ইরান, যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্র-ইরান : বন্ধু থেকে যেভাবে হয়ে ওঠে চিরশত্রু

টুডেনিউজ ডেস্ক

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রোববার ইরানে সরাসরি হামলার নির্দেশ দিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে কয়েক দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র-ইরান উত্তেজনা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ট্রাম্প জানিয়েছেন, ইরানের গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ‘ধ্বংস’ করা হয়েছে।

১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইরান আমেরিকার অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর থেকে ইরানের পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অঞ্চলজুড়ে প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোর প্রতি তেহরানের সমর্থন এবং মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন হস্তক্ষেপ এসব ইস্যুতে দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলতে থাকে।

দীর্ঘদিন ধরে ইরানকে হুমকি হিসেবে দেখে আসা ইসরাইল গত সপ্তাহে তেহরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অভিযোগ তুলে নজিরবিহীন হামলা চালায়। যদিও এই দাবির পক্ষে কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই, তবুও ওই হামলার পর ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলেন।

রোববারের হামলায় যুক্তরাষ্ট্র ১২৫টির বেশি যুদ্ধবিমান ও ৭৫টির মতো নির্ভুল বোমা ব্যবহার করেছে, যা ট্রাম্প প্রশাসন ‘অত্যন্ত পরিশীলিত গোপন আক্রমণ’ বলে অভিহিত করেছে। ওয়াশিংটনের দাবি, এতে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস হয়েছে। তবে তেহরান সতর্ক করে দিয়েছে, তারা এর প্রতিশোধ নেবে।

মার্কিন-ইরান সম্পর্কের সময়রেখা

(১৯৫৩) মার্কিন-সমর্থিত অভ্যুত্থান ও শাহের প্রত্যাবর্তন

গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইরানি প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক অ্যাংলো-ইরানিয়ান অয়েল কোম্পানি (বর্তমানে বিপি) জাতীয়করণের উদ্যোগ নেয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সাথে উত্তেজনা শুরু হয়। ১৯০০-এর দশকে তেল আবিষ্কারের পর থেকে ব্রিটিশরা এই কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে ছিল। ১৯৫১ সালে মোসাদ্দেকের জাতীয়করণ উদ্যোগ ব্রিটিশদের ক্ষুব্ধ করে। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এক যৌথ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং রাজা পাহলভিকে পুনরায় শাহ হিসেবে ক্ষমতায় বসায়।

(১৯৫৭) ‘অ্যাটমস ফর পিস’ চুক্তি

পারমাণবিক শক্তির ক্ষেত্রে ইরানের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে তখনকার মার্কিন সরকার ও পশ্চিমা মিত্ররা সমর্থন জানায়। প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারের ‘শান্তির জন্য পারমাণবিক শক্তি’ কর্মসূচির আওতায় ইরানের সাথে একটি বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে একটি পারমাণবিক চুল্লি ও ইউরেনিয়াম সরবরাহ করে। এই সহযোগিতা ভবিষ্যতের পারমাণবিক বিতর্কের ভিত্তি গড়ে তোলে।

(১৯৭৯) ইসলামি বিপ্লব

যখন তেহরান ও ওয়াশিংটনের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল, তখন ইরানিরা শাহের একনায়কতন্ত্র ও পশ্চিমা প্রভাবশালী অর্থনীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ১৯৭৮ সালের শেষ দিকে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয় এবং ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে শাহ দেশত্যাগে বাধ্য হন। এরপর নির্বাসিত ইসলামি নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি দেশে ফিরে এসে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন।

(১৯৮০) যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে

নির্বাসনে থাকা শাহকে ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে নেয়ার পর ক্ষুব্ধ ইরানি ছাত্ররা তেহরানে মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালায় এবং ৫২ জন মার্কিন নাগরিককে ৪৪৪ দিন বন্দী করে রাখে। এর জবাবে ওয়াশিংটন ইরানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। একই সময় শাহ যুক্তরাষ্ট্রে মারা যান।

(১৯৮০–৮৮) ইরান-ইরাক যুদ্ধ ও মার্কিন পক্ষপাত

ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে ইরান আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্র ইরাককে সমর্থন দেয়। এর ফলে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে আরো উত্তেজনা তৈরি হয়। আট বছরব্যাপী এই যুদ্ধে উভয় পক্ষেই লক্ষাধিক মানুষ নিহত হয়। ইরাক যুদ্ধকালে ইরানের ওপর রাসায়নিক অস্ত্রও ব্যবহার করে।

