মুসলিম নারী, মাতৃত্ব, ব্রেস্টফিডিং মম,

মাতৃত্বের সম্ভ্রম বনাম জাতির মানসিকতা

সালমা জাহান

আপনি একজন পুরুষ। ঘরের বাইরে কোনো রেস্টুরেন্টে, মার্কেটে কিংবা গাড়িতে হঠাৎ আপনার নজরে পড়ল একজন নারী নিজের ওড়না কিংবা হিজাব-নিক্বাবের নিচে তাঁর সন্তানকে দুধ পান করাচ্ছেন। এমন দৃশ্য দেখে কি কখনো আপনার মনে কোনো অস্বস্তির সৃষ্টি হয়? নিজের কাছে সৎ থেকে অনুভূতিটাকে ধরার চেষ্টা করুন, সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করুন, মুখোমুখি হোন। কেন আপনার এমন অনুভূতির সৃষ্টি হল? এটা তো খুবই স্বাভাবিক একটি ঘটনা। আপনি আপনার মায়ের দুধ পান করেছেন। আপনার স্ত্রী আপনার সন্তানকে দুধ পান করিয়েছেন/ করাচ্ছেন/ করাবেন। এটা সন্তানের বেঁচে থাকার, বেড়ে উঠার শাশ্বত নিয়ম।

অস্বস্তিকর অনুভূতিটি ঠিক কেন তৈরি হয় ভিতরে? আপনার স্ত্রী বা বোনকে পাশে এই অবস্থায় দেখলে তো এটা নিশ্চয়ই হত না তাইনা?

নিজের সাথে আলোচনা করে যখন এমন একটা উপসংহারে পৌঁছুতে পারবেন তখন দেখবেন এমন অনুভূতি আর সৃষ্টি হচ্ছেনা। যেকোনো ব্রেস্টফিডিং মম দেখলে চমৎকার এক মমতার অনুভবে অন্তর ভরে যাচ্ছে। অন্তরে যে শিশুর পিতা ঘুমিয়ে আছে সে জেগে উঠছে। সব শিশুর প্রতি আদর আর শিশুর মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা অনুভব করছেন।

হয়তো বলতে পারেন, কই না তো! বিব্রতকর এমন কোনো অনুভূতি তো হয়না!আপনার না হলেও অনেকের হয়।
একবার এক কাজে মার্কেটে গিয়েছিলাম আমার প্রথম সন্তানকে নিয়ে। যাওয়ার সময় ফিডারে দুধ নিয়ে গেছি। কিন্তু ওখানে বেশি সময় লেগে যাওয়ায় সে ফিডারের দুধ খেয়ে শেষ করে ফেলে। কিছুক্ষণ পর ক্ষুধায় সে প্রচন্ড কান্নাকাটি শুরু করে। আমরা এক গলিতে দাঁড়িয়ে আছি, চারপাশে অনেক দোকান। আমি অসহায়ের মত চারপাশে তাকাচ্ছি, বাচ্চাকে একটু খাওয়ানোর জায়গা খুঁজছি। হঠাৎ আমি খেয়াল করলাম যে কাছাকাছি যে তিন চারজন দোকানদার আমাকে কাছ থেকে দেখছে এবং পরিস্থিতিটা বুঝতে পেরেছে তারা কেমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসছে। ভাবটা এমন যে, এখন কই যাইবা মনু!

পরবর্তীতে পাশের এক মসজিদে জামাত শেষে যখন মসজিদ খালি হল তখন মসজিদের খাদেমকে অনুরোধ করে ওখানে গিয়ে বাচ্চাকে খাওয়াই।

প্রায় সাত বছর আগের ঘটনা। এখনো আমার চোখে ঐ লোকগুলোর কুৎসিত সেই হাসি ভাসে।

একইরকম বাজে দৃষ্টির স্বীকার হয়েছি ঢাবির লাল বাসে। খিলক্ষেত থেকে বেবিকে নিয়ে প্রথম উঠলাম ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য। উঠার পরপরই তারস্বরে কান্না শুরু।৷ কোনো ভাবেই থামাতে না পেরে বাধ্য হয়ে ওকে জিলবাবের নিচে ঢুকিয়ে নিলাম। আমি সামনে ফিরে আছি, কিন্তু আমি বামপাশ থেকে, পিছন থেকে অদ্ভুত দৃষ্টি আর হাসি অনুভব করতে পারছিলাম। মেয়েরা এটা না দেখেও অনুভব করতে পারে!

