ইসরাইল বর্তমানে একটি গোয়েন্দা ও সাংবিধানিক সঙ্কটের মুখোমুখি, যার কেন্দ্রে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং শিন বেট (ইসরাইলি অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা) প্রধান রোনেন বার। এই দ্বন্দ্ব একদিকে নিরাপত্তা ব্যর্থতার অভিযোগ। অন্যদিকে বিচার ও নির্বাহী শাখার সঙ্ঘর্ষের দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।
হিব্রুতে ‘শাবাক’ নামে পরিচিত ইসরাইলি প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেট ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য দায়ী একটি কৌশলগত সংস্থা। এর দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরীণ উগ্রবাদ প্রতিরোধ, রাষ্ট্রের কৌশলগত সম্পদ ও গোপনীয় সুযোগ-সুবিধার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ফিলিস্তিনি অঞ্চলসমূহে কার্যক্রম পরিচালনা। এমন একটি সংস্থার প্রধানের সাথে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর দ্বন্দ্ব ইসরাইলের নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে।
সঙ্কটটির সূচনা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর রাতে যখন গাজা থেকে আসন্ন হামলার ব্যাপারে শিন বেট সতর্কতা পায়। তবে সংস্থার প্রধান রোনেন বার এই সতর্কতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেননি এবং আক্রমণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে বিলম্ব করেন। এই ঘটনাকে বার নিজেই এক গোয়েন্দা ব্যর্থতা হিসেবে স্বীকার করেন, যা ইসরাইলকে চরম মূল্য দিতে বাধ্য করেছে।
এর আগে আল-আকসা ইন্তিফাদার পর শিন বেটের অভ্যন্তরে এক বিশেষ অপারেশন রুম গঠন করা হয়, যার লক্ষ্য ছিল ইন্তিফাদায় অংশগ্রহণকারী প্রতিটি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা। এই পদক্ষেপ শিন বেটের ভেতরে কতটা চাপে কাজ হচ্ছিল তার ইঙ্গিত দেয়। তবে এই ব্যর্থতার পর থেকে নেতানিয়াহু শিন বেট প্রধানকে সমালোচনা করতে থাকেন, যার ফলে তাদের মধ্যে উত্তপ্ত তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়।
পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যখন রোনেন বার এমন একটি নিরাপত্তা সুপারিশ জমা দিতে অস্বীকৃতি জানান, যা নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে চলমান ফৌজদারি মামলায় তাকে রক্ষা করতে পারতো। এর পাশাপাশি, শিন বেট নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ দুই সহযোগীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে, যার একটি কাতারি তহবিল সংশ্লিষ্ট। এর ফলে দ্বন্দ্ব শুধু পেশাগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ না থেকে ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত হয়।
এই প্রেক্ষাপটে নেতানিয়াহু তার ক্ষমতাসীন জোটের সম্মতিতে রোনেন বারকে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বার পদত্যাগে সম্মত না হয়ে বরখাস্তের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। সুপ্রিম কোর্ট এই বরখাস্তকে ‘স্বার্থের সঙ্ঘাত’ হিসেবে উল্লেখ করে বাতিল করে দেয়, যা নির্বাহী শাখার জন্য বড় ধাক্কা। একইভাবে, সরকারের আইনি উপদেষ্টাও বার-এর উত্তরসূরি হিসেবে নিযুক্ত ডেভিড জিন্নির বৈধতা নিয়ে আপত্তি তোলেন।
নেতানিয়াহু এই আইনগত আপত্তিগুলোকে অগ্রাহ্য করে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। এতে ইসরাইলে আইনের শাসন ও ক্ষমতার বিভাজন নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। গোটা সঙ্কটটি শিন বেট, বিচার বিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর দফতরের মধ্যে টানাপোড়েনের বহিঃপ্রকাশ এবং ইসরাইলের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার উপর একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ইসরাইলি গোয়েন্দা ব্যবস্থার ইতিহাসে অন্যতম গুরুতর সঙ্কট, যেখানে জাতীয় নিরাপত্তা রাজনৈতিক ও আইনি দ্বন্দ্বের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি কতটা গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী হবে, তা নির্ভর করবে সুপ্রিম কোর্ট, নিরাপত্তা সংস্থা ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরবর্তী পদক্ষেপের উপর।
সূত্র : আল জাজিরা