নিষেধাজ্ঞা, বয়কট, রাশিয়া, পশ্চিমা বয়কট, পশ্চিমা ব্র্যান্ড, ইউক্রেন যুদ্ধ,

রাশিয়া কিভাবে পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে উঠছে

ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর রাশিয়ার ওপর যখন একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ হতে থাকে, বহু পশ্চিমা কোম্পানি দেশটি থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়। অ্যাপল, কোকা-কোলা, মার্সিডিজ, লেগো, রোলেক্সসহ শত শত বহুজাতিক ব্র্যান্ড রাশিয়ার বাজার ছাড়ার ঘোষণা দেয়। তবে বাস্তবতা ভিন্ন। যুদ্ধ শুরুর দুই বছরের মাথায়ও রাশিয়ার বাজারে এসব কোম্পানির পণ্যের সহজলভ্যতা বহাল রয়েছে।

আল জাজিরার মাসব্যাপী অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, সমান্তরাল আমদানির আইনি কাঠামোকে কাজে লাগিয়ে এবং তৃতীয় দেশের মধ্যস্থতায় রাশিয়া নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহ করছে।

ঘরে বসেই আমেরিকান ঘড়ি

২০২৩ সালের আগস্টে মস্কোর বাসিন্দা ৬২ বছর বয়সী জোয়া ইতালি সফরের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল মেয়ের সাথে দেখা এবং বহু কাঙ্ক্ষিত অ্যাপল ওয়াচ কেনা। কারণ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে আগ্রাসনের পর অ্যাপল রাশিয়ায় পণ্য বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছিল।

তবে সফরের এক সপ্তাহ আগে ইয়ানডেক্স ডট মার্কেট ঘাঁটতে গিয়ে তিনি দেখতে পান যে রাশিয়ায়ই অ্যাপল ওয়াচ পাওয়া যাচ্ছে, তাও সাশ্রয়ী দামে। ইতালির চেয়েও কম। তাই অনলাইনে অর্ডার করেন।

পণ্যটি ঘরে এসে পৌঁছালে দেখা যায়, এটি ২০২২ সালে তৈরি এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের জন্য নির্ধারিত। দোকানের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এটি সমান্তরাল আমদানির মাধ্যমে এসেছে এবং পণ্যটি আসল।

নিষেধাজ্ঞার ফাঁক গলে চলা ব্যবসা

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির পর ১,৪০০ কোম্পানি রাশিয়া থেকে সরে গেলেও দেশটির বাজারে বহু পশ্চিমা পণ্য পাওয়া যাচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে মস্কোর আইনগত বৈধতা দেয়া সমান্তরাল আমদানি ব্যবস্থা, যেখানে তৃতীয় দেশ হয়ে পণ্য রাশিয়ায় প্রবেশ করে।

এই ব্যবস্থায় কোনো কোম্পানি সরাসরি রাশিয়ায় পণ্য না পাঠালেও মধ্যস্থতাকারী বা ছোট ব্যবসায়ী তা আমদানি করে।

উদাহরণস্বরূপ, অ্যাপলের রাশিয়ান খুচরা বিক্রেতা ‘রি:স্টোর’ অ্যাপলের দেশ ছাড়ার পর বন্ধ হয়ে গেলেও কয়েক মাস পরে ‘রিস্টোর:’ নামে চালু হয়। তারা হেয়ার ড্রায়ার, গেমিং কনসোল ও স্মার্ট হোম পণ্য বিক্রি শুরু করে।

আল জাজিরা গ্রাহক সেজে ফোন করলে রিস্টোর: জানায়, তাদের পণ্য আসে চীন ও দুবাই থেকে। তারা স্বীকার করে, ‘নিষেধাজ্ঞার পর বিক্রেতারা বিকল্প পথ খুঁজে পেয়েছে।’

অনলাইন মার্কেটের রমরমা

ইয়ানডেক্স ডট মার্কেট-এ শত শত বিক্রেতা আইফোনসহ অ্যাপলের বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করছে। কেউ কেউ দুই ঘণ্টার মধ্যে পণ্য ডেলিভারিও দিচ্ছে। জোয়া যেখান থেকে তার অ্যাপল ওয়াচ কিনেছেন, সেই ‘আইডস্টোর’ মাত্র একজন কর্মচারীর একটি নতুন কোম্পানি।

তারা জানায়, তারা ভারত, মালয়েশিয়া, ইউএই, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে পণ্য আমদানি করে।