তখন কেবল প্রথম সন্তানের প্রথম বছর চলে, বাইরে ওকে ফীড করতে প্রচন্ড লজ্জা লাগত। কাছেপিঠে নিরিবিলি জায়গা খুঁজতাম, না পেলে কোনো রেস্টুরেন্টে ঢুকে একদম কোণার দিকে পিছন ফিরে বসে খাওয়াতাম। পরবর্তীতে মেনে নিলাম আশেপাশে কে কি মনে করল, কিভাবে দেখল এটা ভাবলে আসলে আমার সব থেমে যাবে। গত সাতবছর ধরে পরপর সন্তানদেরকে ব্রেস্টফিডিং করে যাচ্ছি। সাতবছরে অবশ্যই অসংখ্যবার আমার বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হওয়াটাই স্বাভাবিক।

কাছাকাছি আরেকটা ঘটনা বলি। তখন ভার্সিটির থার্ড ইয়ারে। ফার্স্ট প্রেগ্নেন্সি। প্রেগ্নেন্সির কারণে অনেক ক্লাস মিস হয়েছে। ডিপার্টমেন্টে নিয়ম ছিল ৭৫% এর কম উপস্থিতি থাকলে এক হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। অনেকেই তখন চেয়ারম্যান স্যারের কাছে কারণ দর্শানোর জন্য যাচ্ছিল যেন জরিমানা মওকুফ করিয়ে আনতে পারে। আমিও গেলাম, নতুন সংসারে এক হাজার টাকাও অনেক। সবাইকে স্যারের রুমে ঢুকার আগে অফিসের ভি আই পি অফিস সহকারীদের কাছে কারণ ব্যাখ্যা করা লাগছিল। সে গিয়ে স্যারকে বলবে। সবার কারণগুলোই বানানো ছিল, ভার্সিটিতে এত ক্লাস মিস সাধারণত ফাঁকিবাজি করেই দেওয়া হয় কারো সিরিয়াস কোনো কারণ না থাকলে। কেবল আমার ক্লাস মিস করার জেনুইন কারণ ছিল৷ আমি বাইরে লোকটাকে আমার ফার্স্ট আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট দেখালাম এবং বললাম আমি অসুস্থ। সে তেলতেলে এক হাসির সাথে বললো, আপনি গিয়ে বলেন স্যারকে আমি বলতে পারবোনা। আমার মনে হচ্ছিল আমি মাতৃত্ব নামক এক বিশাল অন্যায় নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছি৷ পরে আর কিছুই না বলে ব্যাংকে গিয়ে এক হাজার টাকা জমা দিয়ে চলে আসলাম।

এবার ভিন্ন এক দৃশ্যপটে যাই। বনু কাইনুকা নামক এক ইহুদি গোত্র বসবাস করত মদিনা শহরে। তারা ছিল প্রধানত স্বর্ণবণিক। এক মুসলিম নারী বাজারে অলংকার কেনা বা বেচার জন্য এক ইহুদীর সোনার দোকানে যান। সেখানে উপস্থিত আরও কয়েকজনসহ ইহুদী দোকানদারটি মহিলাকে পোশাকের কিছু অংশ সরাতে বলে। মুসলিম মহিলাটি তা করতে রাজী না হওয়ায় তারা মহিলাটিকে লাঞ্ছিত করার জন্য নানা কৌশল অবলম্বন করে। তার অজান্তে তার পোশাকের একটা অংশ এমনভাবে বেঁধে রাখে যে সে যখন উঠে দাঁড়ায় তখন তার শরীরের অনেকটাই অনাবৃত হয়ে যায়। মহিলাটি যখন চিৎকার করতে থাকে ইহুদীরা তখন তাকে নিয়ে উচ্চ শব্দে হাসাহাসি করতে থাকে।

