জেলে, মাছ,

যেভাবে সংগ্রাম করে জেলেরা বাঁচে

সময়টা মার্চ মাস। সকাল পড়ে গেল। মাহফুজা বেগম তখন নদীর তীরে বসা। নদীতে বাতাস বইছে। সেই হাওয়া এসে ধুয়ে দিচ্ছে মাহফুজার দেহমন। তিনি খালি পায়ে এগিয়ে যান সরু নৌকার দিকে। দ্রুত জালের জট খুলে নেন আঙ্গুলের সাহায্যে। দেখে নেন কোনো ছেঁড়া-ফাড়া আছে কিনা। এ সময় দুজন নারী ও এক পুরুষ এগিয়ে আসে। তাকে নৌকা পানিতে নামাতে সাহায্য করে। উজানের স্রোত নেই। নদীর তীর তাই ভরাট হয়ে আছে। নৌকা নামাতে বেশ কষ্টই হলো। তবে কয়েক মিনিটের চেষ্টায় নৌকা পানিতে ভাসে। তিনি চেপে বসেন নৌকায়। স্রোতের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলে গভীর নদীতে।

প্রতিটি নৌকা এগিয়ে চলে। আর নদীতে আঁকা হতে থাকে এক অদৃশ্য পথ। তিনি পেরিয়ে যান ঘন সবুজ ম্যানগ্রোভের ছাউনির নিচ দিয়ে। আর্দ্র বাতাস তার মাথার ওড়নাটিকে টেনে ধরে। ৫২ বছর বয়সী এই নারী তার অভ্যস্ত হাতে ওড়নাটি আবার ঠিক করে নেন। চলতে থাকেন সামনে। ঘামের পুঁতি তার কপাল বেয়ে ধীরে ধীরে চোয়াল ছুঁয়ে নামে। প্রায় পাঁচ মিনিট পর নদীর মাঝামাঝি এসে দাঁড়ান তিনি। স্থির হয়ে এক মনোরম ভঙ্গিতে ভারী জালটি ফেলেন পানিতে। ধীরে ধীরে পানির বুকে ডুব দেয় জালটি। তিনি অপেক্ষার প্রহর গোনেন। একে একে পনেরো মিনিট কেটে যায়। তারপর তিনি জাল তুলতে শুরু করেন। জাল ওপরে উঠতেই তার মুখে ফুটে ওঠে এক ভুবনজয়ী হাসি। চিংড়িতে ভরে গেছে জাল।

চারপাশে কাদার গন্ধ। নদীর মৃদু নড়াচড়া আর পাতার খসখসে শব্দ ছাড়া আর কিছু নেই। ম্যানগ্রোভের শিকড়গুলো নদীর ধারে ঘন গুচ্ছ হয়ে মোচড় দিয়ে উঠে এসেছে। যেখানে ছাউনি ঘন, সেখানে সূর্যের আলো ঢুকতে পারে না, ছায়া গভীর। অন্যদিকে নদীর ওপারটা রয়ে গেছে রহস্যে ঢাকা।

মাহফুজা তার জীবন কাটিয়েছেন টিকে থাকার সংগ্রামে। বছরের পর বছর তিনি একা একা চালিয়েছেন নৌকা। জীবন সংগ্রামে পথ এঁকেছেন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম খুলনা অঞ্চলের সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা নদী পথে।

এই নদীগুলো কিছুটা বিস্তৃত ও জটিল পানিপথের অংশ। ছোট ছোট সরু খালে ভাগ হয়ে গভীর বনে হারিয়ে গেছে। ছাউনিগুলো কাছাকাছি চলে এলে জলের রং গাঢ় হয়ে যায়। তখন সূর্যের ছায়াপাতে তৈরি হয় একরকম ছিদ্রযুক্ত নকশা। এই শান্ত জলের ভেতরে জেলে পরিচয়ে থাকেন মাহফুজা। বিপদের সাথে তার প্রতিনিয়ত বসবাস করেন। কুমিররা নদীর নিচে গা ঢাকা দিয়ে থাকে। আর বাঘেরা ঘুরে বেড়ায় নদীর তীর ঘেঁষে।

