প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির তৃতীয় মেয়াদের প্রথম বছরে ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক অপরাধ আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে বলে উঠে এসেছে অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য প্রোটেকশন অফ সিভিল রাইটস (এপিসিআর) প্রকাশিত এক মানবাধিকার প্রতিবেদনে।
২০২৪ সালের জুন থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে দেশব্যাপী মোট ৯৪৭টি ঘৃণামূলক ঘটনার তথ্য রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে ২৯ জন মুসলিম নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ২৮ জন পুরুষ ও একজন নারী।
ঘৃণামূলক অপরাধের ভয়াবহ চিত্র
৯৪৭টি ঘটনার মধ্যে ৬০২টি ছিল সরাসরি ঘৃণামূলক অপরাধ এবং বাকি ৩৪৫টি ঘৃণামূলক বক্তব্যসংক্রান্ত। এই অপরাধগুলোর মধ্যে ১৭৩টি ঘটনায় সংখ্যালঘুদের ওপর শারীরিক সহিংসতা চালানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে এই ধরণের অপরাধের হার বেশি। ঘৃণামূলক অপরাধে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত রাজ্য উত্তর প্রদেশ, যেখানে ২১৭টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। বিজেপি শাসিত মোট ২৫টি রাজ্যের মধ্যে ১২টিতে ঘৃণামূলক অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। শীর্ষ পাঁচ ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্যের মধ্যে চারটিই ছিল বিজেপি শাসিত।
ঘৃণামূলক বক্তব্যের বিস্তার
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ঘৃণামূলক বক্তব্যের ৫০৪টি ঘটনায় কমপক্ষে ২,৯৬৪ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যার মধ্যে মুসলিমরা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী- ১,৪৬০ জন। এদের মধ্যে ৬৯১ জন পুরুষ এবং ৩৭৬ জন নারী।
এছাড়া ২৪টি ঘটনায় ৩০ জন মুসলিম শিশু এবং ১০টি ঘটনায় ১০ জন বয়স্ক ব্যক্তি ঘৃণার লক্ষ্যবস্তু হয়েছেন।
রাজনৈতিক দল ও তাদের সহযোগী সংগঠনের সদস্যরা ১০৯টি ঘৃণামূলক বক্তব্য দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) এবং বজরং দল এসব বক্তব্যের প্রধান উৎস। নির্বাচিত কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদি নিজেই পাঁচটি, মুখ্যমন্ত্রীরা ৬৩টি এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা ৭১টি ঘৃণামূলক বক্তব্য দিয়েছেন।
বিচার বিভাগ এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। দুইজন বিচারক, একজন রাজ্যপাল এবং একজন গ্রাম প্রধানের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক বক্তব্য প্রদানের অভিযোগ উঠেছে, যা ঘৃণার পরিধি ও গভীরতা নির্দেশ করে।
গবেষকদের উদ্বেগ ও মন্তব্য
প্রতিবেদনের অন্যতম গবেষক তাজিন জুনাইদ আল জাজিরা মুবাশ্বেরকে বলেন, ডানপন্থী হিন্দু গোষ্ঠীর মাধ্যমে সংঘটিত সহিংসতার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে এবং প্রশাসন কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তিনি ‘গরু পুলিশ’-এর উত্থানের কথাও তুলে ধরেন, যারা গরু ব্যবসায়ীদের উপর আক্রমণ করছে।
তাজিন বলেন, ‘ঘৃণামূলক অপরাধ ও বক্তব্য আজ সমাজে স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আমাদের লক্ষ্য এই স্বাভাবিকীকরণের বিরুদ্ধে একটি আলোচনা শুরু করা এবং সমাজের বিবেককে জাগ্রত করা।’
আইনি দৃষ্টিভঙ্গি ও নাগরিক সমাজের দায়িত্ব
ঘৃণামূলক অপরাধের শিকারদের প্রতিনিধিত্বকারী আইনজীবী মোহাম্মদ হুজাইফাহ বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও বিচার ব্যবস্থার ব্যর্থতা এই অপরাধের বিস্তারে ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, ‘এই প্রতিবেদন প্রমাণ করে রাষ্ট্রের জবাবদিহিতার ঘাটতি রয়েছে। নাগরিক সমাজকেই এখন এগিয়ে আসতে হবে, যাতে নির্যাতিত পরিবারগুলো ভয় বা চাপ ছাড়াই ন্যায়বিচার পেতে পারে।’
সূত্র : আল জাজিরা