ভাষা রাজনীতি

নিঝুম সাঈদ

আমরা অনেকেই নতুনের সন্ধানে পুরোনো শব্দ এড়িয়ে চলি। বানানরীতির ক্ষেত্রেও পূর্বের চেয়ে আধুনিক অধিক প্রাধান্য দিয়ে থাকি। এটিকে ইতিবাচকভাবেই দেখা যায়।

তবে বিপত্তি দেখা যায় আমাদের ঐতিহ্য ও ধর্মীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গিয়ে। সেখানে নতুনের সন্ধানকে ইতিবাচকভাবে নেয়াটা কঠিন। কারণটা একটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। তাই বিশদভাবেই বলি।

ধর্মীয় সংস্কৃতির আবহ তৈরি করে এমন শব্দামালার তালিকায় যেমন ইসলামসম্পর্কিত শব্দমালা আছে। একইভাবে হিন্দু-বৈদ্ধ ও খৃষ্ট ধর্মেরও শব্দমালা রয়েছে।

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কেবল দেখি, মুসলিম সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত শব্দমালাই রূপ বদল করছে। অন্যান্য ধর্মের শব্দাবলীতে তেমন পরিবর্তন দেখি না। যেমন,
শব্দকে সহজ করার ধোঁয়া তুলে নবী শব্দ পরিবর্তিত হয়ে নবি হলো। কিন্তু পূজা শব্দটি পরিবর্তন হয়ে আর পুজা হলো না।
শব্দের ব্যবহার ক্ষেত্রও পরিবর্তন করে দেয়া হচ্ছে। যেমন, জিহাদ শব্দটির অর্থটি বর্তমানে ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে অর্থ দেয়া হচ্ছে, ধর্মরক্ষার যুদ্ধ। কিন্তু এই জিহাদকেই আধুনিক বাংলা অভিধানে উগ্রবাদ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
ইসলাম ধর্মের শব্দাবলীকে উপহাসের অথবা ভুলের প্রতীক বানানো হচ্ছে। যেমন বিচ্ছিন্নতাবাদ ও দেশদ্রোহের জন্য পাহাড়ে একত্রিত হওয়াকে এখন ‘হিজরত’ শিরোনামে উপহাস করা হচ্ছে। একইসাথে মুসলিমদের প্রতিকাজের শুরুতে বরকত অর্জনের মাধ্যম বিসমিল্লাহকে নিয়ে বাগধারা বানিয়ে ফেলেছে-বিসমিল্লায় গলদ।

ধর্মীয় পরিভাষার গুরুত্বকে হালকা করে দেয়া হচ্ছে। যেমন, নামাজ অর্থ এখন অবশ্য ইবাদত করার চেয়ে ধর্মীয় উপাসনার দিকে ধাবিত করছে। আবশ্যকীয় ইবাদত থেকে একজন শিশু যে গুরুত্ব ও আগ্রাহ বোধ করবে, ধর্মীয় উপাসনায় আশা করি, সে দিকটি নেই।

ধর্মের পরিত্যাজ্য বিষয়াবলীকে সহজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যেমন, পতিতা বা যানিয়াকে এখন যৌনকর্মী হিসেবে পেশ করার চেষ্টা হচ্ছে।

ধর্মের বৈধ বিষয়ের সাথে অবৈধ বিষয়কে মিলিয়ে অবৈধ বিষয়কে সহজ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। যেমন, গানকে এখন গজলের সাথে গুলিয়ে দুটো একাকার করা চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ একটি শরিয়তের দৃষ্টিতে গর্হিত ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অপরটি শরিয়তের বেঁধে দেয়া সীমা থেকে উপভোগ করাতে কোনো সমস্যা নেই।

মুসলিম সমাজে অধিক প্রচলিত শব্দ এড়িয়ে বিকল্প শব্দ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। যেমন, লাশ শব্দটি এড়িয়ে এখন মরদেহকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পানিকে পাশ কেটে জল ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য দেখা যাচ্ছে।

অন্যজনের দায় মুসলিমদের কাঁধে তুলে দেয়া হয়। যেমন বলা হয়, ইসলাম কেবল মানুষকে মধ্যযুগে পিছিয়ে নিতে চায়। তো ‘মধ্যযুগ’ শব্দটিকে ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরতার যুগ হিসেবে দেখানো হয়। অথচ ইউরোপের মধ্যযুগ ছিল ইতিহাসের বর্বরতম যুগ। কিন্তু ইসলামের মধ্যযুগ তো বর্বরতার যুগ ছিল না। কিন্তু এখন এ শব্দের মাধ্যমে অন্যের দায়ও নিজেদের উপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে।

ইসলাম ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ বিধানাবলীকে নৈতিক দৃষ্টিতে অবৈধ বিষয়ের সাথে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে তো একটিকে অন্যটির সমর্থবোধক করে ফেলেছে। যেমন, কিছু দিন আগে একটি বাহিনী উগ্রবাদীদের পরিচয়ের ব্যানার ফেরি করেছে। সেখানে উগ্রবাদীদের পরিচয়ে বলা হয়েছে, যে আগে আগে মসজিদে যায়, এবং ফিরতে অনেক দেরি করে, তাকেও উগ্রবাদী জ্ঞান করবে।

