মুসলিম নারী

মুসলিম নারীর স্বপ্ন কেমন হওয়া উচিত?

উম্মে আহমাদ

মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন তাকে চালিত করে, পথ দেখায়। নারীরাও স্বপ্ন দেখে তবে একজন মুসলিম নারীর স্বপ্ন অন্যদের মতো নয়। তার স্বপ্নে থাকে পরকালের সফলতা,আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য জীবনকে সাজানোর আকাঙ্ক্ষা। সমাজ যেভাবে নারীর স্বপ্নকে শুধু বাহ্যিক সফলতায় সীমাবদ্ধ রাখতে চায়, ইসলাম ঠিক সেখানেই দিয়েছে গভীর ও ভারসাম্যপূর্ণ দিকনির্দেশনা যেখানে নারী তার স্বপ্নের ভিত রচনা করে ঈমান, জ্ঞান, চরিত্র ও মানবিকতা দিয়ে।
একজন মুসলিম নারীর স্বপ্ন কেমন হওয়া উচিত?

১. আল্লাহর প্রিয় বান্দী হওয়া:
প্রত্যেক মুসলিম নারীর প্রথম ও প্রধান স্বপ্ন হওয়া উচিত, সে যেন হয় আল্লাহর প্রিয় বান্দী। আল্লাহ বলেন,
“আর আমি জ্বিন ও মানুষকে সৃষ্টি করেছি শুধুমাত্র আমার ইবাদতের জন্য।”
— সূরা আদ-ধারিয়াত, ৫৬

এই আয়াত নারী পুরুষ সবার জন্য সমভাবে প্রযোজ্য। কাজেই একজন মুসলিম নারীর স্বপ্ন হবে এমন জীবন গড়া, যেখানে তার প্রতিটি কাজ ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত হয় হোক সেটা সন্তান লালন, ঘর সাজানো, স্বামীর খিদমত, অথবা জ্ঞানার্জন।

২. জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান হওয়া:
রাসূল ﷺ বলেছেন, “জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রতিটি মুসলিমের জন্য ফরয।” (ইবনে মাজাহ)

একজন নারী যেন কেবল সাজসজ্জা বা বাহ্যিক রূপের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রাখে, বরং তার স্বপ্ন হোক কুরআন বোঝা, হাদীস জানা, দুনিয়াবি ও দ্বীনি জ্ঞানে নিজেকে সমৃদ্ধ করা। ইসলামিক স্কলার, শিক্ষক, দাঈ বা লেখিকা হওয়াও হতে পারে তার লক্ষ্য। তবে উদ্দেশ্য থাকবে শুধুই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও উম্মাহর খেদমত। তবেই সে জ্ঞানের পূর্ণতা পাবে।
এই গুণের এক অনন্য উদাহরণ আয়েশা (রা.)। তিনি ছিলেন প্রিয় নবী ﷺ এর স্ত্রী, একই সাথে যুগের অন্যতম জ্ঞানী নারী। সাহাবীগণ তাকে দ্বীনের জটিল বিষয় জিজ্ঞাসা করতেন, তিনি হাদীস বর্ণনা করতেন, ফিকহি মাস’আলা বুঝিয়ে দিতেন। উনার বুদ্ধিমত্তা, গভীর স্মরণশক্তি আর তাফাক্কুরের কারণে উম্মাহ শত শত বছর ধরে উপকৃত হচ্ছে।

৩. মাতৃত্বের মর্যাদা অর্জন:
নারীর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ একটি দায়িত্ব মাতৃত্ব। আল্লাহর রাসূল ﷺ বলেছেন:
“জান্নাত তোমার মায়ের পায়ের নিচে।(নাসাঈ)

একজন নারী যেন স্বপ্ন দেখেন এমন প্রজন্ম গড়ার, যারা হবে তাকওয়াবান, জ্ঞানী ও উম্মাহর জন্য কল্যাণকর। একজন মায়ের হাতে গড়ে উঠতে পারে জাতির ভবিষ্যৎ।এই চেতনা থেকেই তার স্বপ্ন হোক মহান মাতৃত্বের।

