মাওলানা আহমেদ সাঈদ
ইসলাম কেবল একটি ধর্ম নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। সৃজনশীলতা, উৎপাদন, আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড—সবকিছুতেই ইসলামের ছাপ স্পষ্ট। তাই মানবজীবনের ধারাকে টিকিয়ে রাখতে ইসলাম ব্যবসাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। ব্যবসা কেবল পণ্য উৎপাদনে সীমাবদ্ধ নয়; তা প্রচার ও বিপণনের মাধ্যমেও বিস্তৃত হয়। তবে এই প্রচার-প্রচারণা অবশ্যই কুরআন ও সুন্নাহর আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। অশ্লীলতা বা অনৈতিক কোনো পন্থা ইসলাম অনুমোদন করে না; বরং জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে ইসলামী নীতিমালা অনুসরণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
মার্কেটিংয়ে ইসলামের নির্দেশনা
প্রচারণা ও বিপণনের প্রয়োজনীয়তা আজ অস্বীকার করার উপায় নেই। Oxford Advanced Learner’s Dictionary অনুসারে, বিজ্ঞাপন হলো একটি পণ্য বা সেবাকে মানুষের সামনে উপস্থাপন ও বিক্রির কৌশল। ইসলামও বিজ্ঞাপনকে বৈধ মনে করে, তবে তা হতে হবে শরীয়তের সীমারেখার মধ্যে। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বিজ্ঞাপন হলো এমন একটি প্রচারণা, যা সত্যনিষ্ঠা বজায় রেখে পণ্য বা সেবাকে মানুষের কাছে তুলে ধরে, যাতে কোনো প্রকার প্রতারণা, মিথ্যা বা অশ্লীলতার আশ্রয় নেওয়া হয় না।
ইসলাম ব্যবসা ও বিজ্ঞাপনে সততার উপর অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করে। ব্যবসায়ীর দায়িত্ব পণ্যের প্রকৃত অবস্থা ক্রেতার কাছে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা। সাময়িক লাভের জন্য মিথ্যা বলার প্রবণতা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “ক্রেতা ও বিক্রেতা যখন সত্য বলবে ও পণ্যের দোষ-গুণ স্পষ্ট করবে, তাদের লেনদেনে বরকত হবে; আর যদি তারা মিথ্যা বলে ও ত্রুটি গোপন করে, বরকত উঠিয়ে নেওয়া হবে।” আজ অনেক ব্যবসায়ী কৌশলে ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করে; অথচ সত্য ও সততা ব্যবসার প্রকৃত সৌন্দর্য।
বর্তমান সময়ে বিজ্ঞাপনের নামে নৈতিকতা লঙ্ঘনের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। গান, বাদ্যযন্ত্র, অশ্লীল ছবি ও বার্তা এখন বিজ্ঞাপনের নিত্য অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ইসলামে এসব সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়স্বজনের প্রতি দান করার নির্দেশ দেন এবং নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎকর্ম ও সীমালঙ্ঘন।” (সুরা নাহল : ৯০) তাই একজন মুসলিম ব্যবসায়ী কখনোই শরীয়তের সীমা অতিক্রম করে প্রচারণা চালাতে পারে না।
সততা ও নৈতিকতার আলোকে পরিচালিত বিপণন ব্যবসায় প্রশান্তি ও সম্মান বয়ে আনে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সততা ও বিশ্বস্ততার গুরুত্ব বারবার উল্লেখ করেছেন এবং মুনাফেকির ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন।
বিজ্ঞাপনে নারীর শরীর ও সৌন্দর্য ব্যবহার আজকের দুনিয়ায় একটি সাধারণ চিত্র হয়ে উঠেছে। দুঃখজনকভাবে, মুসলিম ব্যবসায়ীরাও অনেকে এই ধারা অনুসরণ করছে। অথচ ইসলাম নারীর মর্যাদাকে সর্বোচ্চ সম্মান দিয়েছে। আল্লাহ তায়ালা মুমিন নারী ও পুরুষদের দৃষ্টি সংযত রাখতে এবং নিজেদের শালীনতা রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। (সুরা নুর : ৩০-৩১) বিজ্ঞাপনে নারীর অশালীন প্রদর্শন ইসলামের মৌলিক আদর্শের পরিপন্থী।
বাবার ব্যবসায় সন্তানদের অংশিদার করার ক্ষেত্রে করণীয় : শরিয়াহসম্মত চুক্তি ও ন্যায্যতা
বিজ্ঞাপনে নগ্নতা ও যৌনতার ব্যবহার ইসলামে সম্পূর্ণরূপে হারাম। পণ্য প্রচারে শালীনতা বজায় রাখা অপরিহার্য। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “লজ্জাশীলতা ইমানের একটি শাখা।” সুতরাং, বিজ্ঞাপন ও বিপণনে ইসলামী শালীনতার সীমা রক্ষা করা আবশ্যক।
শুধু নারী নয়, পুরুষ মডেলদের ক্ষেত্রেও শালীনতার বিধান সমানভাবে প্রযোজ্য। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুকে উপদেশ দিয়েছিলেন, “তুমি তোমার উরু প্রকাশ করবে না এবং অন্যের উরুর দিকে তাকাবে না, সে জীবিত হোক বা মৃত।” তাই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকেই শরীয়তের সীমারেখার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে বিজ্ঞাপনী কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
লেখক : শিক্ষক, মাদরাসাতুত তাকওয়া ঢাকা