(১৯৮৪) সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা

লেবাননে একের পর এক হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান ইরানকে ‘উগ্রবাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষক’ হিসেবে ঘোষণা করেন। বৈরুতের একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলায় ২৪১ জন মার্কিন সেনা নিহত হয়। যুক্তরাষ্ট্র ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহকে দায়ী করে। পরে রিগ্যান সরকার হিজবুল্লাহর হাতে বন্দি মার্কিন নাগরিকদের মুক্ত করতে ইরানের সাথে গোপনে সমঝোতা করে। ওই চুক্তিটি ‘ইরান-কন্ট্রা’ কেলেঙ্কারি হিসেবে পরিচিতি পায়।

(১৯৮৮) ইরান এয়ারের বিমান ভূপাতিত

৮ জুলাই একটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ইরানি জলসীমা অতিক্রম করে ভুলবশত দুবাইগামী ইরান এয়ারের একটি যাত্রীবাহী বিমান ভূপাতিত করে। এতে ২৯০ জন যাত্রী নিহত হন। যুক্তরাষ্ট্র এটিকে ভুল বলে দাবি করলেও কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে দায় স্বীকার করেনি বা ক্ষমা চায়নি। পরে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে মোট ৬১.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করে।

(১৯৯৫) কঠোর নিষেধাজ্ঞা

১৯৯৫–৯৬ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে আরো কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন একটি নির্বাহী আদেশে মার্কিন কোম্পানিগুলোর সাথে ইরানের বাণিজ্য নিষিদ্ধ করেন। একই সময়ে কংগ্রেস একটি আইন পাস করে, যার মাধ্যমে ইরানের জ্বালানি খাতে বিনিয়োগকারী বিদেশি কোম্পানি এবং উন্নত অস্ত্র সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র এর পেছনে ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম এবং হিজবুল্লাহ, হামাস ও ইসলামিক জিহাদের মতো গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থনকে কারণ হিসেবে তুলে ধরে।

(২০০২) ৯/১১-এর পরবর্তী ঘটনা

যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার পর রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লিউ বুশ ‘স্টেট অফ দ্য ইউনিয়ন’ ভাষণে ইরানকে ইরাক ও উত্তর কোরিয়ার সাথে ‘অশুভের অক্ষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ওই সময় ইরান, আফগানিস্তানের তালেবান ও আল-কায়েদার বিরুদ্ধে গোপনে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমন্বয় করছিল। পরে এই সহযোগিতা ভেঙে পড়ে। ২০২২ সালের শেষ দিকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা ইরানে উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম শনাক্ত করেন, যা নতুন করে নিষেধাজ্ঞার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

(২০১৩) ইরান পারমাণবিক চুক্তির সূচনা

২০১৩ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইরানের সাথে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা শুরু করেন। ২০১৫ সালে ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অফ অ্যাকশন’ (জেসিপিওএ) নামে পরিচিত চুক্তিতে তেহরান সম্মত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী, নিষেধাজ্ঞা শিথিলের বিনিময়ে ইরান তার পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত করবে। চুক্তির পক্ষভুক্ত ছিল চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এতে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের সীমা ৩.৬৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়।

(২০১৮) ট্রাম্প চুক্তি বাতিল করেন

২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একতরফাভাবে জেসিপিওএ চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন এবং ইরানের বিরুদ্ধে পুনরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। ট্রাম্প এবং ইসরাইল চুক্তির কড়া সমালোচনা করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরান চুক্তি লঙ্ঘন করে অধিকমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে শুরু করে।

(২০২০) কাসেম সোলাইমানি হত্যাকাণ্ড

ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে বাগদাদে এক ড্রোন হামলায় আইআরজিসির অভিজাত কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করা হয়। এর এক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র কুদস ফোর্সকে ‘উগ্রবাদী সংগঠন’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিল। সোলাইমানির মৃত্যুর প্রতিক্রিয়ায় ইরান ইরাকে মার্কিন অবস্থানগুলোর ওপর হামলা চালায়।

(২০২৫) চিঠি ও আলোচনার প্রস্তাব

২০২৫ সালের মার্চে ট্রাম্প ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে একটি চিঠি লেখেন, যেখানে ৬০ দিনের সময়সীমার মধ্যে একটি নতুন পারমাণবিক চুক্তির প্রস্তাব দেন। খামেনি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র আলোচনার নামে চাপ সৃষ্টি করছে। পরে ওমান ও ইতালিতে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়, যেখানে মাস্কাট মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা রাখে। ট্রাম্প দাবি করেন, তার দল একটি চুক্তির ‘খুব কাছাকাছি’ পৌঁছেছিল এবং ইসরাইলকে হামলা না চালাতে সতর্ক করেছিলেন। তেহরানও আশাবাদ ব্যক্ত করে, তবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার অধিকার রক্ষার বিষয়টি আলোচনার প্রধান অন্তরায় ছিল। আলোচনার ষষ্ঠ দফা শুরুর একদিন আগে ইসরাইল ইরানজুড়ে হামলা চালায়।

(২০২৫) মার্কিন হামলা

ইসরাইলের নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়।

সূত্র : আল জাজিরা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top