২০২৪ সালের ১৯ মার্চ। ফ্রান্সের প্যারিসে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেন ইসরাইলের অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ। পেছনে টাঙানো ছিল একটি বিতর্কিত মানচিত্র। সেখানে ফিলিস্তিন ও জর্ডান মিলিয়ে একটিই রাষ্ট্র-ইসরাইল-হিসেবে দেখানো হয়েছিল। মানচিত্রটি ছিল একটি ইহুদিবাদী সংগঠনের লোগো। এতে প্রতিফলিত হয়েছিল বৃহত্তর ইসরাইলের স্বপ্ন। এটি একটি সম্প্রসারণবাদী মতবাদ, যার দাবি- সমুদ্র থেকে নদী পর্যন্ত সব ভূখণ্ড, এমনকি জর্ডান নদীর পূর্ব তীরও ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত।
এই ঘটনাটিই নতুন অর্থ পায় ২০২৪ সালের ১৫ আগস্টে। সেদিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক মন্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করেন, ‘ইসরাইল কি আর জমি নিতে পারে না?’ এ ধরনের মন্তব্য এক ঔপনিবেশিক প্রবণতারই বহিঃপ্রকাশ। এটি ইহুদি সম্প্রসারণবাদের অন্তর্গত, যেখানে পূর্ব জর্ডান দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ্যবস্তু।
ঔপনিবেশিক ধারণার সূচনা : লিঞ্চ থেকে অলিফ্যান্ট
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তি ও জায়নিস্টরা পূর্ব জর্ডানকে বাইবেলের ফিলিস্তিনের সম্প্রসারিত অংশ হিসেবে কল্পনা করে আসছে।
১৮৪৮ সালে মার্কিন সরকার একটি নৌ-অভিযান পাঠায়। নেতৃত্বে ছিলেন উইলিয়াম ফ্রান্সিস লিঞ্চ। বাহ্যত এটি ছিল বৈজ্ঞানিক মিশন। কিন্তু গোপনে যাচাই করা হচ্ছিল যে পূর্ব জর্ডানে ইহুদি বসতি স্থাপন সম্ভব কিনা। লিঞ্চ প্রস্তাব দেন, স্থানীয়দের সরিয়ে সেখানে ‘মানব সংরক্ষণের’ প্রকল্প নেয়া যেতে পারে।
লিঞ্চ তাঁর প্রতিবেদনে আরবদের তুলনা করেন রেড ইন্ডিয়ানদের সাথে। ইউরোপীয় সভ্যতার সামনে তারা ‘বর্বর’। তার মতে, এই জনগোষ্ঠী প্রতিস্থাপনযোগ্য। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে অটোমান সাম্রাজ্য পতনের পর ইহুদিদের ফিরে আসা শুরু হবে এবং মার্কিন পতাকা এই অঞ্চলে উড়বে।
১৮৭০-এর দশকে ইয়েহোশুয়া ইয়েলিন জেরুজালেমে বসতি স্থাপন করেন। পরে তিনি পূর্ব জর্ডানে ইহুদি সম্প্রসারণের ডাক দেন। ১৮৭১ সালে ইহুদি ব্যবসায়ীদের সহায়তায় একটি কোম্পানি গঠন করেন। দাবি করেন যে ঘোর আল-নিমরিন অঞ্চলে জমি চাষের জন্য আরব গোত্রের শায়খদের সাথে চুক্তি হয়েছে।
ব্রিটিশ প্রকৌশলী চার্লস ওয়ারেন আরো এক ধাপ এগিয়ে যান। তিনি প্রস্তাব দেন যে একটি সেটেলমেন্ট কোম্পানি গঠন করা হোক। এটি অটোমানদের থেকে জমি লিজ নেবে এবং ঋণ শোধে সাহায্য করবে। প্রকল্পটির পেছনে ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও জায়নিস্ট উচ্চাকাঙ্ক্ষার মিশ্রণ।
