শিশুদের নৈতিক মূল্যবোধ গঠনে ২০ কৌশল

ড. আব্দুল করিম বক্কর

শিক্ষাক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা থেকে, আমি আপনাদের সামনে কিছু শিক্ষামূলক প্রতিফলন তুলে ধরছি। আমার বৌদ্ধিক ও শিক্ষাগত যাত্রাজুড়ে আমি উপলব্ধি করেছি যে শিক্ষা কোনো নির্দেশ বা শুষ্ক উপদেশের বিষয় নয়। বরং এটি এক গভীর মানবিক মিথস্ক্রিয়া—ভালোবাসা, বোঝাপড়া এবং উদাহরণের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক।
এই উপলব্ধি থেকেই আমি আপনাদের সঙ্গে কিছু ব্যবহারিক শিক্ষাগত প্রতিফলন ভাগ করে নিতে চাই, যা আমরা প্রতিদিন আমাদের সন্তানদের সঙ্গে অনুশীলন করতে পারি। শুধু পাঠদানের পর্যায়ে সীমাবদ্ধ না রেখে, বরং এক ধরনের অংশীদারিত্বের চর্চায়, যেখানে মূল্যবোধ স্বাভাবিকভাবে ও মসৃণভাবে বিকশিত হয়।

১. আমরা বেশি কথা না বলে মূল্যবোধ গড়ে তুলি।
সব মূল্যবোধ বোঝাতে বক্তৃতা প্রয়োজন হয় না। একটি সরল মনোভাব ও সৎ প্রতিক্রিয়া যথেষ্ট। যেমন: যখন আমরা আমাদের সন্তানের কাউকে সাহায্য করতে দেখি, আমরা শুধু বলি, ‘এটিকে বলা হয় সহযোগিতা। এটি একটি মহান গুণ।‘ এভাবে মূল্যবোধ শুধুই কথার মাধ্যমে নয়, কাজের মাধ্যমেও শেখানো হয়।

২. আমরা আদেশ নয়, অনুরোধ করি।
‘ঘরটা গুছাও‘ বলার বদলে যদি বলি, ‘তুমি কি গুছানো ঘর পছন্দ করো? আমরা কি একসাথে শুরু করব?‘ তাহলে শিশুর মনে বাধার বদলে চিন্তার দরজা খুলে যায়।

৩. আমরা একসঙ্গে আমাদের উপকারে আসে এমন জিনিস সঞ্চয় করি।
প্রতিদিন আমরা একসাথে একটি আয়াত, একটি হাদীস বা জ্ঞানের একটি অংশ বেছে নিই।
যেমন: ‘যে মানুষকে ধন্যবাদ জানায় না, সে আল্লাহকেও ধন্যবাদ দেয় না।‘
আমরা এটি মুখস্থ করি না, বরং এটি নিয়ে ভাবি ও অনুশীলন করি।

৪. আমরা বিচার করি না, পর্যবেক্ষণ করি।
যদি কোনো শিশু ভুল করে, সঙ্গে সঙ্গে দোষারোপ না করে জিজ্ঞাসা করি: ‘কী হয়েছিল? তোমার কেমন লেগেছিল? তুমি আর কী করতে পারতে?‘
এভাবে শিশুকে নিজেকে বুঝতে সাহায্য করি, নিজের কাছ থেকে লুকোতে নয়।

৫. আমরা সংলাপের জন্য সময় বের করি।
ঘুমাতে যাওয়ার আগে বা কোথাও যাওয়ার পথে জিজ্ঞাসা করি:
‘আজকের সবচেয়ে ভালো ঘটনাটি কী? আর কী তোমাকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে?‘
আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনি—বাধা দিই না, শুধরাতে যাই না।

৬. আমরা ভালোবাসা দিয়ে শিক্ষা দিই, ভয় দিয়ে নয়।
যখন শিশু ভুল করে, আমরা বলি: ‘তুমি আমার জন্য মূল্যবান, তোমার ভুল তোমার মূল্য কমিয়ে দেয় না। আমরা এই ভুল থেকে শিখব।‘

৭. আমরা দায়িত্ব ভাগ করি।
‘যাও তাকটা গুছিয়ে ফেলো‘ বলার বদলে বলি, ‘চলো, একসাথে তাকটা গুছিয়ে ফেলি। দলগতভাবে করলে কেমন হয়?‘
এইভাবে আমরা ভালোবাসা ও অভ্যাস গড়ে তুলি।

৮. আমরা আচরণকে প্রশংসা করি, ব্যক্তিত্বকে নয়।
‘তুমি বুদ্ধিমান‘ না বলে বলি, ‘তুমি যেভাবে সমস্যাটা সমাধান করলে, সেটা আমার ভালো লেগেছে।‘
এতে শিশুরা বুঝতে শেখে যে সে সবসময় উন্নতির সুযোগ পায়।

