রাশিয়ার প্রতি এতো সদয় কেন ট্রাম্প

আহমাদ হাফেজ

আল-জায়তুনা সেন্টার ফর স্টাডিজ অ্যান্ড কনসালটেশনস কর্তৃক প্রকাশিত গবেষণাপত্রে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অনুমান উপস্থাপিত হয়েছে, যা রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির পরিবর্তনের স্বরূপ উন্মোচন করে, বিশেষত রাশিয়ার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে।

ঐতিহাসিকভাবে, মার্কিন-রাশিয়ান সম্পর্ক ছিল এক প্রকার ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিযোগিতা, যেখানে কখনো সংলাপের মাধ্যমে, কখনো কঠোর নীতির দ্বারা পারস্পরিক চাপ প্রয়োগ করা হতো। কিন্তু ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের পর এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার তীব্রতা দৃশ্যত হ্রাস পেতে থাকে, এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয়।

“ট্রাম্প এবং রাশিয়ান-আমেরিকান সম্পর্কের রূপান্তরের সমস্যা” শীর্ষক গবেষণাপত্রটি ট্রাম্প প্রশাসনের রাশিয়ান নীতির বিশ্লেষণ করে, যা পশ্চিমা জোটের অভ্যন্তরে বিভাজন সৃষ্টি করেছে। এটি ন্যাটোর সংহতি ও কৌশলগত দিকনির্দেশনা সম্পর্কেও শঙ্কা প্রকাশ করে।

ফেব্রুয়ারির শেষ প্রান্তে, ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত মার্কিন-ইউক্রেনীয় শীর্ষ সম্মেলনে ট্রাম্প প্রকাশ্যে ইউক্রেন এবং এর রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কির নীতির কঠোর সমালোচনা করেন। বৈঠকের পর তিনি কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন করে সংবাদ সম্মেলন বাতিল করেন এবং ইউক্রেনের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ আনেন।

গবেষণাপত্রের লেখক ড. ওয়ালিদ আবদেল-হে তিনটি মৌলিক অনুমান উপস্থাপন করেছেন:

১. বিশ্বায়নের বোঝা এড়াতে ওয়েস্টফালিয়ান মডেলে প্রত্যাবর্তন

এই অনুমান অনুসারে, ট্রাম্প “পুরাতন রক্ষণশীল” মতাদর্শের ধারক, যা জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সুরক্ষাবাদী অর্থনীতির সংমিশ্রণে গঠিত। বহুপাক্ষিক চুক্তি ও বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি তার অবিশ্বাস ছিল প্রকট। উদাহরণস্বরূপ:

– মার্কিন অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এমন যেকোনো আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা এড়ানোর কৌশল গ্রহণ।
– আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও প্যারিস জলবায়ু চুক্তির প্রতি তার বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি।
– বহুপাক্ষিক বাণিজ্য কাঠামোর বিরোধিতা এবং শুল্কনীতির কঠোর প্রয়োগ।
– “আমেরিকা ফার্স্ট” এবং “আমেরিকাকে আবার মহান করার” স্লোগানকে ভিত্তি করে পরিচালিত পররাষ্ট্রনীতি।
– রাশিয়ার প্রতি নমনীয় মনোভাব গ্রহণের মাধ্যমে ইউরোপীয় জোটকে দুর্বল করার চেষ্টা।

এই অনুমান অনুসারে, ট্রাম্প রাশিয়ার সাথে বড় সামরিক সংঘাত এড়িয়ে চলতে চেয়েছেন এবং ইউক্রেন সংকটে রাশিয়াকে সরাসরি দোষারোপ না করে ইউক্রেনীয় নেতৃত্বের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।

২. ষড়যন্ত্র তত্ত্ব

এই অনুমান অনুসারে, ট্রাম্প এবং রাশিয়ান নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর মধ্যে গোপন আঁতাত রয়েছে। একাধিক গবেষণা ও প্রতিবেদনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, ট্রাম্প দীর্ঘদিন রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থার নজরে ছিলেন এবং রাশিয়ান মাফিয়ার সঙ্গে তার আর্থিক লেনদেন ছিল।

গবেষণাপত্রে ট্রাম্পের কিছু ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের দিকেও আলোকপাত করা হয়েছে:
– আত্মকেন্দ্রিকতা, সন্দেহপ্রবণতা, সত্যকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা এবং নীতির প্রতি অবজ্ঞা।
– রাশিয়ার সঙ্গে তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির প্রচেষ্টা।
– তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অসংখ্য আইনি মামলা, যা তাকে মার্কিন ইতিহাসের একমাত্র প্রেসিডেন্ট বানিয়েছে, যিনি দুবার অভিশংসিত হয়েছেন এবং যার নির্বাচনী প্রচারণায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপ ছিল।

অন্যান্য পর্যবেক্ষণ:
– আর্থিক সংকটের সময় রাশিয়ান প্রতিষ্ঠানসমূহ ট্রাম্পকে সহায়তা প্রদান করেছে।
– রাশিয়ান মাফিয়া ট্রাম্পের প্রকল্পগুলিকে অর্থ পাচারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছে।
– রাশিয়ান মাফিয়ার শীর্ষ নেতাদের অনেকেই পুতিনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন।

৩. চীনকে দুর্বল করার কৌশল

ট্রাম্প প্রশাসনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল চীনকে দুর্বল করা, এবং এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চীনবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। গবেষণাপত্র অনুসারে:
– মার্কিন সেনা সরিয়ে এনে রাশিয়ার উপর চাপ কমিয়ে চীনের প্রতি মনোযোগ বৃদ্ধি করা।
– রাশিয়া-চীন কৌশলগত সম্পর্ক দুর্বল করার প্রচেষ্টা।
– ওয়াশিংটনের উপযুক্ত কূটনৈতিক প্রণোদনার মাধ্যমে মস্কোকে বেইজিং থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা।

তবে, এই কৌশল বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন, যা ট্রাম্পের চার বছরের শাসনামলের তুলনায় অপ্রতুল। ব্রিকস ও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও) রাশিয়া-চীনের সম্পর্ককে দৃঢ় করেছে, যা এই কৌশল বাস্তবায়নে বড় বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

গবেষণাপত্রের বিশ্লেষণ অনুসারে, চীনকে দুর্বল করার অনুমানটি তুলনামূলকভাবে দুর্বল, যেখানে প্রথম দুটি অনুমান যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য বলে প্রতীয়মান হয়।

প্রথম অনুমান ট্রাম্পের জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির শক্তিশালী উপস্থিতি নির্দেশ করে, যা আমেরিকার একটি বড় অংশের বিশ্বায়নবিরোধী মনোভাবের প্রতিফলন।

দ্বিতীয় অনুমানে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না, কারণ এটি বিভিন্ন গবেষণা ও তথ্যের মাধ্যমে সমর্থিত এবং একাধিক সরকারি ও একাডেমিক সংস্থা এটিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছে।

এই তিনটি অনুমানের মধ্যে একটি মিল রয়েছে— ট্রাম্পের ব্যক্তিত্বের অনির্দেশ্য প্রকৃতি। গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, তার সিদ্ধান্ত ও কৌশল পূর্বাভাস করা কঠিন, যা তার প্রশাসন, মার্কিন সমাজ এবং বৈশ্বিক রাজনীতির জন্য নানাবিধ চমকের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে।

সূত্র : আল জাজিরা নেট

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top