এই ধারার সবচেয়ে প্রভাবশালী নাম লরেন্স অলিফ্যান্ট। তার বই The Land of Gilead প্রকাশিত হয় ১৮৮৯ সালে। তাতে পূর্ব জর্ডানে ইহুদি বসতির সম্ভাবনা ব্যাখ্যা করা হয়। ১৮৮০ সালে লেবানন, সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও পূর্ব জর্ডান সফর করেন অলিফ্যান্ট। তিনি লেখেন, অঞ্চলটি উর্বর, কৃষির সম্ভাবনা প্রবল, প্রাকৃতিক সম্পদও প্রচুর। যাযাবর আরবদের তিনি ‘ভূমির ওপর কোনো আইনি অধিকার নেই’ বলে অভিহিত করেন। তাদের বিবেচনা করেন ধ্বংস ও বিশৃঙ্খলার বাহক। সমাধান হিসেবে তিনি বলেন, তাদের মরুভূমিতে ফেরত পাঠানো হোক।
অলিফ্যান্ট যে এলাকা বসতির জন্য নির্ধারণ করেন, তা বিশাল। দক্ষিণে ওয়াদি মুজিব, উত্তরে জারকা নদী, পূর্বে দারব আল-হাজ আর পশ্চিমে জর্ডান নদী ও মৃত সাগর—মোট প্রায় দেড় মিলিয়ন হেক্টর।
মিদিয়ান ভূমি প্রকল্প
লরেন্স অলিফ্যান্টের ছায়া পড়ে পল ফ্রিডম্যানের উপরেও। জার্মান বংশোদ্ভূত এই ধনী ইহুদি ১৮৯০-এর দশকে মিদিয়ান অঞ্চলে বসতি স্থাপনের উদ্যোগ নেন।
১৮৯১ সালে তিনি প্রকাশ করেন একটি ১৮ পৃষ্ঠার পুস্তিকা, The Land of Midian। তাতে তুলে ধরেন আকাবা অঞ্চলের ভৌগোলিক, অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যাগত বৈশিষ্ট্য। দাবি করেন, সেখানকার মানুষ বেনেই সাব্বাত নামে এক ইহুদি বংশের উত্তরসূরী। মিদিয়ান একসময় ছিল প্রাচীন ইহুদি সত্তার অংশ।
ফ্রিডম্যান এই প্রকল্পের জন্য পশ্চিমা ইহুদি নেতাদের রাজনৈতিক ও আর্থিক সহায়তা চেয়েছিলেন। তার উদ্যোগ কল্পনার ফসল ছিল না। বরং একটি সুপরিকল্পিত ঔপনিবেশিক প্রকল্প।
সামরিক অভিযান ও বসতি পরিকল্পনা
ফ্রিডম্যান একই বছর একটি অভিযান চালান। সাথে ছিলেন ৩০টি ইহুদি পরিবার ও ৫০ জন প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক। তাদের অনেকে ছিলেন বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও ভূগোলবিদ। প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন জার্মান ও অস্ট্রিয়ান সামরিক অফিসাররা।
একটি বাণিজ্যিক জাহাজে করে তারা অস্ত্রসহ সাউদাম্পটন থেকে যাত্রা করেন। মিসরের কিছু আরবিভাষী ইহুদিও অভিযানে যোগ দেন। আল-তুরে পৌঁছে তারা শিবির স্থাপন করেন এবং জমি কিনে বসতি গড়ার চেষ্টা করেন। প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়ে। ফ্রিডম্যান ক্ষতিগ্রস্ত হন ১ লাখ ৭০ হাজার মার্ক। এরপরও তিনি ক্ষতিপূরণ দাবি করে মামলা করেন এবং প্রকল্পটি পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা চালান।
রথসচাইল্ড ও মোহিলবারের প্রচেষ্টা