তিনি জানেন, কিভাবে প্রাণীর উপস্থিতির ভাষা বুঝতে হয়। পানির প্রবাহ, বাতাসের হালকা শব্দ, হঠাৎ সুনসান নীরবতা নানা উপায়ে বুঝে ফেলেন তিনি। মাহফুজা বলেন, পানি শান্ত দেখালেও অনেক কিছু লুকিয়ে রাখে।

বছরের পর বছর ধরে বন সংকুচিত হচ্ছে। আর অল্প ভূমিতে গুছিয়ে আসছে প্রাণীকুল। ফলে বন্য প্রাণী ও জেলেদের পথ একাকার হয়ে যাচ্ছে। মাহফুজা বলেন, প্রাণীরা সাহসী হয়ে উঠছে। আমরা তাদের জমি দখল করেছি। তাই তারা আমাদের ভূমিও দখলে নিচ্ছে।’

শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর কমে গেলে মাহফুজা প্রায়ই কুমির দেখতে পান। তারা তার নৌকার পাশে তীব্র গতি ও হিংস্রতার সাথে পিছলে যায়। ফলে নৌকায় বসেও বড় সাবধানে থাকতে হয়।

মাহফুজা বাঘও দেখেছেন অনেকেবার। যদিও অধিকাংশ ঘটনা এমন- একঝলক বনের ভেতর শব্দ আর জ্বলে ওঠা একজোড়া চোখ।

২০১৯ সালের এক সকাল। জাল টানছিলেন মাহফুজা। হঠাৎ চারপাশ কেমন নীরব হয়ে যায়। পাখিরা নিশ্চুপ। প্রাণীরা যেন কিছু টের পেয়েছে। তিনি পেছনে তাকিয়ে দেখেন, মাত্র কয়েক মিটার দূরে নদীর ধারে একটি বাঘ তাকে লক্ষ্য করছে। ধীরে ধীরে তিনি একটি ধাতব পাত্র তুলে নিয়ে নৌকায় আঘাত করেন। কিন্তু বাঘটি নড়ে না। কিছুক্ষণ তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বাঘটি ঘুরে যায়। এরপর হারিয়ে যায় বনের গহীনে।

তিনি জানেন যে শব্দ করলে, গান গাইলে কিংবা ধাক্কা দিলে বাঘ ভয় পেতে পারে। কিন্তু সবসময় নয়। আর যদি বাঘ আক্রমণ করে, তাহলে কিছুই করার থাকে না। এই ভয়াবহ শিক্ষা তিনি পেয়েছিলেন ১৭ বছর আগে। এক বিকেলে মাহফুজা, তার বড় ছেলে আলমগীর, বড় ভাই শাহাদাত এবং তার ভাবী দু’টি নৌকায় চড়ে মাছ ধরতে বের হন। সূর্য তখন অস্ত যেতে শুরু করেছে। মাহফুজা ও আলমগীরের জাল ছিঁড়ে যাওয়ায় তারা বাড়ি ফিরে আসেন নতুন জাল আনতে। বাড়ির কাছেই যখন তারা নৌকা চালাচ্ছিলেন, হঠাৎ একটি গর্জন শোনা যায়। তারা যখন আবার ভাইয়ের নৌকার কাছে ফিরে আসেন, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। শাহাদাত নদীর ধারেই জাল বসাচ্ছিলেন। বাঘটি নিঃশব্দে এসে তাকে আক্রমণ করে, তার গলায় দাঁত বসিয়ে দেয়। শব্দ করারও সময় পাননি। তার স্ত্রী চিৎকার করতেই প্রাণীটি তাকে টেনে নিয়ে যায়, নৌকায় রক্ত ছড়িয়ে পড়ে।

