মেয়েরা সিগারেট খেলে সমস্যা কী

ইরফান সাদিক

‘সিগারেট শরীরের জন্য খারাপ? ছেলেদের জন্যও তো খারাপ। প্রকাশ্যে ধূমপান আইনগতভাবে নিষিদ্ধ? পুরুষের জন্যও তো একই। সিগারেট খাওয়া হারাম? পুরুষের জন্য তো আর হালাল না। তাহলে সমস্যাটা এখানে কোন জায়গায়? মেয়েরা খেলেই কেন সমস্যা? এটা কি মিসোজিনি বা নারীবিদ্বেষ না? অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে?’

আছে। ব্যাখ্যা আছে। আগে চলুন একটা ঘটনা জেনে আসি।

(আগেই বলে রাখি, আমার লেখার অডিয়েন্স বড় টিপ, স্লিভলেস ব্লাউজ, বিশ্রী নথওয়ালি, রাস্তায় প্রকাশ্যে চুমু কিংবা সিগারেট খেতে চাওয়া কোনো নারীবাদি না। আমার লেখার টার্গেট সাধারণ মেয়েরা, যারা “নারী স্বাধীনতা”, “নারী সমানাধিকার” চান, আবার এদিকে এদের কাজকেও ঠিক মন থেকে মেনে নিতে পারেন না, তাদের জন্য।)

[১]

এডওয়ার্ড বার্নেইসকে বলা হয় প্রোপাগান্ডার জনক। সিগমুন্ড ফ্রয়েড ছিলো তার মামা। তাকে একটা সিগারেট কোম্পানি তাদের বিক্রি বাড়ানোর জন্য হায়ার করে। সে চিন্তা করলো পুরুষদের মধ্যে যারা সিগারেট খায়, তারা সহজে ব্র্যান্ড চেইঞ্জ করবে না। এজন্য আমাদের নতুন কাস্টোমার ধরতে হবে। এ কাস্টোমার শ্রেণী হলো নারীরা।

উল্লেখ্য, পশ্চিমা সমাজে তখন নারীরা ধূমপান করতো না। অন্তত প্রকাশ্যে না।

এরপর বার্নেইস নানা ধরণের বিষয় প্রচার করতে থাকলো। তার মধ্যে একটা হলো, সিগারেট খাওয়া হলো নারী স্বাধীনতার প্রতীক। ছেলেরা খেতে পারলে মেয়েরা কেন পারবে না? এটার জন্য সে এমনকি প্যারেডের ব্যবস্থা করলো, যেখানে একটা ট্রাকের পেছনে ছোট ছোট কাপড় পরা মেয়েরা সিগারেট ফুঁকছিলো। দ্রুত এ খবর ছড়িয়ে পড়লো।

এরপর সমাজে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হলো। একটা ছোট, কিন্তু উল্লেখযোগ্য অংশ প্রশ্ন করা শুরু করলো, “আসলেই তো! নারীরা ধূমপান করলে সমস্যা কোথায়?”

এরপর থেকে সিগারেট হয়ে গেলো নারী স্বাধীনতার প্রতীক। স্বাধীনচেতা মেয়েরা প্রকাশ্যে সিগারেট ফোঁকা শুরু করলো। স্বাভাবিকভাবেই রক্ষণশীল সমাজে আক্রমণের শিকার হতো তারা। এরপর সেটা প্রচার হয়ে গেলে আরো কিছু মেয়ে সিগারেট খাওয়া শুরু করতো। এভাবে ক্রমশ সমাজে ছড়িয়ে পড়লো।

এবার কয়েকটা প্রশ্ন করি।

১. এডওয়ার্ড বার্নেইস কি আসলেই নারীদের স্বাধীনতা দিতে চেয়েছিলো? নাকি সে চেয়েছিলো তার কোম্পানির সিগারেটের বিক্রি বাড়াতে?

২. বার্নেইস এ কথা আনার আগ পর্যন্ত যে নারীরা সিগারেট খেতো না, তাদের কেন সিগারেট খেতে ইচ্ছে হলো না? কেন মনে হলো না সিগারেট খাওয়ার স্বাধীনতা না পেয়ে তারা দমবন্ধ হয়ে মরে যাচ্ছে? কেন এটাকে নিপীড়ন বা নারীবিদ্বেষ হিসেবে দেখলো না?

