(পূর্বপ্রকাশিতের পর থেকে)
মোটকথা, একদিকে জাতীয় শিক্ষানীতি থেকে ধর্মীয় শিক্ষাকে আলাদাকরণ এবং সেক্যুলারিজমকে সুগভীরভাবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস, অপরদিকে কুরআন-সুন্নাহবিরোধী আইন প্রণয়ন এবং সংবিধান থেকে আল্লাহ তায়ালার প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস তুলে নেয়ার ষড়যন্ত্র, সবমিলিয়ে বাংলাদেশের মুসলিম উম্মাহ একটি গভীর ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছিল। এ সময় ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় চারিদিকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল অধার্মিকতার প্রভাব। বাতাসের গতিতে ছড়িয়ে পড়ছিল নাস্তিকতার বিষবাষ্প। গুটিকতেক নাস্তিকের আস্ফালনে আঁতকে উঠছিল সাধারণ সচেতন ধার্মিক নাগরিক সমাজ। সবাই এর বিহিত খুঁজতে তৎপর হয়ে ওঠে। উলামায়ে কেরাম স্থানীয় পর্যায়ে এর প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নানা কর্মসূচি পালন করতে থাকে। কিন্তু তাতেও প্রতিকূল আবহাওয়ার পরিবর্তনের কোনো আভাস নেই। নাস্তিকদের উন্নাসিক আস্ফালনের সামনে এসব প্রতিবাদ যেন খড়কুটোর মতেই ভেসে যাচ্ছিল। সরকারের জোরালো সমর্থন থাকায় ইসলামপন্থীদের থোড়াই কেয়ার করা হচ্ছিল। ফলে সবার মনেই ঐক্যবদ্ধ কোনো পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছিল। ইথারে পাথারে ভেসে বেড়াচ্ছিল দল-মত নির্বিশেষে সবার সমন্বয়ে একটি অরাজনৈতিক প্লাটফর্ম গড়ার চাপা আওয়াজ। সময় চাইছিল শ্রদ্ধাভাজন কোনো মুরুব্বির অধীনে সম্মিলিত প্রয়াস।
এহেন প্রেক্ষাপটে ২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি হাটহাজারি মাদরাসায় আয়োজন করা হয় এক বৈঠকের। সেখানে চট্টগ্রামের বড় বড় মাদরাসার সকল মুহতামিমকে দাওয়াত দেয়া হয়। বৈঠকে আলোচনা করা হয় ধেয়ে আসা অধার্মিকতার মহাপ্রলয় নিয়ে। জানতে চাওয়া হয় সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় ও প্রতিবাদের রূপরেখা নিয়ে। কিন্তু সেদিন কার্যকর কোনো সিদ্ধান্তই নেয়া সম্ভব হয় না। ফলে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়ে যায় সেদিনের মজলিস।
তবে আলোচনা ও চিন্তা-ভাবনা থেমে থাকেনি। নির্ভার হয়ে যায়নি আল্লামা আহমদ শফির হাটহাজারি। আবারো দুদিন পর ১৯ জানুয়ারি সবাইকে ডাকা হলো। সেখানে আল্লামা শফি প্রস্তাব করলেন লালদিঘি ময়দানে মহাসমাবেশ করার। তিনি বললেন, সেখান থেকে সরকারকে বড় ধরনের বার্তা দেবেন। অধার্মিকতার স্রোত ঠেকাতে প্রতিবাদ জানাবেন। তখন মাওলানা আব্দুল হালিম বুখারি রহ. জিজ্ঞেস করলেন, সমাবেশ কী ব্যানারে করা হবে। সেখান থেকে জায়গা করে নেয় নতুন প্লাটফর্মের ধারণা। সবাই একটি নিরেট অরাজনৈতিক সংগঠন গড়ার পক্ষে মতামত দেন। পরে ওই সংগঠনের ব্যানারেই প্রতিবাদ সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ঠিক করা হয়, ২৪ ফেব্রুয়ারি নতুন ব্যানারে লালদিঘির ময়দানে সমাবেশ করা হবে।
হেফাজতের নাম নির্বাচন প্রক্রিয়া
হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বলেন, ‘সংগঠনের নাম হিসেবে প্রথমে পুরাতন ইসলামি সংগঠনের নামগুলো প্রস্তাবে উঠে আসে। তার মধ্যে অন্যতম ছিল ‘ইসলামি আইন কমিটি’। কিন্তু প্রস্তাব প্রস্তাবই থেকে যায়। সবাই তখন একমত হয়, নতুন নাম হলেই ভালো হয়। তাহলে পুরাতন সংগঠনের নেতিবাচক প্রভাবগুলো থাকবে না। নিখুঁত নতুন একটি নাম হলে উদ্যম এবং উদ্দেশ্যেও দৃঢ়তা এবং দৃপ্ততা পাওয়া যাবে। মাওলানা আবদুল হালিম বুখারি সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেন, ‘সংগঠনের নাম হোক হেফাজতুল ইসলাম।’ মাওলানা সুলতান যওক নদভি বললেন, ‘হেফাজতুল ইসলাম নামটি আরবি। মানুষের উচ্চারণে সমস্যা হতে পারে। যদি নামটি ফার্সিতে ‘হেফাজতে ইসলাম’ বলা হয়, তাহলে সমস্যাটা থাকবে না।’