মাহফুজা হতবাক হয়ে চেষ্টা করেন ভগ্নিপতিকে সান্ত্বনা দিতে। তাকে বাড়ি ফেরাতে। কিন্তু তিনি বারবারই বলছিলেন যে আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে চলে গেছে। বনের গভীরে তাকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেই রাতেই প্রায় ১৫০ জন গ্রামবাসী মশাল হাতে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। সাধারণত বাঘ রাতে শিকার করে না, আগুনকেও ভয় পায়। তারা শাহাদাত-এর দেহাবশেষ উদ্ধার করে মাহফুজার বাড়িতে নিয়ে আসে। পরদিন সকালেও মাহফুজা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হৃদয় তখনো আতঙ্কে ধড়ফড় করছিল। কিন্তু ভয় কোনো বিলাসিতা নয় যে তা বহন করা যাবে। ফলে তাকে নদীতে নামতে হয়।

তিনি বলেন, ‘আমার যদি ক্ষুধা লাগে, তাহলে আমাকে খাওয়ানোর কেউ নেই। আমার ক্ষুধা বাঘের কথা চিন্তা করে না। বাঘের ক্ষুধার কথাও চিন্তা করে না। এই ক্ষুধার টানেই আমাকে নদীতে নাও ভাসাতে হয়।’ এরপর কিছুটা দৃঢ়ভাবেই মাহফুজা বলেন, এটাই যদি আমার ভাগ্য হয়, তাহলে বাঘ আমাকেও নিয়ে যাবে।

মার্চের সেদিন নৌকায় ওঠার আগে মাহফুজা নদীর তীরে বসে ছিলেন। পরণে লাল সুতির কাপড়। ভেজা শরীরে লেপ্টে আছে শাড়ি। ছোট মাছ ধরছিলেন। তার মতো গ্রামে আরো আটজন নারী জেলে আছেন। ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সী তারা। পরিবারের সদস্যদের সাথেই মাছ ধরেন তারা। সেদিন সকালে তারা সবাই তীরে ছিলেন। প্রচণ্ড গরমে নদীতে যেতে পারছিলেন না। তিনজন নারী দূর থেকে তাকিয়ে ছিলেন। বাকিরা গাছের ছায়ায় নৌকা পালিশ করছিলেন। কেউ ঠিক করছিলেন জাল। মাহফুজা ইচ্ছা করেই নদীতে জাল ফেললেন। কোনো বিরতি ছিল না। ছিল না কোনো অযথা নড়াচড়া। কারণ, মাহফুজা গরমে অভ্যস্ত ছিলেন। ছিলেন কাজেও বেশ অভ্যস্ত। গাছের নিচে দাঁড়ানো এক তরুণী ডেকে বলল, তোমার গরম লাগে না? বাইরে তো একেবারে অসহ্য গরম।

মাহফুজা তার কথায় মুখ তুলে তাকালেন না। তিনি অভ্যস্ত গতিতে, অনুশীলিত মসৃণ নড়াচড়ায় জাল টেনে আনলেন। তার পেশিগুলো ছিল নমনীয়। পরে কী মনে করে পেছনে ফিরে বললেন, গরম তো লাগেই। কিন্তু মাছের তো এতে কিছু যায় আসে না। সেজন্য আমারও কিছু মনে হয় না। এ সময় অন্য নারীরা মুখ দেখাদেখি করলেন। কেউ খোক করে হেসে উঠলেন। আর কেউ সম্মানের দৃষ্টিতে তাকালেন মাহফুজার দিকে।

মাহফুজা ছোট মাছগুলো এক বালতিতে ঢেলে দিলেন। এরপর থেমে দাঁড়ালেন। হাতের উল্টো দিক দিয়ে ভ্রু মুছলেন। এরপর ওদের বললেন, তোমরা আসবে নাকি সূর্যের আলো পড়ার অপেক্ষা করবে? তখন একজন হেসে বললেন, ‘তুমি সত্যিই গরমে অভ্যস্ত হয়ে গেছো। মাহফুজা কথা না বাড়িয়ে একগাল হাসলেন। এরপর আবার অভ্যস্ত ভঙ্গিতে নদীতে ছুড়ে দিলেন জাল। মাছ তো পরিবেশ সহনীয় হওয়ার অপেক্ষায় থাকে না।

