২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের তৎকালীন প্রধান ইয়োসি কোহেন প্রকাশ করেন, কিভাবে তারা ২০ ইরানি এজেন্ট ব্যবহার করে তেহরানে ইরানের সামরিক পারমাণবিক সংরক্ষণাগার দখল করতে সক্ষম হয়েছিল।
তিনি বলেন, অভিযানের দুই বছর আগে আমরা জানতে পারি, ইরানের পারমাণবিক নথিপত্র কোথায় লুকানো আছে। পরে ভবনটির অভ্যন্তরে কাঠামোর মানচিত্র পাই। একটি মিত্র দেশে আমরা একইরকম একটি ভবন নির্মাণ করে সেখানে প্রশিক্ষণ দিই। ইসরাইলি নাগরিক নয় এমন ২০ এজেন্ট নিযুক্ত করা হয়। অভিযান চলাকালীন তারা সরাসরি ভিডিও পাঠায়, ফার্সি ভাষায় ব্যাখ্যা দেয়। নিরাপদ ঘরের ভেতরের নথি দেখে বুঝি, আমরা ইরানের সামরিক পারমাণবিক কর্মসূচির প্রমাণ পেয়েছি।
তখন ইরান এই ঘটনাকে ‘ভুয়া’ দাবি করে খারিজ করে দেয়। তবে ২০২৫ সালের ১৩ জুনের ইসরাইলি হামলা সেই দাবি ভেঙে দেয়। এটি শুধু বিমান হামলাই ছিল না; বরং মোসাদের বহু বছর ধরে গড়ে তোলা এক বিস্তৃত এজেন্ট নেটওয়ার্কও সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল।
এই হামলায় নিহত হন ইরানের সামরিক কাঠামোর শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা। এর মধ্যে রয়েছেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ হোসেইন বাঘেরি, আইআরজিসি প্রধান হোসেইন সালামি, খাতাম আল-আনবিয়া সদর দফতরের কমান্ডার আলী রশিদ, বিমান প্রতিরক্ষা কমান্ডার দাউদ শিহিয়ান, আইআরজিসি বিমান বাহিনীর প্রধান আমির আলী হাজিজাদেহ, ও জরুরি কমান্ডের কমান্ডার আলী শাদমানি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোয়েন্দা সহায়তা, বিমান পুনঃজ্বালানি ও অস্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে আক্রমণে অংশ নেয়। বিভিন্ন মিডিয়া জানায়, এফ-৩৫ হামলার আগে মোসাদ ভেতর থেকে মাঠ প্রস্তুত করে দেয়। ড্রোনের যন্ত্রাংশ, অস্ত্র ও বিস্ফোরক স্যুটকেস, ট্রাক ও কনটেইনারে করে ইরানে পৌঁছে দেয়া হয়। ছোট ছোট গোপন দল এসব ড্রোন কৌশলগত স্থানে স্থাপন করে। হামলা শুরু হলে তারাই লক্ষ্যবস্তু নিরপেক্ষ করে এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে দেয়।
এই নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছিল বিদেশে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এজেন্টদের মাধ্যমে, যারা ইরানের সরবরাহ লাইন ও সেনা কাঠামোয় প্রবেশ করে ধীরে ধীরে লক্ষ্য চিহ্নিত করে।
যদিও ইরান দীর্ঘদিন মোসাদের অনুপ্রবেশকে গুরুত্ব দেয়নি, পরে কয়েক ডজন এজেন্ট গ্রেফতার করে, যাদের কেউ কেউ মৃত্যুদণ্ড পায়। তবু ইরানি কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, মোসাদ শুধু সাধারণ সমাজেই নয়, ক্ষমতার শীর্ষ স্তর পর্যন্ত অনুপ্রবেশ করেছে।
২০১৮ সালের ঘটনার দুই বছর পর ২০২০ সালের নভেম্বরে ইরানের শীর্ষ পারমাণবিক বিজ্ঞানী মোহসেন ফখরিজাদেহকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ন্ত্রিত রিমোট-চালিত মেশিনগান দিয়ে হত্যা করা হয়। গোয়েন্দামন্ত্রী মাহমুদ আলাভি বলেন, হত্যাকাণ্ডে সহায়তাকারী একজন আইআরজিসি সদস্য ছিল। পরিচয় প্রকাশ না করলেও ইঙ্গিত ছিল যে তিনি মোসাদের এজেন্ট।
২০২১ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ বলেন, ‘ইসরাইল ইরানের ভেতরে জটিল অভিযান পরিচালনা করছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্র নীরব। এমনকি প্রতিরোধ ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিও ছিল ইসরাইলের এজেন্ট।’
২০২২ সালে হাসান রুহানির উপদেষ্টা ও সাবেক গোয়েন্দা মন্ত্রী আলী ইউনেসি বলেন, ‘গত দশকে মোসাদ ইরানি রাষ্ট্রের সর্বত্র অনুপ্রবেশ করেছে। এখন তারা প্রকাশ্যে কর্মকর্তাদের হুমকি দিচ্ছে। এটি একজন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তার জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক।’