একই সময়ে ব্যারন রথসচাইল্ডের পক্ষ থেকে এলিয়াহু শেড পূর্ব জর্ডানে হাজারো বসতির জন্য জমি কেনেন। অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য রেলপথ ও খালের পরিকল্পনা করেন।
রাব্বি শমুয়েল মোহিলবারও পূর্ব জর্ডানে জরিপ চালান। তিনি বলেন, গ্যালিলির তুলনায় এখানেই বসতি স্থাপন সহজ, যদি বেদুইনদের হুমকি মোকাবিলায় শতাধিক পরিবার প্রস্তুত থাকে।
পূর্ব জর্ডানের প্রতি রুশ আগ্রহ
মিনস্কের নেতা ইয়েহোশুয়া সিরকিন পূর্ব জর্ডানকে উর্বর ও সস্তা জমির ভান্ডার বলে মন্তব্য করেন। তিনি আহ্বান জানান, সেখানে হাজারো ইহুদি পরিবার বসতি গড়ুক। ভিলনিয়াস ও বাকু থেকেও আগ্রহী প্রতিনিধিরা জমি ক্রয়ের অনুসন্ধান শুরু করেন।
ব্যর্থতার পরও চলমান চেষ্টা
১৮৯৩ সালে হেনরি ডি আভিগডোর হাউরানে বসতি স্থাপনের চেষ্টা করেন। কিন্তু অটোমান সরকারের বাধায় ব্যর্থ হন। পরে স্যামুয়েল মন্টাগুসহ সুলতান আব্দুল হামিদের কাছে পূর্ব জর্ডানে বসতির অনুমতি চান।
ড. বোহেনডর্ফ প্রস্তাব দেন যে ইহুদিদের একত্র করে বেদুইনদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা হোক। তিনি পূর্ব জর্ডানকে ভাবেন ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের ঘাঁটি হিসেবে।
১৯০৯ সালে সুলতান আবদুল হামিদের জমি সরকারি কোষাগারে স্থানান্তরিত হয়। নাজিব আল-আসফার জমি ইজারা চেয়েছিলেন ১০ কোটি ফ্রাঁ ঋণের বিনিময়ে। পরে জানা যায়, প্রকৃত ভাড়াটে ছিল একটি বেলজিয়ান কোম্পানি, যার পেছনে জায়নিস্ট পরিকল্পনা কাজ করছিল। ফিলিস্তিনি সংবাদপত্র ‘আল-কারমেল’ এ ষড়যন্ত্র ফাঁস করে।
রুটেনবার্গের পরিকল্পনা : নির্বাসনের ছদ্মবেশ
১৯৩৬ সালে পিনচাস রুটেনবার্গ পরিকল্পনা করেন যে জারকা নদীর উপত্যকায় ইহুদি বসতি স্থাপন। পরিকল্পনা ছিল, দক্ষিণ তীর থাকবে আরব কৃষকদের, উত্তর তীরে গড়ে উঠবে ইহুদি বসতি। দুই মিলিয়ন ফিলিস্তিনি পাউন্ডে গঠিত হবে একটি কোম্পানি। উদ্দেশ্য ফিলিস্তিনিদের সেখানে পুনর্বাসন এবং বসতির অর্থায়ন।
যদিও পূর্ব জর্ডান ছিল বালফোর ঘোষণার আওতার বাইরে, তবু এই পরিকল্পনায় জায়নিস্ট উচ্চাকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট।
এসব পরিকল্পনা একের পর এক ব্যর্থ হলেও স্বপ্ন থেমে থাকেনি। পূর্ব জর্ডানে ইহুদি সম্প্রসারণবাদী আগ্রহ বরং গোপনে বেড়েছে। সুযোগ পেলেই ওই আগ্রহ প্রকাশ পায়। স্মোট্রিচের মানচিত্র ও ট্রাম্পের মন্তব্য সেই ধারারই আধুনিক ছায়া। আজও জর্ডান ও তার সীমান্ত ঝড়ের মুখে।
এই লেখায় প্রকাশিত দৃষ্টিভঙ্গি লেখকের নিজস্ব। টুডেনিউজের সম্পাদকীয় নীতির সাথে মিল থাকা জরুরি নয়।
সূত্র : আল জাজিরা