আহমেদ সাঈদ
বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইসলামি শিক্ষার ঐতিহ্যগত পদ্ধতি অনুসরণ করে দরসে নেজামি ভিত্তিক পাঠক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। এই ধারায় শিক্ষার্থীরা দ্বীনের গভীর জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে একজন পরিপূর্ণ আলেম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, বৈশ্বিক রাজনীতি ও নাগরিক কাঠামোর জটিল বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এসেছে—মাদরাসার শিক্ষার্থীদের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান শিক্ষাটি কতটা অপরিহার্য?
আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্র কেবল একটি প্রশাসনিক কাঠামো নয়; বরং এটি নাগরিকদের জীবনের সর্বস্তরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একজন মাদরাসা শিক্ষার্থী, যিনি পরে সমাজে ধর্মীয় নেতা, মুফতি, ক্বাযী কিংবা নীতিনির্ধারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তাঁর পক্ষে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা না রেখে দায়িত্ব পালনের সুযোগ সীমিত হয়ে যায়। রাষ্ট্রের কার্যপ্রণালী, সংবিধান, আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া, ভোট ও জনপ্রতিনিধিত্ব, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক—এই সবকিছু বুঝতে হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞান থাকলে একজন শিক্ষার্থী শুধু ধর্মীয় পাঠেই সীমাবদ্ধ থাকেন না; বরং আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও ইসলামি রাষ্ট্রধারার পারস্পরিক তুলনা করতে সক্ষম হন। এতে তারা বুঝতে পারে যে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা কেবল একটি ধর্মীয় কাঠামো নয়, বরং তা ন্যায়, নৈতিকতা, ইনসাফ এবং জনগণের কল্যাণনির্ভর একটি পূর্ণাঙ্গ সমাজব্যবস্থা। এ উপলব্ধি মাদরাসা শিক্ষার্থীদের চিন্তাধারায় একটি গভীরতা যোগ করে, যা পরবর্তীতে সমাজে তাদের নেতৃত্বগুণ বিকাশে সহায়ক হয়।
রাষ্ট্রচিন্তা ও শাসনব্যবস্থার সাথে ইসলামের সম্পর্ক সুদীর্ঘ ও ঘনিষ্ঠ। নববী যুগে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র কাঠামো এবং পরবর্তী খেলাফতে রাশেদার শাসনব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সংগঠিত, ন্যায়ভিত্তিক এবং জনগণের প্রতি জবাবদিহিতামূলক। এসব ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে বর্তমান বাস্তবতায় প্রয়োগযোগ্য নির্দেশনা বের করে আনতে হলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি থাকা আবশ্যক। শুধু আবেগনির্ভর বক্তব্য নয়, বরং বাস্তবভিত্তিক ও প্রাসঙ্গিক দিকনির্দেশনা প্রদানেও রাষ্ট্রবিজ্ঞান অপরিহার্য ভূমিকা রাখে।
বর্তমান বিশ্বে মুসলিম উম্মাহ নানা সংকটে জর্জরিত—ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, সিরিয়া থেকে শুরু করে আফ্রিকা ও ইউরোপে মুসলিমদের অবস্থান ক্রমেই কঠিনতর হয়ে উঠছে। এই প্রেক্ষাপটে ইসলামি নেতৃত্বের ভূমিকা পুনরায় সংজ্ঞায়িত হওয়া দরকার। সেই নেতৃত্ব গঠনের প্রথম ধাপ হতে পারে রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে একাডেমিক প্রস্তুতি, যা মাদরাসা শিক্ষার অন্তর্গত না থাকলে পরিপূর্ণতা পায় না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান পাঠের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যেমন নাগরিক অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়, তেমনি সমাজে নেতৃত্ব প্রদানের যোগ্যতাও অর্জন করে। রাষ্ট্রচিন্তার সাথে শরিয়তের উদ্দেশ্য—দীন রক্ষা, জান-মালের নিরাপত্তা, সম্মান ও স্বাধীনতা সংরক্ষণ—ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জ্ঞান ছাড়া এই উদ্দেশ্যগুলো বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়ে।
এই বাস্তবতা বিবেচনায় মাদরাসা শিক্ষায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান অন্তর্ভুক্তি কোনো বিলাসিতা নয়; বরং এটি সময়ের একটি দাবিতে পরিণত হয়েছে। এটি শুধু একটি বিষয় সংযোজন নয়, বরং চিন্তাধারার পরিসর সম্প্রসারণ, দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরির প্রক্রিয়া এবং ইসলামি জ্ঞানের সঙ্গে বাস্তবজগতের সেতুবন্ধন নির্মাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।
মাদরাসা শিক্ষার গন্তব্য কেবল আলেম তৈরি করা নয়, বরং এমন নেতৃত্ব তৈরি করা, যারা জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হবে। সেই নেতৃত্ব গঠনের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো যুগোপযোগী ও বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান অপরিহার্য। অতএব, মাদরাসা সিলেবাসে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অন্তর্ভুক্তি এখন সময়ের চাহিদা এবং উম্মাহর ভবিষ্যতের জন্য এক অপরিহার্য বিনিয়োগ।