মাহফুজা ৯ নম্বর ওয়ার্ডে বেড়ে ওঠেন। গাবুরা দ্বীপের একটি জেলে গ্রামে এটি। সুন্দরবনের প্রায় ২০০টি দ্বীপের একটি এই গ্রাম। এর চারপাশে দাপটের সাথে প্রবাহিত খোলপেটুয়া নদী। আজও ওই গ্রামেই থাকেন মাহফুজা। প্রায় ৩৪ হাজার মানুষের বাস সেখানে।

৯ নম্বর ওয়ার্ডের মানুষ মাছ ধরে এবং বিক্রির জন্য মধু ও কাঠ সংগ্রহ করে। কিন্তু নদীর লবণাক্ত পানির কারণে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে গেছে। তাই চাষাবাদ করা যায় না। মাহফুজার জন্ম হয় গ্রামের সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারটিতে। তার বাবা দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন। কখনো ছোট নৌকা ভাড়া করার মতো টাকা থাকলে মাছ ধরতে যেতেন। মাহফুজা বলেন, আমার বাবা ছিলেন দরিদ্রতমদের মধ্যেও সবচেয়ে দরিদ্র। সেই কারণেই আমি খুব ছোটবেলা থেকে ভিক্ষা শুরু করেছিলাম। তখন ছয় কী সাত বছর বয়স। বয়সটাও ঠিক মনে নেই। আমি তখন মানুষের বাড়িতেও কাজ করতাম। থালা-বাসন আর কাপড় ধুয়ে দিতাম।’

মাহফুজা বাবা মায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে চতুর্থ। কিন্তু তিনি কখনো স্কুলে যেতেন না। এমনকি যাদের কাছে ভিক্ষা করতেন, তাদেরও তেমন কিছু ছিল না। তার সবসময়ই ক্ষুধা লাগত, খাবার বলতে থাকত শুধু ভাত, পানি আর লবণ।
তিনি পরতেন ছেঁড়া পুরোনো কাপড়। এটিও তিনি অন্যদের থেকে নিতেন। কিন্তু যখন তিনি তার বাবাকে নদী থেকে ফিরতে দেখতেন, তার জাল আর মাঝে মাঝে ধরা পড়া মাছ নিয়ে খেলতেন, তখন থেকেই তাঁর মনে কৌতূহল জন্মায়। মাহফুজা বলেন, বাবা কখনো আমাকে মাছ ধরা শেখাননি। এটা তার ইচ্ছার অভাব ছিল না। তিনি জানতেন না যে মেয়েরাও ছেলেদের মতো মাছ ধরতে পারে।’

মাহফুজা বলেন, তার বয়স যখন আট, তখন গ্রামের অন্য প্রান্তে এক অপরিচিত লোকের সাথে তার দেখা হয়। তার বয়স চল্লিশের মতো হবে। তিনি নদীর ধারে চিংড়ি ধরছিলেন। দেখতে আমার বাবার মতো ছিলেন। তাই আমি ভাবলাম, তার কাছে গিয়ে মাছ ধরার কথা জিজ্ঞাসা করি। এরপর আমি তাকে মাছ ধরার কৌশল জিজ্ঞেস করি। এতে তিনি খুবই অবাক হন। কারণ, মেয়েরা তো দূরের কথা, তার গ্রামের কেউই মাছ ধরত না। কিন্তু মাহফুজা জানিয়ে দেন যে তিনি পরিবার চালাতে চান। তাই লোকটি তাকে মাছ ধরার কৌশল শেখাতে রাজি হন।