একজন মুসলিম মহিলার এমন অপমান আর হেনস্থা সহ্য করতে না পেরে একজন মুসলিম যুবক এগিয়ে এসে রাগের মাথায় যে ইহুদী উত্যক্ত করেছিল তরবারি দিয়ে তাকে হত্যা করে ফেলে। ফলশ্রুতিতে অন্য উপস্থিত ইহুদীরা মুসলিমটির ওপর চড়াও হয়ে তাকে হত্যা করে ফেলে। এই ঘটনার জের ধরে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সৈন্যদল নিয়ে বনু কাইনুকা গোত্রের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেন। ইহুদিরা তাদের দূর্গে আশ্রয় নেয় এবং মুসলিমরা সেই দূর্গ অবরুদ্ধ করে রাখে পনের দিন।

চিন্তা করে দেখুন, এক মুসলিম নারীর অসম্মানে এক মুসলিম পুরুষের গাইরত এমনভাবে জেগে উঠেছে যে তিনি ইহুদিদের বাজারে ইহুদিকে মেরে ফেলেন। এর ফলাফল নিশ্চয়ই তাঁর অজানা ছিলনা। তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে তাঁর মুসলিম বোনের সম্মানের জন্য সোচ্চার হয়েছেন। যে ঘটনার ফলস্বরূপ পুরো মুসলিম বাহিনী সক্রিয় হয়ে উঠেছে তার মূল কারণ কি ছিল?

একজন মুসলিম পুরুষের দেমাগ হবে এমন যে কোনো নারীকে সামান্যতম অস্বস্তিতে ফেলার চিন্তাও কখনো মনে আসবেনা। মুসলিম নারীর সম্ভ্রম রক্ষায় সদা সোচ্চার থাকবে। আপন স্ত্রী ছাড়া পৃথিবীর কোনো নারীর দিকে কামনার দৃষ্টিতে তাকাবেনা, আসলে তাকাবেই না, দৃষ্টি অবনত রাখবে৷ নারীকে নারী হয়ে থাকতে গেলে পুরুষের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঘরে থাকলে ঘরের পুরুষের ভূমিকা, বাইরে গেলে বাইরের পুরুষেরও। মসজিদগুলোতে নারীদের নামাজের ব্যবস্থা থাকলে নারীদের জন্য বাইরে গেলে নামাজ, ব্রেস্টফিডিং কিংবা ইমার্জেন্সি ওয়াশরুমে যাওয়ার প্রয়োজন ইত্যাদি খুব সহজ হয়ে যেত। ফ্লেক্সিবল শিক্ষাব্যবস্থা এবং সাপোর্টিভ সামাজিক ব্যবস্থা তৈরি করতে পারলে উচ্চশিক্ষা কিংবা সময়মত বিয়ে-সন্তান এই দুইয়ের মধ্যে নারীকে একটি বেছে নিতে হতনা। বাসায় বসে কি করো কিংবা অর্থের খোঁটা না শুনলে অসংখ্য নারী সন্তান সংসারকে সময় না দিয়ে অফিসে সময় দিতনা। অশ্লীল দৃষ্টি কিংবা স্পর্শের শিকার না হলে বহু নারী মনে মনে পুরুষবিদ্বেষী হয়ে যেতনা। নারী ফিতরাতগতভাবে নারী হয়েই থাকতে চায়। তাকে নারী হিসেবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ কাউকে করে দেওয়ার প্রয়োজন নেই, কেবল কেউ অন্তরায় সৃষ্টি না করুক। সে নিজেই নিজেকে গড়তে জানে।

লেখকের ফেসবুক পেইজ থেকে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top