ভাবুন। আমরা পরের আলোচনায় যাই।

[২]

প্রতিটি রক্ষণশীল, ট্রেডিশনাল সমাজে নারীকে একটা আলাদা মর্যাদায় দেখা হয়। নারীকে মনে করা হয় পবিত্র, সম্মানের, মর্যাদার। কোনো ছেলে বা মেয়েকে যদি বলা হয় তার বাবা মদ খায়, এটাতে সে যতটা না কষ্ট পাবে, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি কষ্ট পাবে, লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে চাইবে যদি শোনে তার মা মদ খায়।

ছেলেরা নষ্ট হতে পারে, এটা মোটামুটি সবাই সহজভাবে নেয়। মনে করে, ছেলেরা মোর প্রোন টু নষ্টামি। কিন্তু মেয়েকে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে দেখা হয়। তাই বাবা বারবার ছেলেকে বলেন, “বাবা, মনে রাখিস, মেয়েরা কিন্তু মায়ের জাতি।” কিন্তু মেয়েকে ছেলের জাতিকে বাবার জাতি হিসেবে দেখার সতর্কতা দেওয়া হয় না। প্রথম ক্ষেত্রে নারীজাতিকে সম্মান দেওয়া হচ্ছে, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে নারীজাতিকে আলাদা বেনেফিট অফ ডাউট দেওয়া হচ্ছে।

সদ্য কৈশোরে পড়া ছেলেটা পছন্দের মেয়েকে মনে করে পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্রতম মেয়ে- তার ব্যাকগ্রাউন্ড জানুক বা না জানুক। জীবনভর মেয়েবাজি করা ছেলেটাও নিজের বোনের দিকে কেউ চোখ তুলে তাকালে, সে চোখ উপড়ে ফেলতে চায়। টাইটানিকের ধ্বংসকালে সব দায়িত্বশীল পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও, কমান্ডটা থাকে, Women and children first!

মেয়েদের শালীনতা ও আত্মমর্যাদাকে দেখা হয় সমাজের শালীনতা ও আত্মমর্যাদার সাথে যুক্ত করে। তাই নেপোলিয়ন বলেছেন শিক্ষিত মা দিতে; শিক্ষিত বাবা দিতে না। রাসূলুল্লাহ ﷺ মায়ের পায়ের নিচে জান্নাত বলেছেন, মেয়ে হওয়াকে জান্নাত পেয়ে যাওয়া বলেছেন। খারাপ বাবার ভালো ছেলে থাকতে পারে, কিন্তু সব মহান পুরুষের মা-ই মহীয়সী সব নারী।

একটা সমাজে নারী, পুরুষের সাথে সমানভাবে নষ্ট হয় না। যে নষ্টামি নারী আজকে শুরু করবে, সেটা পুরুষ শুরু করেছে এট লিস্ট ৫-৭ বছর আগে। বাংলাদেশে নারী পুরুষকে ধর্ষণ করে না; ইংল্যান্ডে করে। আমেরিকার বিখ্যাত মদের উপরে প্রহিবিশন কিন্তু হয়েছিলো নারীদের ক্রমশ হস্তক্ষেপের কারণেই। নারীরা সভ্যতার লাস্ট লাইন অফ ডিফেন্স।

কোনো সমাজে পুরুষরা নষ্ট হতে পারে। কিন্তু নারীরা যদি ঠিক পথে থাকে তাহলে শূন্য থেকে সে সমাজ ঘুরে দাঁড়াতে পারে। তাতারদের সময়ে দেখুন। দাসি মুসলিম নারীরা শূন্য থেকে ইসলামের একটা প্রজন্ম দাঁড় করিয়েছেন। ইমাম শাফেয়ীর বাবা না থাকলেও মা তাকে নিয়ে দেশে দেশে ঘুরে একজন জগদ্বিখ্যাত ইমাম বানিয়ে ফেলেছেন।

নারী যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে ধরে নেবেন, সে সমাজও শেষ।

[৩]

