মিশরের অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরেই চাপের মুখে রয়েছে। ঋণে জর্জরিত, মুদ্রার অবমূল্যায়নে বিপর্যস্ত, বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে যাওয়া এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে দেশের অর্থনীতি এক গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত। এর মধ্যে গাজায় যুদ্ধের পুনরায় শুরু পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
গত মার্চে যুদ্ধবিরতির স্বল্পস্থায়ী শান্তি ভেঙে যাওয়ার পর, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা নতুন মাত্রা পায়। ১৮ মার্চ ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘন করে, যার পরিণতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মিশর। যুদ্ধের বিস্তার গাজা উপত্যকা ও লোহিত সাগরের মিশরীয় সীমান্তে অস্থিরতা বাড়িয়ে তোলে। এর ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অন্যতম রুট সুয়েজ খাল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সুয়েজ খালের রাজস্ব ধস
ইয়েমেনের হুথি গোষ্ঠীর লোহিত সাগরে পশ্চিমা জাহাজ লক্ষ্য করে চালানো হামলার কারণে বহু জাহাজ কোম্পানি সুয়েজ খাল এড়িয়ে আফ্রিকার চারপাশ ঘুরে যাত্রা করছে। এতে খাল থেকে মিশরের রাজস্ব ২০২৪ সালে ৬০ শতাংশের বেশি কমেছে। রাষ্ট্রপতি সিসির হিসাব অনুযায়ী, ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার।
এই পরিস্থিতি শুধু রাজস্ব নয়, মিশরের আন্তর্জাতিক অবস্থান ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ওপরও আঘাত হেনেছে। সুয়েজ খালের বিকল্প হিসেবে ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ করিডোরের মতো প্রকল্পগুলোর আলোচনা এখন জোরালো হচ্ছে। এটি খালের ভূরাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে।
প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা ব্যয় বাড়ছে
এই অস্থিরতার কারণে মিশরকে খালের সুরক্ষা, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং চোরাচালান রোধে অতিরিক্ত সামরিক ব্যয় করতে হচ্ছে। উত্তর সিনাই অঞ্চলে নতুন করে নিরাপত্তা উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এতে দেশটির সামরিক বাজেট আরও চাপের মুখে পড়ছে।
ইসরায়েলের রাফা ও ফিলাডেলফি করিডোরে সামরিক উপস্থিতি ১৯৭৯ সালের শান্তিচুক্তি ও ২০০৫ সালের সম্পূরক চুক্তির পরিপন্থী। এটি শুধু কৌশলগত ভারসাম্য নয়, মিশরের ভৌগোলিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি তৈরি করছে।
পুনর্গঠনের আশা ও হতাশা
গাজা পুনর্গঠনের সম্ভাব্য খরচ ধরা হয়েছে ৫৩ বিলিয়ন ডলার। কায়রো এই প্রচেষ্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে চায়। মিশরীয় কোম্পানিগুলি, বিশেষত নির্মাণ খাতে, এতে লাভবান হতে পারে। কিন্তু নেতানিয়াহুর যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এই পরিকল্পনাকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলেছে।
মিশরে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হল, যতদিন যুদ্ধ বন্ধ না হবে এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতি না আসবে, ততদিন আন্তর্জাতিক দাতাদের আস্থা অর্জন এবং অর্থায়ন নিশ্চিত করা কঠিন।
পর্যটন ও বৈদেশিক বিনিয়োগে ধাক্কা
লোহিত সাগর ও গাজার উত্তেজনা পর্যটন শিল্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ২০২২ সালে ইসরায়েলি পর্যটকরাই ছিল চতুর্থ বৃহত্তম বিদেশি দর্শনার্থী গোষ্ঠী। এছাড়া নিরাপত্তা উদ্বেগ ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগ হ্রাস পাচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে বাধাগ্রস্ত করছে।
রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতাও ঝুঁকিতে
গাজা যুদ্ধের সামাজিক অভিঘাতও মিশরে প্রবল। বহু মিশরীয়ের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে – ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক রাফা ও সিনাইয়ে স্থানান্তরের সম্ভাবনা, কিংবা ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ – উভয়ই মিশরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
বিশ্লেষকদের মতে, এই পরিস্থিতি শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি ও স্থায়ী শান্তির অভাব মিশরের স্বার্থের পরিপন্থী।
মিশরের নীতি নির্ভরতা
যুদ্ধের ফলে মিশরের অর্থনীতি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি সামরিক ব্যয় বাড়ছে, বিনিয়োগ কমছে, এবং সামাজিক উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক দিকটি হল – এই সংকটের নিয়ন্ত্রণ মিশরের হাতে নেই।
নেতানিয়াহুর সরকার যদি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়াতে থাকে, তবে মিশরের অর্থনীতি কার্যত তার নীতির কাছে জিম্মি হয়ে পড়বে। তাই যুদ্ধবিরতি ও শান্তির পথেই রয়েছে মিশরের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের একমাত্র সম্ভাবনা।
সূত্র : মিডল ইস্ট মনিটর