এভাবেই হেফাজতে ইসলাম নামটি গৃহীত হয়। সবাই তখন আল্লামা আহমদ শফি দা.বা.-এর কাছে আবেদন করলেন, ‘আপনি হবেন হেফাজতে ইসলামের আমির।’ তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘আমার বয়স পড়ে গেছে। গায়ে এত শক্তিও নেই এবং সংগঠন পরিচালনার তেমন অভিজ্ঞতাও নেই। মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী হোক আমির।’ মাওলানা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী রাজি হলেন না। তিনি বললেন, ‘হজরত, আপনিই আমির হবেন। আমি না হয় আপনার সহকারী হিসেবে থাকব।’ এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না মুফতি আবদুর রহমান রহ.। তাকে বৈঠক থেকে ফোন করে জানানো হল, ‘আল্লামা আহমদ শফির নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলাম নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন করা হয়েছে। সিনিয়র নায়েবে আমির হিসেবে আপনাকে রাখতে চাচ্ছি।’ তিনি বললেন, ‘আল্লামা আহমদ শফি সাহেব হুজুর যে কাজই করেন, আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে তার সঙ্গে কাজ করব।’ (সূত্র : ফাতেহ ২৪ ডটকম; প্রতিবেদন : হেফাজতে ইসলাম : সূচনা, বিকাশ ও বিভক্তি)
হেফাজতের প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটি
ওই বৈঠকেই প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। বৈঠকে আল্লামা আহমদ শফিকে আমির; মুফতি আবদুর রহমানকে সিনিয়র নায়েবে আমির এবং মাওলানা আবদুল হালিম বুখারী, আল্লামা জমিরুদ্দিন নানুপুরী, মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী, আল্লামা আবদুল মালেক হালিমকে নায়েবে আমির নিযুক্ত করা হয়। মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় মাওলানা সুলতান যওক নদভিকে। যুগ্ম মহাসচিব নিযুক্ত হলেন মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি।
হেফাজতের প্রথম সংবাদ সম্মেলন
নতুন কমিটি গঠিত হওয়ার পর লালদিঘির ময়দানে মহাসমাবেশ করার উদ্যোগ নেয়া হয়। এই কর্মসূচি ঘোষণা দেয়ার জন্য দায়িত্বশীলরা একটি সংবাদ সম্মেলন করে। সংবাদ সম্মেলনটি চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের একটি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে পাঁচটি দাবি পেশ করা হয়- জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০৯ ও সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করা, ৭২ এর ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা, ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র ও কওমি মাদরাসার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা বন্ধ করা। এই দাবিগুলো নবগঠিত হেফাজতের মহাসচিব আল্লামা সুলতান যওক নদভী লিখিত আকারে পেশ করেন। তবে তিনি অসুস্থ থাকায় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হতে পারেননি। পরে তার পক্ষ থেকে ওই লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী। এরপর সেখান থেকেই ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক লালদিঘি ময়দানে মহাসমাবেশের ঘোষণা দেয়া হয়।