বার্নেইসের গল্প বলার যে দুটো প্রশ্ন করেছিলাম সেগুলোতে ফিরে যাই।

একটা জিনিস ভাবুন তো, যারা নারী অধিকারের কথা বলে, যারা নারী স্বাধীনতার বুলি আওড়ায়, তারা কি আদৌ আপনার যা দরকার সেটা নিয়ে কথা বলে? উদাহরণ দেখুন।

আমাদের সমাজে একটা বড় ক্রাইসিস হলো সম্পদে নারীদেরকে তাদের হক্ব দেওয়া হয় না। এটা নিশ্চিত করতে নারীবাদিরা কি আদৌ কোনো কাজ করে? না। বরং তারা সমান অধিকারের কথা বলে। অথচ এমন সমাজ যেখানে সামগ্রিকভাবে পুরুষের হাতেই থাকে অর্থনৈতিক দায়িত্ব, সেখানে এ দাবি অর্থহীন। হক্বটার আন্দোলন করা জরুরি।

আরেকটা জিনিস দেখুন। বস্তির মহিলারা, যারা ইট ভাঙে, কিংবা গার্মেন্টসে কাজ করে, তাদের অধিকারের জন্য কী ভূমিকা রাখে নারীবাদিরা? বইমেলায় ঘুরে বেড়ানো মিডল, হায়ার মিডল কিংবা হায়ার ক্লাসের মহিলাদের জন্য ন্যাপকিন-পিরিয়ড আসলেই কি কোনো ইস্যু? কিন্তু না, তারা সেটা নিয়েই বেশি কনসার্নড।

এমনিতেই তারা নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি, এখন এসেছে ট্র্যাশ নারীদেরকে (আসলে পুরুষ) নারীদের স্পেসে ঢোকাতে। অথচ যে দেশেই এসব করেছে, সবখানেই নারীর নিরাপত্তা নষ্ট হয়েছে। এসব ছদ্মবেশে থাকা পুরুষরা গিয়ে গিয়ে নারীদেরকে ধর্ষণসহ নানাকিছু করে রেখেছে। এসব সব পুলিশ কেইসেই আছে।

খোঁজ নিয়ে দেখুন, সত্যিকার নারীদের সত্যিকার সমস্যা নিয়ে এদের কোনো কাজ নেই। এরা নির্দিষ্ট এজেন্ডায় কাজ করে। আপনাকে জোর করে সিলি সব বিষয়ে নিপীড়িত ফিল করায়। আপনাকে প্রিন্সেসের মত রাখার জন্য হাড়ভাঙা খাটুনি করা আপনার বাবাসহ যাবতীয় পুরুষকে আপনার চোখে ভিলেন বানায়। নিজেদের নষ্টামির স্বার্থ হাসিল করতে।

সিগারেটের ব্যাপারটাই দেখুন। সিগারেট ফোঁকা তো খারাপ কাজই। এখন যদি সমাজ মেয়েদের সিগারেটকে খারাপ চোখে দেখে, আপনার তো খুশীই হওয়ার কথা। ভাবার কথা- যাক, এখনও সমাজের কারো কারো ক্ষেত্রে এটা খারাপই আছে। তা না ভেবে আপনি কেন নষ্টামিতে কম্পিটিশন করতে চাচ্ছেন? কেন সভ্যতা রক্ষার লাস্ট ডিফেন্ডার হতে চান না?

অথচ আল্লাহ বলছেন, ‘তোমরা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হও, যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীনের প্রশস্ততার মত। (সূরা আল-হাদীদ: ২১)

নিজের গুরুত্ব ও সম্মান বোঝার চেষ্টা করুন। নিজের মা, দাদী, নানীদের সম্মান দেখুন। ইমাম শাফেয়ীর মা, ইমাম মালিমের মা, সাইয়েদ কুতুবের মায়েদের কথা চিন্তা করুন। একইসাথে যারা আপনাকে নারী স্বাধীনতার সবক দেয় তাদের জীবনধারা দেখুন। মদ-গাঁজা, কাউন্টলেস লোকের সাথে শোয়া, বিড়াল নিয়ে শেষ বয়সে পচে মরা। এ জীবনটাই কি আপনি চান?

আল্লাহ সবাইকে বুঝ দিন।

লেখকের ফেসবুক থেকে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top