আমি এটা আগে মুখে মুখে শুনেছি। পরে মালিবাগ জামিয়ায় পড়ার সময় জামিয়ার পাশেই একটি বিল্ডিংয়ের দেয়ালে লেখা হিসেবেও দেখেছি।

এখন এই যে ব্যাখ্যা দাঁড় করালো, ভবিষ্যতে যদি অভিধানে উগ্রবাদীর পরিচয়ে এ কথাগুলো থাকে, তবে কি কোনো মুসলিম আগে আগে মসজিদে যাওয়া ও দেরি করে মসজিদ থেকে ফেরার মতো বরকতময় কাজে আগ্রহ বোধ করবে?
এভাবে আরো অনেক দিক থেকে পরিবর্তনটা করা হচ্ছে। তবে এটা কেবলই ইসলামঘনিষ্ঠ শব্দমালার ক্ষেত্রেই হচ্ছে। অন্য কোনো ধর্মের শব্দাবলীতে তেমন পরিবর্তন দেখা যায় না।

এমন একরোখা পরিবর্তন আমাদেরকে নিঃসন্দেহে সন্দিহান করে। তাই তাদের এসব পরিবর্তন গ্রহণ করা আমাদের জন্য খুবই কঠিন।

তাছাড়া এ পরিবর্তনের পরের পরিণতি খুবই নির্মম। কারণ, যদি এ পরিবর্তন প্রতিষ্ঠিত হয়, তবে আমাদের কয়েক প্রজন্ম পর নানা সমস্যার মুখোমুখি হবে।

প্রতিশব্দের ব্যবহার আধিক্যের ফলশ্রুতিতে যেসব মুসলিম সংস্কৃতির শব্দমালা আপন অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে না, সেগুলোর সাথে তারা পরিচিত হতে পারবে না।

কখনো এমন শব্দের মুখোমুখি হলে তা সমাধানের জন্য অভিধানের সহযোগিতা গ্রহণ করবে। তখন অভিধান তো ভুল ধারণা দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকবে।

একইভাবে ওই শব্দমালা যে সংস্কৃতিকে ধারণ করে, সেটাকে দেশীয় সংস্কৃতি হিসেবে প্রমাণ করাটা কঠিন হয়ে যাবে। তাদেরকে বুঝানো হবে, এ দেশে এসব সংস্কৃতি নতুন কিছু, অন্য জায়গা থেকে আমদানি করা। কয়েক প্রজন্ম আগেও তা ছিল না। অথচ ওই সংস্কৃতির পরিপন্থী সংস্কৃতিই প্রাচীন। যে কারণে এর উপস্থিতি পূর্বের প্রজন্মদের মাঝে পাওয়া যায়।
যেসব শব্দ আপন অস্তিত্বের জানান দেবে, তার কোনোটাকে ভিন্ন অর্থে প্রবাহিত করবে। যেকারণে পরের প্রজন্ম বিষয়টিকে ভুল বুঝবে। ভুল বোঝাবুঝি থেকে ধর্মীয় ওই সংস্কৃতি থেকেও দূরে থাকবে।

যেসব শব্দকে উপহাসের বাহক বানানো হয়েছে, সেগুলো ইসলামের বা মুসলিম সংস্কৃতির কোনো শব্দ হতে পারে, এসব ভাবতে পরবর্তী প্রজন্ম দ্বিধা করতে পারে।

যেসব অবৈধ বিষয়কে শব্দের মর্ম পরিবর্তনের মাধ্যমে সহজ করা হয়েছে, সেগুলোকে পরের প্রজন্ম সহজ মনে করতে পারে।

এভাবে নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি তারা হতে পারে।

মনে রাখতে হবে, একজন ছেলে মুসলিম বাবা-মায়ের কোলে বড় হয়েও ধর্মের শিক্ষা থেকে দূরে-বহুদূরে থাকতে পারে। তখন তার কাছে যদি ধর্মীয় বার্তাবাহী কোনো শব্দের মর্ম সঠিকভাবে না ই পৌঁছে, তবে তার হেদায়েতের পথে আসার কোনো উপলক্ষ্যই আর থাকে না। ইসলাম সম্পর্কে আগ্রহ জানারও কোনো উপসর্গ থাকে না। কিন্তু যদি শব্দের সঠিক মর্ম ধরে রাখা যায়, অন্তত ওই শব্দের উছিলায় হলেও ধর্মের সৌন্দর্যের দিকে সে প্রত্যাবর্তন করতে পারে।

এজন্য আসুন আমরা শব্দ ব্যবহারে সতর্ক হই। নতুনের সন্ধান করি। তবে ধর্মের ঐতিহ্যবাহী শব্দমালার ক্ষেত্রে নয়। কারণ, আজকের লেখকরা যা লেখে, পরে সেটাই অভিধানভুক্ত হয়। আজকের লেখকরা যে অর্থে শব্দ ব্যবহার করেন, কালকের অভিধানে সেটাকেই অর্থ হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়। তবে আমরা কেনো আমাদের সংস্কৃতিকে এমন জুলুমের শিকার বানাব?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top