এই গুণের অনন্য দৃষ্টান্ত হলেন ফাতিমা (রা.) প্রিয় নবী ﷺ এর প্রিয় কন্যা, যিনি হাসান (রা.) ও হুসাইন (রা.) এর মতো নেককার, সাহসী প্রজন্ম গড়ে তুলেছিলেন; যারা উম্মাহর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন।

তেমনি আসমা বিনতে আবি বকর (রা.) ও ছিলেন মাতৃত্বের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। তিনি তার ছেলে আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.)-কে সত্যনিষ্ঠ, সাহসী ও তাকওয়াবান নেতা হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন, যিনি দ্বীনের পথ থেকে কখনো পিছু হটেননি।

একজন মায়ের ঈমান, দোয়া ও সঠিক লালন পালনই হতে পারে এমন প্রজন্ম গড়ার প্রধান হাতিয়ার যা উম্মাহর জন্য হবে অমূল্য কল্যাণ।

৪. সংসার গড়ে তোলা ও স্বামী-পত্নীর সম্পর্ককে ইবাদত বানানো:
ইসলামে বিবাহ একটি ইবাদত। একজন নারী যেন স্বপ্ন দেখে এমন একজন সঙ্গী ও একটি সংসার গড়ার, যেখানে ইসলামই হবে কেন্দ্রবিন্দু। সে যেন জানে, তার হাসিমুখ, ঘর সামলানো, স্বামীর খিদমত সবই নেকীর কাজ। এই বিষয়গুলো যখন সে ইবাদাতের নিয়তে করবে তখন সেখানে যুক্ত হবে অফুরন্ত নেকী।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন:
“যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে, রমযানের রোযা রাখে, লজ্জাস্থানের হেফাজত করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে তাকে বলা হবে: তুমি জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা, সেই দরজা দিয়ে প্রবেশ কর।”
— [মুসলিম, হাদীস: ১৪৬৭]

তাছাড়া একজন স্ত্রী যে নিজেকে আল্লাহর জন্য গড়ে তোলে সে তার স্বামীর যেকোন বিপদে নিজের জ্ঞান দিয়ে ,সাহস দিয়ে পাশে থাকতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ চারজন নারীর একজন খাদিজা রা: যাকে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা সালাম প্রেরণ করেছেন। কি করেছিলেন তিনি?

প্রিয় নবী ﷺ এর নবুয়তপ্রাপ্তির শুরুর দিনগুলোতে খাদিজা (রা.) ছিলেন অটল সমর্থন আর সাহসের উৎস। যখন রাসূল ﷺ হেরা গুহা থেকে কম্পমান অবস্থায় ফিরে এলেন, তখন খাদিজা (রা.) নিজের গভীর বিশ্বাস, স্থিরতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে স্বামীকে শান্ত করেন:
“কখনোই না! আল্লাহ কখনোই আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করেন, গরীবের বোঝা বহন করেন, অতিথিকে আপ্যায়ন করেন, এবং সত্যের পথে বিপদগ্রস্তদের সাহায্য করেন।”
(সহীহ বুখারী)

খাদিজা (রা.) প্রমাণ করেছেন একজন স্ত্রী তার স্বামীর সবচেয়ে বড় মনোবল হতে পারে। ধৈর্য, নেক ইচ্ছা আর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তিনি কষ্টের সময় রাসূল ﷺ কে সাহস যুগিয়েছেন, তার পাশে ছিলেন নিজের সর্বস্ব দিয়ে।