২০২৪ সালের ৩১ জুলাই একটি রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি নিহত হন। এরপর তার উত্তরসূরি মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বিপ্লবী গার্ডের একটি সুরক্ষিত অতিথিশালায় হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে লক্ষ্য করে মোসাদ একটি টার্গেটেড হামলা চালায়।
মধ্যপ্রাচ্যে মোসাদের ছায়া : হানিয়াহ হত্যা ও হিজবুল্লাহে অনুপ্রবেশের চিত্র
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, হামাস নেতা ইসমাইল হানিয়াকে হত্যার জন্য ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইরানের বিপ্লবী গার্ডের মধ্যকার নিজস্ব এজেন্টদের ব্যবহার করেছিল।
যখন গাজায় গণহত্যা চলছিল, ইসরাইল লেবাননের দিকে মনোযোগ ঘুরিয়ে হিজবুল্লাহকে লক্ষ্যবস্তু করে। পরে স্থল অভিযান চালায়। এটি ইরান ও হিজবুল্লাহর অভ্যন্তরে মোসাদের অনুপ্রবেশের গভীরতা স্পষ্ট করে তোলে।
একটি ব্যতিক্রমী অভিযানে, মোসাদ হিজবুল্লাহর যোগাযোগে ব্যবহৃত পেজারগুলোতে একযোগে বিস্ফোরণ ঘটায়, যাতে প্রায় ৩ হাজার নেতা ও সদস্য নিহত হয়। এই অভিযান পরিচালিত হয়েছিল দুটি উৎস থেকে- একটি ইসরাইল থেকে, অন্যটি ইরানের ভেতর থেকে। বিস্ফোরক পেজারগুলো সরবরাহ করা হয়েছিল ইরানের ভেতর থেকেই। আর সেগুলোকে রূপান্তর করেছিল মোসাদ।
তবে এখানেই ইসরাইলের অভিযান থেমে থাকেনি। তারা একে একে হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতাদের হত্যা করতে থাকে।
-১৬ জুন : নাসের ইউনিটের কমান্ডার সামি তালেব আবদুল্লাহ
-৩ জুলাই : আজিজ ইউনিটের কমান্ডার মুহাম্মদ নি‘মাহ নাসের পরে সামরিক প্রধান ফুয়াদ শুকর।
-২০ সেপ্টেম্বর : রাদওয়ান ইউনিটের কমান্ডার ইব্রাহিম আকিল
-২৪ সেপ্টেম্বর : সিনিয়র কমান্ডার ইব্রাহিম মুহাম্মদ কাবসি
-২৬ সেপ্টেম্বর : বিমান ইউনিটের প্রধান মুহাম্মদ হুসেইন সুরুর
-২৭ সেপ্টেম্বর : হিজবুল্লাহর শীর্ষ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ
নাসরুল্লাহর হত্যার কয়েকদিন আগে ২৪ সেপ্টেম্বর লেবাননের আরব ইসলামিক কাউন্সিলের মহাসচিব মুহাম্মদ আলী আল-হুসেইনি তাকে একটি টিভি সাক্ষাৎকারে সতর্ক করে বলেন, ‘আপনি যদি জানতেন ইরান আপনার সম্পর্কে কী বলছে, তবে আপনি হয়তো এখনই আপনার উইল লিখে ফেলতেন। জেরুজালেমে প্রবেশের স্বপ্ন আপনাকে প্রতারিত করেছে, আর আপনার অংশীদাররা আপনাকে ছেড়ে দিয়েছে।’
ফরাসি দৈনিক লি পার্সিয়ান জানায়, একজন ইরানি এজেন্ট ইসরাইলকে তথ্য দিয়েছিল যে নাসরুল্লাহ শুক্রবার বৈরুতের দক্ষিণে হিজবুল্লাহ সদর দফতর পরিদর্শন করবেন। পত্রিকাটি উল্লেখ করে, এই এজেন্ট ‘ইরানি শাসনব্যবস্থার অভ্যন্তর থেকেই’ এসেছিল।
হত্যার পর হুসেইনি বলেন, ‘ইরান পারমাণবিক স্বপ্নের বিনিময়ে নাসরুল্লাহকে বিক্রি করেছে। সমন্বয়কারীরা তেহরান থেকে এসেছিল। আমি শপথ করে বলছি, নাসরুল্লাহর স্থলাভিষিক্ত যে হবে, তাকেও হত্যা করা হবে। ইরান সব তথ্য ফাঁস করেছে।’
এখানে ‘ইরান’ বলতে বোঝানো হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের অভ্যন্তরে মোসাদের এজেন্টদের। কারণ এই নেতাদের অবস্থান জানতেন শুধু তারাই, যারা একই পর্যায়ের নিরাপত্তা স্তরে কাজ করে বা যারা ইরানি গোয়েন্দা সংস্থায় মোসাদের হয়ে সক্রিয়।
প্রকৃতপক্ষে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির বাসভবনের এলাকায় বোমা হামলার ঘটনাও প্রমাণ করে, মোসাদের কাছে ইরানের গভীর অভ্যন্তরের স্পষ্ট তথ্য রয়েছে।
তবে মোসাদের কার্যক্রম কেবল ইরানেই সীমাবদ্ধ নয়। এই ঘটনাগুলো প্রমাণ করে, ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকে বছরের পর বছর ধরে একটি গুপ্তচরবৃত্তির নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে, যা এখনো সুনির্দিষ্ট ও প্রাণঘাতী অভিযান পরিচালনায় সক্ষম।
এই ইসরাইলি ছায়া-যন্ত্রটি এখন গোটা অঞ্চলের রাষ্ট্র ও স্থিতিশীলতার জন্য এক বাস্তব হুমকিতে পরিণত হয়েছে।
সূত্র : আল জাজিরা