লোকটি তখন মাহফুজা বলেন, ‘এটা বিপজ্জনক কাজ। যদি সত্যিই শিখতে চাও, তাহলে তোমাকে নিবেদিত হতে হবে।’ এরপর কয়েক মাসে ওই লোক তাকে নৌকা চালানো আর মাছ কোথায় থাকে তা বোঝার কৌশল শেখান। যেমন পানির পৃষ্ঠে বুদবুদ দেখা গেলে বোঝা যায় মাছ আছে। এছাড়া স্রোতে স্রোতে মাছ থাকে। পানি যদি শান্ত থাকে, মাছ গভীরে থাকে। যখন তা নড়ে, তখন মাছ খাবার খেতে উঠে আসে।’

মাহফুজা বলেন, তিনি আমাকে কখনো আলাদা ভাবেননি। এরপর তিনি নদীর তীরে মাছ ধরার অনুশীলন শুরু করেন। শুরুতে খুব কঠিন লাগতো। তিনি বলেন, তার গ্রামের পুরুষরা এসে বলত, তুমি তো মেয়ে, এত ছোট! মাছ ধরতে চাও কেন? তোমার জ্বালানি কাঠ আর চুলা আছে। যাও, রান্না করো।’ মাহফুজা আপন অবস্থানে অনড় ছিলেন। তিনি বলতেন, ‘যদি তুমি আমাকে মাছ ধরতে না দাও, তাহলে আমাকে খেতে দাও।’ এরপর মাহফুজা হেসে বলেন, আমার গ্রামের পুরুষরা এখন আমাকে ভয় পায়।

মাহফুজার মা-বাবা তার সাধনায় সহায়তা করেছিলেন। কারণ এখন তাদের মেয়ে পরিবারের জন্য মাছ এনে দিতো। তাকে শিকার করা মাছগুলো কিভাবে সামলাতে হয়, তা শেখার জন্য এবং সেগুলোকে ভালোভাবে বুঝতে সময় দিতো। ১২ বছর বয়সেই মাহফুজা নৌকা চালাতে, জাল ফেলতে এবং মাছ ধরে বাড়ি এনে বাজারে বিক্রি করতে পারতো। মাহফুজা বলেন, এরপর থেকে আমি পেট ভরে খেতে পারতাম। আমাকে আর অন্যদের কাছে ভিক্ষা করতে হতো না। আমি ভালোভাবে খেতে পারতাম, বাবা-মাকেও খাওয়াতে পারতাম। আমার মা তখন সার্ডিনও খেতে পারতেন। এটা ছিল তার প্রিয় মাছ। তখন আমি খুব গর্ব লাগতো।’

আজ মাহফুজা তার নাতি লাভলুর সাথে একটি ছোট টিনের ছাদের কুঁড়েঘর ভাগ করে থাকেন। এটি কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি, রঙ করা হয়েছে লাল, নীল আর সবুজে।

গাবুরায় পাকা রাস্তা নেই। মূল ভূখণ্ড থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় মাত্র পাঁচ মিনিটের পথ হলেও দ্বীপের অপর প্রান্তে মাহফুজার বাড়িতে পৌঁছাতে হয় মোটরসাইকেল বা সাইকেলে, খোঁড়াখুঁড়ি পথ ধরে। এক পাশে নদী, আর অন্য পাশে তার কুঁড়েঘর। ঘরটি নদী থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে, পামগাছে ঘেরা। কাছেই কিছু নৌকা উঁচু জমিতে গাছের সাথে বাঁধা। তার গ্রামের অন্যান্য নারীর মতো মাহফুজারও অল্প বয়সে বিয়ে হয়। কিন্তু ২২ বছর আগে তার স্বামী তিনটি ছোট সন্তানকে ফেলে অন্য এক নারীর সাথে চলে যায়। এ বিষয়ে মাহফুজা বলেন, আমি আমার বাচ্চাদের এই পৃথিবীতে এনেছি। আমি তাদের বড় করেছি, খাইয়েছি, বিয়ে দিয়েছি। আমি তাদের জন্য যা কিছু করা সম্ভব, সব করেছি। কেউ আমাকে থামাতে পারবে না।