এই সংবাদ সম্মেলনের পর স্থানীয় ও জাতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদটি প্রচারিত হয়। এতে হেফাজতের সমাবেশের খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় স্থানীয় পর্যায়ে হেফাজতকর্মীরা ব্যাপক প্রচার প্রচারণাও চালান। এর ধারাবাহিকতায় তারা সমাবেশের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্বলিত অনেক লিফলেটও প্রচার করে। এভাবে মহাসমাবেশের খবর সর্বত্র পৌঁছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে।
প্রথম ভাঙন ও প্রথম সমাবেশ
সংবাদ সম্মেলনের পর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে সমাবেশের খবর। এতে স্থানীয় উলামা-তলাবা ও সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। নানাজন নানাভাবে সমাবেশের খবর নিতে থাকে। প্রত্যেকে নিজ নিজ স্থান থেকে এর প্রচার-প্রচারণাও চালিয়ে যেতে থাকে। যেহেতু ঘোষণা দেয়ার পর সমাবেশ অল্প কদিনের ব্যবধানেই অনুষ্ঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাই সবার মাঝেই একটা সাঝ সাঝ রব কাজ করছিল। সবাই উদ্যমের সাথে সমাবেশের খবর প্রচার করতে লাগলো। এরই মধ্যে ঘটে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
সময়টা ছিল ২৩ জানুয়ারি। কয়েকটি পত্রিকায় লালখান বাজার মাদরাসার মুহতামিম মুফতি ইজহারুল হক একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি আওয়ামী সরকারের বিরোধিতা করে সরকারের সমালোচনা করেন। একইসাথে তিনি হেফাজতের প্রতিও সমর্থন ব্যক্ত করেন। তবে তিনি তখন পর্যন্ত আওয়ামী রাজনীতির সাথেই জড়িত ছিলেন। আওয়ামী দলীয় প্রতীককে তিনি নূহ আ. এর নৌকার সাথেও তুলনা করেছিলেন। তার এই অনাকাঙ্ক্ষিত বিবৃতিতে বিরক্ত হয়ে ওঠেন নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুল হালীম বুখারী ও মহাসচিব আল্লামা সুলতান যওক নদভী। তারা এ নিয়ে আল্লামা আহমদ শফি রহ. এর কাছে নিজেদের অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এরপর তারা আল্লামা শফি রহ. এর কাছে অনুরোধ করে বলেন, ‘মুফতি ইজহারের বিরুদ্ধে একটি বিবৃতি দিতে হবে। সেখানে বলা হবে যে আমরা তাকে আওয়ামী লীগ থেকে সরে আসতে বলিনি এবং হেফাজতেও তাকে নেইনি।’ কিন্তু তাদের এই দাবি মানতে রাজি হননি আল্লামা শফি। তিনি এর পেছনে যুক্তি দিয়ে বলেন, ‘একই তো মুফতি ইজহারের সাথে আমার কোনো তর্ক-বিতর্ক হয়নি। সে তার জায়গা থেকে বিবৃতি দিয়েছে। তদুপরি সে আমার ছাত্রতুল্য। তার বিরুদ্ধে এভাবে পত্রিকায় বিবৃতি দেয়াকে আমার কাছে সঙ্গত মনে হয় না।’ এরপর তিনি বলেন, ‘একান্ত যদি বিবৃতি দেয়া দরকারই মনে করেন, তবে আপনারাই বিবৃতি দিন। তিনি আপনাদের সমবয়সী। সেটাই ভালো হবে।’
মাওলানা মুঈনুদ্দিন রুহি বলেন, ‘মাওলানা আব্দুল হালিম বুখারী ও সুলতান যওক নদভি চাচ্ছিলেন যে আল্লামা শফি যেন বিবৃতিটি দেন। তারা এই বিষয়ে সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি আব্দুর রহমান রহ. এর সাথে ফোনে কথা বললে তিনিও বিবৃতি দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। কিন্তু আল্লামা শফি রহ. রাজি না হওয়ায় তারা মনে কষ্ট পান। সেই মনোকষ্ট থেকেই ২৩ ফেব্রুয়ারি তারা হেফাজত থেকে পদত্যাগ করেন।’
মাওলানা রুহি অভিযোগ করে বলেন, এরপর গোয়েন্দা সংস্থাসহ সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে পদত্যাকারী নেতারা জানিয়ে দেন যে তারা হেফাজতে ইসলাম থেকে পদত্যাগ করেছেন। আর ২৪ তারিখ হেফাজতে ইসলাম লালদিঘির ময়দানে যে সমাবেশ ঘোষণা করেছে, ‘তা মূলত জামায়াতে ইসলামির ইন্ধনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।’