৯. আমরা ধৈর্য শেখাতে দৈনন্দিন পরিস্থিতি ব্যবহার করি।
যেমন লাইনে দাঁড়িয়ে বা ট্র্যাফিকে থেমে বলি: ‘এটা ধৈর্য শেখার সুযোগ। চল, আশেপাশে পাঁচটি আশীর্বাদ খুঁজে বের করি।‘

১০. আমরা উদাহরণ দিয়ে শিক্ষা দিই।
আমরা যদি নিজেই চিৎকার করি, তাহলে শিশুদের চুপ করতে বলা চলে না।
আমরা তাদের পড়তে উৎসাহিত করি, কিন্তু নিজেরাই না পড়লে, তা কাজে আসে না।
‘আদর্শ কোনো বক্তৃতা নয়, বরং তা জীবনের মাধ্যমে শেখানো হয়।‘

১১. আমরা পরিপূর্ণতার পরিবর্তে উন্নতি উদযাপন করি।
যখন শিশু ছোট একটি পদক্ষেপে উন্নতি করে, আমরা বলি: ‘তুমি আজ যেভাবে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছিলে, তা অসাধারণ লেগেছে।‘

১২. আমরা যেমন সম্মান চাই, তেমনি সম্মান দিই।
তাদের ব্যাগ খুলতে চাইলে বা কিছু ব্যক্তিগত পড়তে চাইলে বলি: ‘আমি কি পারি?‘
এভাবে শিশুরা সম্মান পায় এবং অন্যদের সম্মান করতে শেখে।

১৩. আমরা নিরাপদ পরিবেশে ভুল শেখাই।
আমরা বলি: ‘ভুল আমাদের কিছু শেখায়, ভুল আমাদের ভয় পায় না। আমরা সবাই ভুল করি, শেখাটাই গুরুত্বপূর্ণ।‘

১৪. আমরা অনুভূতি চেপে রাখি না, তার নাম দিই।
যদি শিশু কাঁদে, আমরা বলি: ‘তুমি দুঃখিত বা হয়তো রেগে গেছো, এটা স্বাভাবিক।‘
এভাবে সে নিজের অনুভূতি বুঝতে শেখে, লজ্জা পায় না।

১৫. আমরা শিক্ষার আসল অর্থ ফিরিয়ে আনি।
শিক্ষা বা অভিভাবকত্ব কোনো পূর্ণতা নয়, বরং একসাথে চলার একটি যাত্রা।
‘সন্তানের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই একজন ভারসাম্যপূর্ণ, প্রেমময় ও সচেতন মানুষ গড়ার সুযোগ।‘

১৬. আমরা শব্দের ব্যবহার নিয়ে সচেতন থাকি।
ভুলভাবে কিছু বললে আমরা ক্ষমা চাই, এবং বলি: ‘আমি এটা আরও ভালোভাবে বলতে চেয়েছিলাম, আবার বলি।‘
শিশুরা আমাদের ভাষা থেকে শেখে, শব্দ মুখস্থ করার আগেই।

১৭. আমরা সিদ্ধান্তে তাদের অংশীদার করি।
পরিবারে কোনো পরিবর্তনের আগে বলি: ‘এই টেবিলটা যদি সরাই, তুমি কী ভাবছো? তুমি কি এতে রাজি?‘
এভাবে ভাগাভাগির মধ্যে নিজেদের মালিকানা অনুভব তৈরি হয়।

১৮. আমরা প্রতিটি গুণকে জীবনের আচরণের সঙ্গে যুক্ত করি।
যেমন শিশু ভুল স্বীকার করলে বলি: ‘এটাই সেই সততার উদাহরণ, যা আমরা আলোচনা করছিলাম।‘
নীতিকে বাস্তব আচরণের সঙ্গে যুক্ত করলে তা হৃদয়ে গেঁথে যায়।

১৯. আমরা তুলনা নয়, উৎসাহ দিই।
‘তোমার ভাই তোমার চেয়ে ভালো‘ বলি না, বরং বলি: ‘তুমি চেষ্টা করছো, আর সেটা দারুণ! চালিয়ে যাও।‘
তুলনা নিরুৎসাহিত করে, উৎসাহ অনুপ্রাণিত করে।

২০. আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিটি শিশুই আলাদা।
প্রতিটি শিশুর বোঝার ধরণ ও বিকাশের গতি আলাদা।
তাই আমরা প্রত্যাশা কমাই, ভালোবাসা বাড়াই।
‘তোমার সন্তান অন্য কারো মতো নয়, তাই তাকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা কোরো না।‘

এই প্রতিফলনগুলো আপনার হৃদয়ে জায়গা করে নিক এবং আশপাশের সবার সঙ্গে শেয়ার করতে দ্বিধা করবেন না—কারণ যে জ্ঞান আমরা অর্জন করি, সেটাই আমাদের জীবনকে উন্নত করার এক কার্যকর হাতিয়ার।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top