টুডেনিউজ বিডি ডটনেট
বিশ্ব অর্থনীতি যখন নানা অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে, তখন নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়েছে দুই বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে। হুমকি, পাল্টা হুমকি আর একের পর এক শুল্ক আরোপের পদক্ষেপে বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ, বাজারে নেমেছে ধস, আর শুরু হয়েছে এক নতুন ধরণের বাণিজ্যিক যুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে জোর আলোচনা।
গত বৃহস্পতিবার, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণার পর চীন পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে তার মার্কিন পণ্যে উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিকারী অন্যান্য সব দেশের উপরও সর্বনিম্ন ১০ শতাংশ হারে শুল্ক বসায়। ট্রাম্প এই দিনটিকে আখ্যা দেন “মুক্তি দিবস” হিসেবে। ফলস্বরূপ, বিশ্ব শেয়ার বাজারে দেখা দেয় ব্যাপক অস্থিরতা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
শুধু এখানেই থেমে থাকেননি ট্রাম্প। সোমবার ট্রুথ সোশ্যাল নেটওয়ার্কে দেওয়া এক পোস্টে তিনি চীনকে হুমকি দেন, যদি বেইজিং তাদের সর্বশেষ শুল্ক প্রত্যাহার না করে, তবে মঙ্গলবারের (৮ এপ্রিল, ২০২৫) মধ্যে চীনের আমদানির উপর অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে। এটি কার্যকর হলে চীনা পণ্যে মোট মার্কিন শুল্ক দাঁড়াবে ১০৪ শতাংশে।
চীন অবশ্য এ হুমকিকে আমল না দিয়ে পাল্টা সুরে জানিয়ে দেয়, তারা কোনো অবস্থাতেই পিছু হটবে না। চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলে, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও ধমকস্বরূপ। যদি আমেরিকা নিজের পথে চলতেই থাকে, তবে চীন শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে।”
এই নতুন উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে গত শুক্রবার চীন মার্কিন পণ্যে ৩৪ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়। এর ফলে চীনের আরোপিত মোট শুল্ক ৪৪ থেকে ৪৯ শতাংশে পৌঁছেছে। চীন একইসাথে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত বিরল মাটির উপাদানের রপ্তানি সীমিত করেছে এবং মার্কিন প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর কাছে দ্বৈত-ব্যবহারযোগ্য পণ্য সরবরাহ বন্ধ করেছে।
এদিকে, ট্রাম্প জানিয়েছেন যে চীনের সাথে চলমান আলোচনা বাতিল করা হবে এবং যারা শুল্ক নিয়ে আলোচনার অনুরোধ করেছে, তাদের সাথে আলোচনা অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, “অন্যান্য দেশগুলির সাথে আলোচনা, যারা বৈঠকের অনুরোধ করেছে, তাদের সাথে অবিলম্বে আলোচনা শুরু হবে।”
এর পটভূমিতে দেখা যায়, ট্রাম্পের শুল্কনীতি একঘেয়ে নয় বরং বিস্তৃত ও ব্যাপক। গত বুধবার, প্রেসিডেন্ট প্রায় সমস্ত বাণিজ্য অংশীদার দেশের ওপর ১০ শতাংশ বেসলাইন শুল্ক ঘোষণা করেন। কয়েক ডজন দেশের ওপর আরও উচ্চতর হারে শুল্ক আরোপ করা হয়েছে — যাদের তিনি “সবচেয়ে খারাপ অপরাধী” বলে অভিহিত করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকার ছোট দেশ লেসোথোর উপর সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ শুল্ক বসানো হয়েছে।
চীনের ক্ষেত্রেও এই কঠোরতা পরিলক্ষিত হয়েছে। দেশটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে বছরে ৪৩০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি আমদানি করে, এবং এর উপরেই আরোপিত হয়েছে ৩৪ শতাংশ শুল্ক। জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ইতিমধ্যেই ট্রাম্প প্রশাসন দুই দফায় চীনা পণ্যে ১০ শতাংশ করে শুল্ক আরোপ করেছে। এর পর গত সপ্তাহের ঘোষণা যুক্ত হয়ে মোট শুল্ক দাঁড়ায় ৫৪ শতাংশে। যদি সোমবারের হুমকি কার্যকর হয়, তবে সেটি দ্বিগুণ হয়ে ১০৪ শতাংশে পৌঁছাবে।
বাণিজ্য যুদ্ধের প্রভাব ইতোমধ্যেই দু’দেশের অর্থনীতিতে দেখা দিতে শুরু করেছে। চীনা কোম্পানিগুলোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র একটি বড় রপ্তানি বাজার, বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস এবং যানবাহনের ক্ষেত্রে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র চীনে কৃষিপণ্য, যন্ত্রপাতি, ওষুধ এবং বিমান রপ্তানি করে থাকে। মরগান স্ট্যানলির পূর্বাভাস অনুযায়ী, এই সংঘাতের কারণে ২০২৫ সালে চীনের অর্থনীতি ১.৫ থেকে ২ শতাংশ পর্যন্ত দুর্বল হতে পারে।
বিশ্লেষকদের ধারণা, চীন পরবর্তী প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে মার্কিন কৃষিপণ্যের আমদানি বন্ধ করতে পারে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহৃত গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের রপ্তানি আরও কমিয়ে দিতে পারে।
অন্যদিকে, মার্কিন অর্থনীতিও অস্থির। সোমবার, শেয়ারবাজারে নেমে আসে ধস – S&P 500 কমে যায় ০.২ শতাংশ, ডাও জোন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল এভারেজ পড়ে ৩৪৯ পয়েন্ট বা ০.৯ শতাংশ, যদিও Nasdaq সামান্য ০.১ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়ানো গুজব অনুযায়ী, হোয়াইট হাউসের শীর্ষ অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কেভিন হ্যাসেট নাকি বলেছেন, রাষ্ট্রপতি শুল্ক স্থগিত করার কথা বিবেচনা করছেন। তবে হোয়াইট হাউস X-এ এটিকে “ভুয়া খবর” বলে উড়িয়ে দেয়।
ট্রাম্প নিজেও এই সম্ভাবনা খারিজ করে দেন। তিনি X-এ লেখেন, “আমেরিকা ইতিমধ্যেই বিদ্যমান শুল্কের উপর অপব্যবহারকারী দেশগুলি থেকে প্রতি সপ্তাহে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আনছে।” তার ভাষায়, “সবচেয়ে বড় অপব্যবহারকারী চীন, যার বাজার ইতিমধ্যেই ভেঙে পড়েছে, সে এখনো শুল্ক বৃদ্ধি করে অন্য দেশগুলোকেও আমেরিকার হুমকি উপেক্ষা করার বার্তা দিচ্ছে।”
সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে স্পষ্ট, এই বাণিজ্যিক বিবাদ শুধু দু’টি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় — এর অভিঘাত ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বজুড়ে। এবং যদি কোনো পক্ষ পিছু না হটে, তবে এই যুদ্ধ কেবল অর্থনীতিকেই নয়, বৈশ্বিক কূটনীতিকেও গভীরভাবে নাড়া দিতে পারে।
সূত্র : আল জাজিরা