৫. উম্মাহর জন্য কিছু করার স্বপ্ন:
একজন মুসলিম নারীর স্বপ্নের পরিধি কখনোই নিজের জীবন বা পরিবারে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তার স্বপ্নের একটি অংশ হবে পুরো উম্মাহর জন্য কল্যাণের বীজ বোনা। একজন নারী তার স্বপ্নকে রূপ দিতে পারে সর্বপ্রথম নিজের সন্তানদের সঠিকভাবে গড়ে তোলার মাধ্যমে। তার গর্ভ, লালনপালন ও শিক্ষাই হতে পারে একটি পূর্ণ প্রজন্মের ঈমানী শক্তি।
সে স্বপ্ন দেখবে জ্ঞান অর্জন ও জ্ঞান বিতরণের। সে নিজেই দ্বীনের সঠিক জ্ঞান অর্জন করবে, তারপর সেই জ্ঞান ছড়িয়ে দেবে তার সন্তান, পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও নারীদের মধ্যে যাতে প্রতিটি ঘর দ্বীনের আলোয় আলোকিত হয়।
ইতিহাসের অনেক নারী সাহাবী এই দিকটি অনুপ্রেরণা হিসেবে রেখে গেছেন। যেমন:
• আয়েশা (রা.) প্রিয় নবী ﷺ এর স্ত্রী হয়েও ছিলেন যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসা ও আলিমা; অসংখ্য হাদীস ও ইসলামী জ্ঞানের ভাণ্ডার উনার মাধ্যমে উম্মাহর কাছে পৌঁছেছে।
• উম্মে সালামা (রা.) জ্ঞান ও হিকমতের জন্য বিখ্যাত ছিলেন; বহু গুরুত্বপূর্ণ মাস’আলা ও হাদীস উনার মাধ্যমে উম্মাহ পেয়েছে।
• আসমা বিনতে আবি বকর (রা.) সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে উম্মাহর বড় উপকার করেছেন।
• উম্মে উমারা (নুসাইবা বিনতে কা‘ব) কে বলা হয় নারী মুজাহিদার অনন্য দৃষ্টান্ত। উহুদের যুদ্ধে যখন মুসলিম সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি নিজের তরবারি নিয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ কে রক্ষার জন্য দাঁড়িয়ে যান। তিনি নিজে জখম হন, কিন্তু পিছু হটেননি।

তাদের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে একজন মুসলিম নারী স্বপ্ন দেখবে কীভাবে সে তার পরিবারকে, সন্তানদের এবং চারপাশের মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের পথে ডেকে আনতে পারে। দাওয়াহ, তালিম, ছোট ইসলামিক হালাকাহ বা সমাজের দরিদ্র ও নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানো সবই হতে পারে উম্মাহর জন্য কল্যাণ ছড়ানোর স্বপ্নের অংশ।

৬. পরকাল ও জান্নাতের সফলতা:
একজন মুসলিম নারীর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বপ্ন হওয়া উচিত জান্নাত। কারণ দুনিয়ার কোনো সুখই চিরস্থায়ী নয়, চিরস্থায়ী শান্তি ও সফলতা একমাত্র জান্নাতেই। এ জীবনের সমস্ত চেষ্টা, পরিশ্রম ও সব ত্যাগ-তিতিক্ষার শেষ লক্ষ্য প্রিয় রবের সন্তুষ্টি এবং জান্নাতের চিরন্তন আশ্রয়লাভ।একজন নারী যেন সব সময় তার রবের কাছে হাত তুলে বলে:
“হে আল্লাহ! তুমি আমাকে জান্নাত দাও, আর জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।”

জান্নাতের স্বপ্ন তাকে গুনাহ থেকে দূরে রাখবে, আমলে দৃঢ় করবে এবং জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপকে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত করবে।কারণ জান্নাত শুধু কিছু কাজের ফল নয় ,জান্নাত একটি লক্ষ্য, একটি জীবনব্যাপী ইবাদতের প্রেরণা, একজন মুমিনার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।

সবশেষে আমরা বলতে পারি একজন মুসলিম নারীর স্বপ্ন শুধু ক্যারিয়ার, সৌন্দর্য, স্বাধীনতা বা বিলাসবহুল জীবনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তার স্বপ্নের পরিধি বহুবিস্তৃত আখিরাত পর্যন্ত। সে ফেরীওয়ালীর মতো, যে নিজ হৃদয়ে সঞ্চয় করে রেখেছে আশা, ঈমান ও দীপ্তির আলো এবং সেই আলো ছড়িয়ে দিতে চায় নিজের পরিবারে, সমাজে, উম্মাহতে।
আজকের যুগে প্রয়োজন, মুসলিম নারীরা যেন নিজের স্বপ্নগুলোকে ইসলামের আলোকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করে যাতে তাদের পথ হয় সঠিক, লক্ষ্য হয় মহান এবং পরিণতি হয় জান্নাতের ছায়াতলে।

লেখিকার ফেসবুক থেকে গৃহীত

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top