নতুন আমদানিকারকদের উত্থান

যুদ্ধের আগে রাশিয়ায় অ্যাপল, স্যামসাং, ইলেক্ট্রোলাক্সের মতো কোম্পানির শাখাগুলো একচেটিয়া আমদানি করতো। এখন কাস্টমস তথ্য অনুযায়ী, এসব কোম্পানির পণ্যের আমদানি হচ্ছে অল্প পরিচিত কোম্পানি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগের মাধ্যমে।

এসব পণ্যের প্রধান উৎস চীন, হংকং, ইউএই, যারা রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞায় অংশ নেয়নি।

দুবাই হয়ে পণ্য প্রবাহ

আল জাজিরা পাইকারি ক্রেতা পরিচয়ে বেশ কিছু বড় সরবরাহকারীর সাথে যোগাযোগ করে। দুবাইয়ের বিএমজি ইন্টারন্যাশনালের বিক্রয় ব্যবস্থাপক জানান, তারা সরাসরি রাশিয়ায় বিক্রি করেন এবং নতুন ক্লায়েন্টদের সাথেও কাজ করতে আগ্রহী।

তারা জানায়, অধিকাংশ পণ্য ভারতে তৈরি এবং তারা অ্যারাবিক দেশ ও অন্যান্য বাজারের জন্য তৈরি পণ্য বিক্রি করেন।

তবে রাশিয়া থেকে অর্থ গ্রহণের জটিলতায় তারা মস্কোর অংশীদার ব্যবহারের কথা বলেন, যারা কমিশনের বিনিময়ে লেনদেন সহজ করে।

নিষেধাজ্ঞা কতটা কার্যকর?

আইএমএফ জানায়, যুদ্ধের প্রথম বছরে রাশিয়ার জিডিপি ২.১ শতাংশ কমে—যেখানে পূর্বাভাস ছিল ৮.৫ শতাংশ হ্রাস। পরে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায়। ২০২৩ সালে রাশিয়ার আমদানি যুদ্ধ-পূর্ব স্তরের প্রায় সমান ৯৯.৭ শতাংশ।

থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ব্রুগেলের মতে, ২০২১ সালের তুলনায় রাশিয়ানদের প্রকৃত ব্যয়যোগ্য আয় মাত্র ১ শতাংশ কমেছে।

প্রসাধনী ও বিলাসপণ্যের গোপন আগমন

Syoss, Schwarzkopf, Chanel-এর মতো ব্র্যান্ড সরাসরি সরবরাহ বন্ধ করলেও এখনো বড় বড় স্টোরে তাদের পণ্য মিলছে। L’Occitane তাদের রুশ শাখা স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় তুলে দিলেও সেই শাখা এখনো মূল কোম্পানির জামানত। তারা দুবাইয়ের স্মার্ট বিউটি এলএলসি নামের কোম্পানির মাধ্যমে বিপুল পণ্য পাঠাচ্ছে।

গাড়ির বাজারে চীনের জয়

পশ্চিমা গাড়ি নির্মাতারা সরে গেলে রাশিয়ার বাজার দখল করে চীনা কোম্পানিগুলো। ২০২৩ সালে রাশিয়ায় বিক্রি হওয়া গাড়ির ৫০ শতাংশই চীনা।

তিন ধরনের কোম্পানি

রুশ থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ইনফোলাইন অ্যানালিটিক্সের মতে, পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর আচরণ তিন ভাগে বিভক্ত,
১. যারা সম্পূর্ণরূপে রাশিয়া ছেড়েছে এবং সমান্তরাল আমদানিতে বাধা দেয়।
২. যারা নিষেধাজ্ঞা মেনে চললেও বিষয়টি উপেক্ষা করছে।
৩. যারা প্রক্সি বা মধ্যস্থতাকারী ব্যবস্থার মাধ্যমে কার্যত রাশিয়ার বাজারে সক্রিয়।

আল জাজিরার অনুসন্ধান স্পষ্ট করে যে রাশিয়ার বাজার থেকে পশ্চিমা ব্র্যান্ড নামমাত্র গায়েব। নিষেধাজ্ঞা কার্যত ফাঁকফোকরেই আটকে পড়েছে। ব্যবসায়িক স্বার্থ, মধ্যস্থতাকারী কাঠামো ও আইনি ফাঁক গলে রাশিয়া এখনো ভরপুর পশ্চিমা পণ্যে। নিষেধাজ্ঞা কার্যকারিতা নিয়ে তাই গুরুতর প্রশ্ন থেকেই যায়।

সূত্র : আল জাজিরা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top