সরকারি পর্যায়ে যখন জামায়াত সম্পৃক্ততার খবর পৌঁছায়, সরকার ওই দিনই ২৪ জানুয়ারির সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এহেন পরিস্থিতিতে ২৪ জানুয়ারি সকালে হাটহাজারিতে জরুরি বৈঠক আহ্বান করা হয়। বৈঠকে নতুন মহাসচিব হিসেবে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীকে দায়িত্ব দেয়া হয়। আর আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরীকে সিনিয়র নায়েবে আমির নিযুক্ত করা হয়। পরে সেখানে সিদ্ধান্ত হয় যে সরকারের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই লালদীঘির ময়দানে সমাবেশ করা হবে।
প্রায় ৭০টি প্রাইভেটকারে হাটহাজারি মাদরাসা থেকে সমাবেশের উদ্দেশ্যে বের হয় হেফাজতে ইসলামের কাফেলা। কিন্তু অক্সিজেন পার হয়ে বালুচরা নামক স্থানে পুলিশি বাঁধার সম্মুখীন হন তারা। পুলিশ আল্লামা আহমদ শফি সাহেবের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ সময় হেফাজতের ১৩ থেকে ১৪ নেতাকর্মী আহত ও রক্তাক্ত হয়। রক্তের নজরানা দিয়ে শুরু হয় হেফাজতে ইসলামের পথচলা। এই ঘটনার পরই পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে হেফাজতে ইসলামের নাম।
মাওলানা আশরাফ আলী নিজামপুরী বলেন, ‘হেফাজতে ইসলাম একদম শুরু থেকে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের উত্থান পর্যন্ত কেবল চট্টগ্রামভিত্তিক একটি সংগঠন ছিল। তা-ও বৃহত্তর চট্টগ্রামের নয়। তবে দেশের প্রতিটি ধর্মীয় ইস্যুতে সংগঠনটি কথা বলেছে। চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে প্রেস কনফারেন্স করেছে, মিছিল-মানববন্ধন করেছে। দৈনিক পূর্বকোনসহ চট্টগ্রামভিত্তিক বিভিন্ন পত্রিকায় হেফাজতের আমির হিসেবে আল্লামা আহমদ শফির বিবৃতি প্রকাশ হতো।’
প্রথম সমাবেশ নিয়ে সরকারের পরবর্তী প্রতিক্রিয়া
জামায়াত সম্পৃক্ততার অভিযোগে লালদীঘি ময়দানে সমাবেশ করতে দেয়নি সরকার। উল্টো আল্লামা আহমাদ শফি রহ. এর গাড়ি বহরে গুলি ও টিয়ারগ্যাস ছোড়ে সশস্ত্র বাহিনী। এতে হেফাজতের অন্তত ১৩ থেকে ১৪ নেতাকর্মী আহত হয়। এরপর অবস্থা অনুকূল না দেখে যখন সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত হয়, তখন আল্লামা শফির গাড়ি বহর হাটহাজারিতে ফিরে যায়। উপস্থিত তাওহিদি জনতাও পথ ধরে নিজ নিজ গন্তব্যের। তবে পথিমধ্যে তাদেরকে বিভিন্ন জায়গায় সরকারি বাহিনীর হাতে হেনস্থা হতে হয়। এর মধ্যে হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী ও মাওলানা মুসা বিন ইজহারকে গ্রেফতার করা হয়। অবশ্য তাদেরকে ঘণ্টা খানেক পর ছেড়ে দেয়া হয়। এছাড়া আরো ৬২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদেরকে ছাড়া হয় দু’দিন পর। এভাবে সরকার হেফাজতে ইসলামের প্রথম মহাসমাবেশ বানচাল করতে সফল হয়।
এই ঘটনাকে বিভিন্ন পত্রিকা কভার করে। এর মধ্যে দৈনিক নয়া দিগন্তের শিরোনাম ছিল, হাটহাজারী রণক্ষেত্র, হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ করতে বাধা : গাড়ি বহরে পুলিশের গুলিতে আহত অর্ধশতাধিক, গ্রেফতার ৪০, অনির্দিষ্টকালের জন্য সড়ক অবরোধ কর্মসূচি।
সমাবেশে বাধা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন
২৪ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি ময়দানে হেফাজতের সমাবেশ করতে না দেয়ায় ২৫ ফেব্রুয়ারি তারা সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। বেলা ৩টায় হাটহাজারি মাদরাসার একটি মিলনায়তনে ওই আয়োজন করা হয়। সেখানে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। পরে সংবাদ সম্মেলন থেকে সমাবেশে বাধাপ্রদান ও পুলিশি হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। এ সময় নেতৃবৃন্দ ঘটনার সাথে জড়িত বাহিনীকে বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তিরও দাবি জানান। একইসাথে ৭২ এর সংবিধান পুনর্বহাল করে দেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা, ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা বাদ দিয়ে নতুন ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা, সম্পত্তিতে নারীর সমাধিকার আইন চালু, ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং দেশের কওমি মাদরাসা, ওলামা-মাশায়েখ ও কওমি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতাসহ নানা অপপ্রচার বন্ধ করার দাবি জানানো হয়।
এ সময় হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয় যে সরকার যদি এসব দাবি বাস্তবায়ন না করে, তাহলে হেফাজতের পক্ষ থেকে ৩১ মার্চ ২০১০ চট্টগ্রামে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হবে। এছাড়া হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালকসহ নিরীহ শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সমাবেশে যোগদানকারীদের উপর বিনা উস্কানিতে হামলার প্রতিবাদে ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিটি থানায় প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
নতুন মহাসচিবের ঘোষণা
পরে ওই সংবাদ সম্মেলনেই হেফাজতে ইসলামের নির্বাহী মহাসচিব আল্লামা আব্দুল মালেক হালিমকে নতুন করে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে ঘোষণা করা হয়। (নয়া দিগন্ত, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১০)
মোটকথা, নারী নীতিমালার বিরুদ্ধে, সংবিধান থেকে আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস তুলে দেয়ার পঞ্চম সংশোধনী ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায়, নাস্তিক্যবাদী শিক্ষানীতি প্রণয়নের বিরুদ্ধে এবং কওমি মাদ্রাসা সমূহের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র ও জঙ্গীবাদের মিথ্যা অভিযোগের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকার মাধ্যমেই হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে।
হেফাজতের প্রথম কর্মসূচি
হেফাজত গঠিত হওয়ার পর প্রথমে লালদীঘি ময়দানে মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে সেটি করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে বিস্তারিত আগে গত হয়েছে। এরপর হেফাজত পহেলা এপ্রিল ধর্মহীন শিক্ষানীতি ও ফাতাওয়াবিরোধী রায় বাতিলের দাবিতে একটি সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করে। চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা মসজিদের উত্তর গেইটে অনুষ্ঠিত ওই সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন হেফাজতের আমির আল্লামা আহমদ শফি রহ.। এই ছিল হেফাজতের প্রথম কর্মসূচি। এর মধ্য সরকারকে তারা ধর্মহীন শিক্ষানীতি ২০০৯ কে বাতিলের দাবি জানায়। একইসাথে ফাতাওয়াবিরোধী রায় বাতিলের জন্যও চাপ দেয়। পরে ফাতাওয়াবিরোধী রায় স্থগিত করা হয়। বাকি শিক্ষানীতি সীমিত পরিসরে বাস্তবায়ন করা হয়। এ বিষয়ে সামনে বিস্তারিত আসবে। ইনশাআল্লাহ।
হেফাজতে ইসলাম কেন গঠন করতে হলো (১ম পর্ব)
হেফাজতে ইসলাম কেন গঠন করতে হলো (পর্ব-২)
হেফাজতে ইসলাম কেন গঠন করতে হলো (পর্ব-৩)