মাহফুজার বিশ্বাস, পরিবারে যদি কোনো পুরুষ না থাকে, তবে একজন নারীকে মা ও বাবার উভয় ভূমিকা পালন করতে হয়। কিন্তু এই কথা বলার সময় তার কণ্ঠস্বর কেঁপে ওঠে।

আজ তার দুই ছেলে—যারা উভয়েই দিনমজুর—এবং এক মেয়ে, যিনি তালাকপ্রাপ্ত ও পরে পুনর্বিবাহিত, অন্যত্র থাকেন। তারা কেউই মাহফুজার কাছে ফিরে আসে না, না বাড়িতে, না ভরণপোষণে। কেউ আর্থিকভাবে সক্ষম নয়, কেউ আবার ইচ্ছুক নন।

তিনি বলেন, বিয়ের পরপরই তারা এত বছরের যত্ন ভুলে গেল। এ সময় হতাশায় তার ভ্রু কুঁচকে যায়। তিনি বলেন, এটা আমাকে ভেতর থেকে কুঁচকে দেয়।

মাহফুজা তার বড় মেয়ের ছেলে লাভলুকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু মাছ ধরা দিয়ে তাদের দুজনের ভরণপোষণ সম্ভব হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে তাকে ১০ বছর বয়সে লাভলুকে কাজে পাঠাতে হয়। এখন ১৫ বছরের লাভলু একটি কারখানায় মাটি বহন করে ইট তৈরি করে। তার ভবিষ্যৎ নিয়ে মাহফুজা দুশ্চিন্তায় আছেন। তিনি বলেন, আমার নাতি এখন আমার একমাত্র পরিবার, আমার সবকিছু সে।

মাহফুজার দিন শুরু হয় ভোর ৫টায়। তিনি ফজরের নামাজ পড়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়েন। নাশতা করার তেমন সময় পান না। শুধু এক কাপ চা। আর ভাগ্য ভালো থাকলে কিছু অবশিষ্ট মাছ খেতে পারেন। সাধারণত সূর্য ওঠার আগেই তিনি নদীতে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।

দিনের শেষে নদীর বালি আর রাস্তার ধুলোতে তার চুল মলিন হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে তিনি কাছের পুকুরে গোসল করেন। কখনো একটু সাঁতারও কাটেন। মাসে গড়ে তিনি প্রায় পাঁচ কেজি মাছ ধরেন। এর মধ্যে এক কেজি তিনি নিজে ও নাতি লাভলুর জন্য রেখে দেন। বাকি চার কেজি বিক্রি করে আয় হয় প্রায় ১০ হাজার টাকা। এই সামান্য আয়ে তাদের দু’জনের দিন চলে।

কিছু মাছ—যেমন সার্ডিন আর মোলা কার্পলেট—সারা বছর পাওয়া যায়। তবে তার মাছ ধরার কাজ ঋতুভেদে বদলে যায়। গরমকালে তিনি চিংড়ি আর ইলিশ ধরেন। শীতকালে ধরেন বড় মাছ আর কাঁকড়া। তিনি বলেন, সবকিছুই ঋতুর উপর নির্ভর করে। পানির সাথে তাল মেলাতে না পারলে পিছিয়ে পড়তে হয়।’

ভালো দিনে তিনি কয়েক শ’ টাকা আয় করেন। তা দিয়ে কোনোমতে খরচ চলে। এর মধ্যেই নৌকা ভাড়ার বোঝাও সামলাতে হয়। তবে এই কাজে স্থায়ী ভরসা নেই। কোনো দিন ভালো যায়। কিছু দিন একেবারে ফাঁকা।

ঋতু আরো অনেক চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। মাছ প্রজননের সময় সরকার পাঁচ মাস মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে, যাতে অতিরিক্ত আহরণ না হয়। এ সময় মাহফুজা ও লাভলুকে চাল কিংবা টাকা ধার করে চলতে হয়, অনেক সময় না খেয়ে থাকতে হয়। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, সরকার যদি মাছ বাঁচাতে চায়, তবে আমাদেরও তো বাঁচাতে হবে।

মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বর্ষাকালে ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকি বেড়ে যায়। মাহফুজা অভিজ্ঞ চোখে বাতাস, আকাশের রঙ আর ঢেউ দেখে বুঝে নেন যে ঝড় আসছে কিনা। তিনি বলেন, ‘যখন আকাশ অন্ধকার হয়ে যায়, বাতাস বদলে যায়, তখনই বুঝি তীরে ফিরে যেতে হবে। তবে কখনো কখনো আবহাওয়া এত দ্রুত বদলায় যে বুঝে ওঠার আগেই দেরি হয়ে যায়। তিনি আরো বলেন যে পরিস্থিতি চোখে দেখার আগেই বাতাসে টের পাওয়া যায়। কিন্তু কখনো এমন সময় আসে, যখন হঠাৎ সব বদলে যায়, আর তখন বুঝি, আগেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।

ঝড়ের কবলে পড়লে তার কিছুই করার থাকে না—নৌকার ভেতর বসে অপেক্ষা করা আর ঢেউয়ের সাথে যুদ্ধ করা ছাড়া।

২০০৯ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আইলাসহ অনেক ঝড়ের সম্মুখীন হয়েছেন মাহফুজা। যেখানে শতাধিক মানুষ মারা গিয়েছিল এবং প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছিল।

অনেক সময় আবহাওয়া অনুকূলে না থাকলেও মাছ ধরা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না তার কাছে। তিনি বলেন, সমুদ্র তোমার প্রস্তুতির জন্য অপেক্ষা করে না। বাঁচতে হলে মাছ ধরতেই হবে। ঘূর্ণিঝড় থাকুক আর না থাকুক।’

দূরবর্তী নদীপথে জলদস্যুরাও একটি বড় হুমকি। বিশেষ করে একা জেলেদের জন্য। তারা প্রায়ই টাকা বা মাছ ছিনিয়ে নেয়। প্রতিদিন না হলেও তাদের উপস্থিতি গ্রামবাসীদের আতঙ্কে রাখে। কখনো কখনো তারা মুক্তিপণের জন্য জেলেদের অপহরণ করে। তারা ভাবে আমাদের কাছে অনেক টাকা আছে। কী হাস্যকর!

সাত বছর আগে মাহফুজা ও তার বড় ভাই আলমগীর নদীতে মাছ ধরছিলেন। তখন হঠাৎ এক নৌকায় পাঁচজন মুখ খোলা বন্দুকধারী এসে ঘিরে ধরে। তারা ১২ হাজার টাকা দাবি করে। টাকা না পেয়ে, তারা ভাইবোনকে জোর করে আরেকটি নৌকায় তুলে নিয়ে যায়। তারা ভয়ংকর। টাকা না দিলে অপহরণ করে। কখনো কখনো মেরে ফেলে। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। কয়েক ঘণ্টা তাদের আটকে রাখা হয়। এরপর একটি উপকূলরক্ষী জাহাজ আসায় ডাকাতরা আতঙ্কে তাদের অগভীর জলে ফেলে পালিয়ে যায়।

আজও নদীতে হঠাৎ কোনো শব্দ শুনলে মাহফুজা ভয়ে কেঁপে ওঠে। তবুও ত্রিশ বছর বয়স থেকে সন্তানদের একমাত্র ভরণপোষণকারী হিসেবে মাছ ধরা ছাড়া তার কাছে আর কোনো পথ ছিল না। যখন আমার বাচ্চারা না খেয়ে কাঁদত, তখন আমি জলদস্যুর কথা ভাবতাম না।

আজ সে সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতাগুলো নিয়েও মাঝেমাঝে ঠাট্টা করে। কিন্তু তার হাসি টেকে না। এখনো সে তার আয় লুকিয়ে রাখে। আর সন্ধ্যা নামার আগেই নিরাপদে তীরে ফিরে আসার চেষ্টা করে।

গত ৪৪ বছর ধরে সে বাঘ, কুমির, ঘূর্ণিঝড়, জলদস্যু সবকিছুর সাথে লড়াই করে তার পরিবারকে বাঁচিয়ে রেখেছে। তিনি বলেন, ‘আমার কোনো পুরুষের দরকার নেই। আমি নিজেই নৌকা চালাই, আমি একা বনে যাই, মাছ ধরি, কাঠ কাটি। আমার নিজের শক্তিই যথেষ্ট।

দুপুরের দিকে মাছ ধরে ফেরেন মাহফুজা। তীরে অপেক্ষায় ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও প্রতিবেশী নুর নাহার। সঙ্গে আরো কয়েকজন জেলে নারী। ষাটোর্ধ নুর প্রায়ই তার ভাগ্নেদের নিয়ে নদীতে নামেন। প্রতিদিনের সংগ্রাম, ঝুঁকি আর অজানা আশঙ্কার মধ্যেও মাহফুজা খুঁজে পেয়েছেন এক ধরনের আশ্রয়—নিজ গ্রামের জেলে নারীদের বন্ধুত্বে।

মাহফুজা বলেন, ‘আমরা একে অপরের খেয়াল রাখি। যদি আমি বড় মাছ ধরি, ওকে একটা অংশ দিই। আর ওর জালে বেশি এলে আমিও পাই আমার ভাগ।’

নূর বলেন, ‘মাহফুজা আমার বান্ধবী। আমি যদি মাছ না পাই, তবু ও আমার সাথে ভাগ করে খায়। যদিও ও নিজেও গরিব।’ আর যখন নদী খালি হাতে ফেরায়, নূর সান্ত্বনা দেন- চিন্তা করো না, কাল আবার নামব নদীতে।

এই জেলে নারীদের নির্ভরতা কেবল নিজেদের উপর। ঝড়-তুফানে কেউ বিপদে পড়লে অপরজন সতর্ক করে দেন। জলদস্যুদের উপস্থিতি নিয়ে ধীর স্বরে ফিসফিস করে কথা বলেন। কারণ, এটি এমন একটি গ্রামে, যেখানে প্রায় সবাই জীবিকার তাগিদে নৌকায় ওঠে, জলদস্যুরা প্রায়ই পরিচিত মুখ। কারও নৌকা ভেঙে গেলে, অন্যরা এগিয়ে এসে সাহায্য করেন। সরকারি নিষেধাজ্ঞার সময়, যার যা আছে তা ভাগ করে নেন—যেন কেউ অভুক্ত না থাকে।

তারা নিজেদের জন্য এক পরিবারের মতো। যেখানে প্রত্যেকে জানেন, বাইরের জগৎ থেকে ভরসা পাওয়ার আশা নেই। সুতরাং তারা নিজেদের শক্তি নিজেরাই।

নূর স্মরণ করেন সেই ভয়াবহ বছরটার কথা যখন একে একে হারিয়েছেন স্বামীকে, হারিয়েছেন বোনকে। স্বামী হৃদরোগে মারা গিয়েছিলেন, আর বোন বাঘের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন। নূর বলেন, তখন মনে হয়েছিল, আর পারব না। কিন্তু এই মহিলারাই আমাকে টেনে তুলেছিল। যখন হাঁটতেও পারিনি, তারা আমায় বয়ে নিয়ে গেছে।’

মাহফুজা বলেন, ‘তোমার পিঠে জলের ওজন কেমন লাগে, কেউ বোঝে না। কিন্তু আমরা বুঝি। কারণ আমরা সেটা একসাথে বহন করি। আমরা লড়াই করি, হাসি, আর মাছ ধরি। এটাই আমাদের জীবন। ঠিক এভাবেই আমরা বাঁচি।’

সূত্র : আল জাজিরা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top