাড়াও ভারত-রাশিয়ার যৌথ উদ্যোগে তৈরি সুপারসনিক BrahMos মিসাইল নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে ব্যবহার করা হয়েছে। ইসরায়েলি প্রযুক্তির SkyStriker ড্রোন সীমান্ত এলাকায় আত্মঘাতী হামলার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে, যা লক্ষ্যবস্তুতে উচ্চ-নির্ভুল আঘাত হানতে সক্ষম।
ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অন্যতম উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে রাশিয়ার তৈরি S-400 ট্রায়াম্ফ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। এটি পাকিস্তানের ড্রোন ও মিসাইল প্রতিরোধে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার হচ্ছে। অ্যান্টি-ট্যাংক ব্যবস্থায় ভারত ইসরায়েলের Spike ATGM ব্যবহার করেছে এবং রাশিয়ার তৈরি AGS-30 স্বয়ংক্রিয় গ্রেনেড লঞ্চার সীমান্ত এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে।
অন্যদিকে, পাকিস্তান তার অস্ত্র সরবরাহে চীনের উপর নির্ভরশীল থেকে শুরু করে নিজস্বভাবে তৈরি কিছু অস্ত্রও ব্যবহার করছে। পাকিস্তানের প্রধান যুদ্ধবিমান JF-17 Thunder, যা চীন-পাকিস্তানের যৌথ প্রকল্পে তৈরি, এবং এটি PL-15 দূর-পাল্লার এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল বহনে সক্ষম। এই যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে পাকিস্তান দাবি করেছে যে তারা একটি ভারতীয় রাফাল বিমান ভূপাতিত করেছে। পাকিস্তানের আরেকটি শক্তিশালী বিমান হলো চীনের তৈরি J-10C Vigorous Dragon, যা একইসঙ্গে PL-15 মিসাইল বহন করে আকাশযুদ্ধে অংশ নিচ্ছে।
পাকিস্তানের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় রয়েছে Fateh মিডিয়াম-রেঞ্জ মিসাইল, যা ভারতের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার সহায়তায় তৈরি H-4 SOW গ্লাইড বোম্ব Mirage-III ও JF-17 থেকে ব্যবহার করা হয়েছে। পাকিস্তান নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি Ghauri ব্যালিস্টিক মিসাইল ব্যবহার করেছে, যা মূলত উত্তর কোরিয়ার Nodong-1 মডেলের উপর ভিত্তি করে তৈরি। নজরদারি ও নির্ভুল হামলার জন্য পাকিস্তান চীনের Wing Loong ড্রোন ব্যবহার করেছে।
প্রতিরক্ষা ও কৌশলগত স্তরে পাকিস্তান চীনা প্রযুক্তির সহায়তায় তৈরি Nasr বা Hatf IX স্বল্প-পাল্লার পারমাণবিক মিসাইল মোতায়েন করেছে, যা যুদ্ধক্ষেত্রে পারমাণবিক বিকল্প ব্যবহারের একটি বার্তা হিসেবে ধরা হচ্ছে। এই মিসাইল বহনযোগ্য এবং কৌশলগত স্থানে ব্যবহারযোগ্য হওয়ায় এটি উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে উঠেছে।
উভয় দেশের অস্ত্র ব্যবস্থার তুলনা করলে দেখা যায়, ভারত পশ্চিমা দেশগুলোর উন্নত প্রযুক্তির উপর নির্ভর করছে, যেখানে ফ্রান্স, রাশিয়া ও ইসরায়েলের অস্ত্র বড় ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান তার দীর্ঘদিনের মিত্র চীনের তৈরি প্রযুক্তির উপর বেশি নির্ভরশীল, পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকা ও উত্তর কোরিয়ার সহায়তাও রয়েছে। এছাড়া পাকিস্তান নিজস্ব উদ্যোগেও কিছু অস্ত্র তৈরি করেছে। এই যুদ্ধ স্পষ্ট করেছে—সামরিক প্রযুক্তির প্রতিযোগিতা কেবল দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এর পিছনে রয়েছে বৈশ্বিক অস্ত্রশক্তির এক পরোক্ষ সংঘর্ষ।
এই যুদ্ধের পরিণতি যেমন মানবিক বিপর্যয়ের সম্ভাবনা তৈরি করছে, তেমনি এটি আধুনিক সামরিক প্রযুক্তির ব্যবহার ও নির্ভরতার নতুন বাস্তবতা সামনে এনেছে। অস্ত্রের উৎস, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও কৌশলগত মোতায়েন—সবকিছু মিলে বর্তমান ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ এক বহুমাত্রিক যুদ্ধরূপে পরিণত হয়েছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক