সংবিধান, জাতীয় পরিচয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন

সংবিধান এমন হলেও চলে

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী

সংবিধান একটি দেশের অন্তর্গত পরিচয় এবং গঠনতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য বহন করে। বিশ্বদরবারে জাতির জাতীয় মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিতকল্পে মানবিক ও বৈষম্যহীন, সর্বজনগ্রাহ্য, সমৃদ্ধ একটি সংবিধান রচনা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ দেশ স্বাধীনের পর জনআকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সংবিধান যথাযথভাবে রচিত হয়নি। জাতীয়তা ও ধর্মীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক যে অস্পষ্টতা ছিল, পরবর্তী সময়ে তা ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে কিছুটা ঠিক হয়। এর মধ্যে নাগরিকদের জাতীয় পরিচয় জাতিগত বাঙালি নয়; বরং রাষ্ট্রগত পরিচয়ে ‘বাংলাদেশি’ হওয়া (কেননা বাংলাদেশে আরও নৃ-গোষ্ঠী বা ভিন্ন জাতি রয়েছে। তা ছাড়া অন্য দেশেও বাঙালি রয়েছেন, যারা জাতিতে বাংলাদেশি নন।) এবং সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি অংশে ‘মহান আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসই হইবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি’ এমন একটি বাস্তবোচিত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের পর সংবিধান নতুন করে রচিত, পুনর্লিখিত কিংবা সংশোধিত হবে বলে শোনা যাচ্ছে। যদি নতুন সংবিধান লেখা হয় তাহলে পূর্ণাঙ্গ সংবিধান রচনা করে দিতে আমরা তৈরি আছি। যদি পুনর্লিখনের সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে এ কাজ সম্পাদনের জন্যও আমরা প্রস্তুত। তবে যদি কেবল সংশোধন করা হয় তাহলে আমরা প্রস্তাব করছি যে, এ সময় খেয়াল রাখতে হবে, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে সম্মান জানিয়ে সংবিধান সংস্কার ও পুনর্লিখন করতে হবে।

আমাদের প্রাথমিক ও খসড়া প্রস্তাবনা নিচে দেওয়া হলো :
০১. সংবিধানের পুনর্লিখনে এটা আবশ্যিকভাবে উল্লেখ করতে হবে যে, ‘এই সংবিধানে যাহা কিছুই থাকুক (কোনো অনুচ্ছেদ, উপ-অনুচ্ছেদ, ধারা, বিধি বা উপ-বিধি ইত্যাদি) জনগণের ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের সহিত সাংঘর্ষিক হইলে তাহা বাতিল বলিয়া গণ্য হইবে।’

০২. সকল নাগরিক তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক বিষয়াদি নিজ নিজ ধর্মের আলোকে পরিচালনা করার অধিকার ভোগ করবেন। উদার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন সুযোগ থাকা অপরিহার্য। যেন মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত থাকে। কেবল রাষ্ট্রীয় বিধিবিধান (ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়ার শর্তে) সকলের জন্য সমানভাবে পালনীয়রূপে প্রণীত হবে।

০৩. সকল ধর্মের নাগরিকদের বিশুদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করা : বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের চেতনা ও মূল্যবোধের আলোকে জাতীয় শিক্ষানীতি, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করতে হবে। উন্নত দেশসমূহের মতো ঐতিহ্যবাহী, বর্ণাঢ্য ও বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার সুযোগ অবারিত রাখতে হবে। শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। সকল ধর্মের শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ধর্মের আলোকে উন্নত মানবিক জীবনবোধের শিক্ষা, অনুশীলন, প্রশিক্ষণ লাভ করার সুযোগ করে দিতে হবে। কারণ, আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান সুনাগরিক তৈরিতে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার বিকল্প নেই।

০৪. সুদমুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পথ উন্মোচন : বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে (শেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী শতকরা ৯১% মুসলিম) ধর্মীয় বিধি-নিষেধ পরিপালনের মধ্য দিয়ে নির্দ্বিধায় অর্থনৈতিক সকল কার্যক্রমে যুক্ত করার সুবিধার্থে রাষ্ট্রীয় নীতিতে সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থার অবাধ সুযোগ উন্মুক্ত রাখতে হবে। মুসলমান জনগণের শক্তি ও সম্ভাবনার সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য যাকাত ও সাদাকাহভিত্তিক আর্থসামাজিক কার্যক্রমের সুযোগ তৈরি করতে হবে।

০৫. আপস-সমঝোতার ভিত্তিতে বিচার-সালিশের আইনি কাঠামো তৈরি : মামলার জট নিরসন ও বিচারের ক্ষেত্রে আপস-নিষ্পত্তির জন্য ব্যক্তি, পরিবার, অর্থ, সমাজ ও সংস্কৃতির নানা বিষয়ে আইন লঙ্ঘন না হওয়ার শর্তে আপস-সমঝোতা এবং সম্ভাব্য বিচার-সালিশের নীতির সহায়ক হিসাবে সমমান-সম্পন্ন অন্যান্য সনদের পাশাপাশি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কওমি সনদপ্রাপ্ত প্রকৃত অর্থে মুফতী, কাজি, ইমাম ও আলেমগণকে নিয়োগ করে নাগরিক জীবনে ন্যায়বিচার ও জনঘনিষ্ট সুশাসন ও নাগরিক জীবনের টেকসই উন্নয়নের সাংবিধানিক ব্যবস্থা করতে হবে। দীর্ঘ বছর বঞ্চিত ও অবহেলিত থাকা কওমী শিক্ষিত যোগ্য ব্যক্তিদের সনদের মূল্যায়ন করত দেশের সকল প্রাথমিক ও অন্যান্য বিদ্যালয়ে ধর্মীয় শিক্ষক হিসাবে কওমীদের কর্মসংস্থান করতে হবে। সাথে সাথে সরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের মসজিদে কর্মরত কওমী ইমামদের বর্তমান সনদের ভিত্তিতে রাজস্বভুক্ত যথাযোগ্য স্কেল দিতে হবে। মডেল মসজিদ, সশস্ত্র বাহিনীর ধর্মীয় শিক্ষক, নিকাহ রেজিস্টার ও অন্যান্য উপযুক্ত সরকারি পদে দীর্ঘ বছর অবহেলিত কওমী জনশক্তিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ করে সমাজে বৈষম্যহীন অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এতদুদ্দেশ্যে সংবিধানে আইন এবং পরবর্তীতে এই আইনের ভিত্তিতে বিধিবদ্ধ বিস্তারিত নিয়ম প্রবর্তন করতে হবে।

সংসদে প্রচলিত সংরক্ষিত আসন বাতিল করতে হবে। এর স্থলে প্রকৃত ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, রাষ্ট্র চিন্তাবিদ, প্রতিথযশা পেশাজীবী, স্কলার, দেশে ও প্রবাসে বসবাসকারী সমাজের নানা অঙ্গনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন এমন সুশিক্ষিত, দক্ষ ও অভিজ্ঞ বিশিষ্ট নাগরিকগণকে সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত করতে হবে।

০৬. সংবিধানে আবহমান বাংলার কৃষ্টি-সভ্যতার ছাপ সুনিশ্চিতকরণ : সংবিধান, রাষ্ট্রীয় আইন ও নীতিমালায় বিশ্বে পরিচিত নানা তন্ত্র ও মতাদর্শের প্রত্যক্ষ প্রতিচ্ছবি অন্তর্ভুক্ত করা চলবে না। স্বাধীন দেশে এমনটি মেনে নেওয়া যায় না। আবহমান বাংলাদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্য, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর আচরিত জীবনসংস্কৃতি, লালিত ঐতিহাসিক ভাবসম্পদের আলোকে দেশের সর্বোচ্চ আইন ও দলিল তৈরি হতে হবে। স্বাধীন দেশ ও জাতি হিসাবে এ ধরনের সংবিধান রচনাই সময়ের দাবি।

০৭. সংবিধানে বিশেষ কোনো ইজম বা তন্ত্রের এমন অস্পষ্ট উল্লেখ না থাকা, যা আমাদের সমাজ ও ধর্মীয় মূল্যবোধের বিরোধী। তন্মধ্যে ৭২-এর গণরায়বিহীন সংসদে পাসকৃত সংবিধানে যে ৪টি মূলনীতি জাতির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা বাতিল করতে হবে। এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য হলো :
ক. সেক্যুলারিজম (ধর্মহীনতা, যার ইংরেজি মূল ব্যাখ্যা হচ্ছে এই, Not related with any religious and spiritual matter) আমাদের দেশে এর অনুবাদ করা হয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষতা। অথচ এটি বর্ণিত সংজ্ঞা অনুযায়ী ধর্মহীনতা।
খ. স্যোশালিজম (সমাজতন্ত্র তথা Atheism is an inseparable part of Marxism) এ দুটি পরিভাষা সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে হবে। এ স্থলে নিচের বাক্যসমূহ সংযোজন করা :
১. ‘রাষ্ট্রে ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও সুযোগ থাকবে’।
২. ‘অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক সুবিচার সুনিশ্চিত করা হবে’ শব্দসমূহ প্রতিস্থাপিত করা।
গ. ‘গণতন্ত্র’-এর স্থলে ‘গণতান্ত্রিক রীতি-সংস্কৃতি’ লেখা। কেননা ‘গণতন্ত্র’ তথা ডেমোক্রেসি এমন একটি পরিভাষা, যার মৌলিক দাবি আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিপরীতে অন্য কোনো চেতনা ও বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ থাকে। মূল গণতন্ত্রে জনগণকে আল্লাহর স্থানে স্থাপন করা হয়েছে। এই গণতন্ত্রে সার্বভৌম কর্তৃত্ব আল্লাহর জন্য স্বীকৃত নয়। এখানে জনগণকে সর্বোচ্চ সার্বভৌমত্বের মালিক মনে করা হয়, যা কোনো মুসলমান বিশ্বাস করলে তার ঈমান থাকে না। তবে গণতান্ত্রিক রীতি-সংস্কৃতি পরিপালনে কোনো বাধা নেই। যেমন : মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, অধিকার আদায়ে সোচ্চার হওয়া, শাসকদের প্রশ্ন করা, প্রয়োজনে মিটিং, মিছিল, সমাবেশ করা, ভিন্ন মতের সঙ্গে সহাবস্থান।
ঘ. ‘জাতীয়তাবাদ’-এর স্থলে ‘জাতীয়তাবোধ’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করতে হবে। ‘জাতীয়তাবোধ’ আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির সাথে অধিকতর সাযুজ্যপূর্ণ। কেননা ‘জাতীয়তাবাদ’ একটি প্রতিষ্ঠিত বিদেশি মতাদর্শ। পাশ্চাত্য সংজ্ঞায় এ শব্দটি আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি ও সংস্কৃতির সাথে ১০০% যায় না। এর নিঃশর্ত অনুসরণ ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের জন্য উপযোগী নয়।

০৮. ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ কথাটি একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ অস্পষ্ট বাক্য। ধর্মীয় বিধানের দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি বিতর্কমুক্ত নয়। অতএব এর স্থলে ‘রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের থাকিবে। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকার গঠন এবং এতে পরিবর্তন আনয়নসহ যাবতীয় ক্ষমতা জনগণই সংরক্ষণ করেন।’ এই বাক্যংশটুকু সংযোগ করা।

০৯. ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনায় সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’-কে আইওয়াশ নীতি ও হিপোক্রেটিক উপায়ে কেবল মলাটের ওপর রাখা হয়েছে। এভাবে নয়; পূর্বে যেমন তা সংবিধানের মূল টেক্সটের আওতাভুক্ত ছিল, সেটা সেভাবেই পুনর্বহাল করতে হবে।

১০. ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’-এর যে অনুবাদ যেভাবে ৫ম সংস্করণে ছিল; ঠিক সেভাবেই পুর্নবহাল করা। নতুন ভুল অনুবাদ অনুসরণ না করা। সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহ-এর অনুবাদ পূর্বে ছিল : ‘দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহর নামে’। ঠিক এভাবেই সরাসরি অনুবাদ হিসেবে গ্রহণ করা।

১১. সংবিধানের শুরুতে নিজ নিজ সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করার সুবিধার্থে দেশের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের জন্য ‘পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে’ এই স্বতন্ত্র বাক্যটি সংযোজন করা যেতে পারে।

১২. সংবিধানের প্রস্তাবনা Atheism is an inseparable part of Marxism) এর মধ্যে পঞ্চম সংশোধনীতে ছিল, ‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ ইতিহাসের নানা সন্ধিক্ষণে আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল, সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচারের সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।’ এই প্যারাটি নতুন সংবিধানে আমাদের পূর্বে উল্লেখিত নীতি নির্দেশের আলোকে সংশোধন ও প্রতিস্থাপন করা। অর্থাৎ বিদেশি ইজমের পরিবর্তে প্রয়োজনীয় কথাটুকু নিজেদের ভাষায় লিপিবদ্ধ করা, যার নমুনা ওপরে দেওয়া হয়েছে।

১৩. ৭২-এর সংবিধান থেকে গৃহীত বর্তমান সংবিধানে লেখা আছে : ‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।’ এই ধরনের কোনো আরোপাত্মক গণবিরোধী বাক্য সংযোজন থেকে বিরত থাকা।

১৪. সংবিধানের প্রথম ভাগ অনুচ্ছেদ ২ এর (ক) : রাষ্ট্রধর্ম। ৫ম সংশোধনীতে ছিল : ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’ এভাবেই নতুন সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা।

১৫. অনুচ্ছেদ-৭। সংবিধানের প্রাধান্য। এ অনুচ্ছেদে ৭ এর (১) এবং (২) দুটি উপধারা ছিল। বিগত সরকার নতুন করে অনুচ্ছেদের সাথে ‘সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ ইত্যাদি অপরাধ’ শিরোনামে কয়েকটি ধারা সংযোজন করেছে; তথা ৭ এর ১ ও ২ উপ-ধারার সাথে ৭ এর ক-এ (১), (২), (৩) ধারা সংযুক্ত করে। এর মধ্যে ৭ এর ক এর ১ এর অধীন আরও ২টি উপ-ধারা, ২ এর অধীন ২টি উপ-ধারা সংযোজন করা হয়েছে। ৭ এর (খ) নামে নতুন একটি প্যারা ‘সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলী সংশোধন অযোগ্য’ শিরোনামে সংযুক্ত করে। যার মধ্যে অন্যতম ধারা হলো : ৭ (ক) এর (১) ধারার (খ)-তে বলা হয়েছে : ‘এই সংবিধান বা ইহার কোনো বিধানের প্রতি নাগরিকের আস্থা, বিশ্বাস বা প্রত্যয় পরাহত করিলে কিংবা উহা করিবার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করিলে- তাহার এই কার্য রাষ্ট্রদ্রোহিতা হইবে এবং ঐ ব্যক্তি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দোষী হইবে।’

এ উপঅনুচ্ছেদ সংযোজনের মাধ্যমে সংসদ সদস্য এবং দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ধর্মীয় বিশ্বাস প্রতিফলন এবং ধীরে ধীরে জনমত তৈরি করে কোনো নতুন ও পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। তাই নতুন সংবিধানে এসব বাক্য পরিহার করা। কারণ, সংবিধান কোনো ঐশী গ্রন্থ নয়। সময় এবং প্রজন্মের পরিবর্তনে এর যেকোনো অংশ গণমানুষের চাহিদা অনুযায়ী সংশোধন, পরিমার্জন বা আমূল পরিবর্তন করার সুযোগ থাকা উচিত।

১৬. ৭ (খ) ‘সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলী সংশোধন অযোগ্য’ শিরোনামে বলা হয়েছে; ‘সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ, নবম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলি-সাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সকল অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামো-সংক্রান্তত্ম অনুচ্ছেদসমূহের বিধানাবলি সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধনের অযোগ্য হইবে।’

এ জাতীয় প্যারা সংযোজনের মাধ্যমে সংবিধানকে জনগণের সাংবিধানিক সকল প্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে। এ জাতীয় কোনো শব্দ/বাক্য যেন নতুন সংবিধানে না থাকে, তা নিশ্চিত করা। যা মুক্তচিন্তা ও জনগণের ইচ্ছা এবং মতামতের স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করে। বলা বাহুল্য যে, এটি গণতান্ত্রিক রীতি-সংস্কৃতিরও বিরোধী।

১৭. সংবিধানের ২য় ভাগ, অনুচ্ছেদ ৮- মূলনীতিসমূহ। ৮ এর ১-এ পূর্বে ছিল : সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র (এই বিদেশি ও ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের সাথে বৈপরীত্যে পূর্ণ মতাদর্শ বোধক পরিভাষা থাকার কোনো বৈধতা বা সুযোগ নেই। তা ছাড়া একটি সংবিধানে গণতন্ত্রের পাশাপাশি সমাজতন্ত্র কী করে থাকতে পারে! এমন বৈপরীত্য কারা, কেন কীভাবে করতে পারলেন, সেটিও বোধগম্য নয়। যারা ৭২ এর সংবিধান রচনা করেছিলেন বলে শোনা যায়, তারা কি বুঝে-শুনে এমন করেছিলেন নাকি বিদেশি কোনো শক্তির দেওয়া চিরকুট চোখ বুজে সংবিধানে সংযোজন করেছিলেন, সেটাও একটি জিজ্ঞাসা। সংবিধানের কোনো গবেষক তাদেরকে নেশাগ্রস্ত বা অসুস্থ মস্তিষ্ক অবস্থায় ৭২-এর সংবিধান রচনা করেছিলেন অথবা ভিনদেশি সংবিধান কাটিং করে বানিয়েছিলেন বলে সন্দেহ করলেও খুব বেশি অযৌক্তিক হবে না। একটি সংবিধানে একই সাথে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র কীভাবে থাকতে পারে, এটি একটি টেন মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন।) অর্থাৎ (বিদেশী মতাদর্শ হিসাবে পারিভাষিক অর্থে এই জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্র লাগানো ছাড়াই লিখতে হবে) অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার-এই নীতিসমূহ এবং তৎসহ এই সমূহ হইতে উদ্ভূত এই ভাগে বর্ণিত অন্যসকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।’ ৮ এর ১ (ক)-তে ছিল : ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস-ই হইবে যাবতীয় কার্যাবলীর ভিত্তি।’ এই অনুচ্ছেদ হুবহু এভাবে নতুন সংবিধানের অপরিহার্য মূলনীতির অংশে থাকা নিশ্চিত করা।

১৮. অনুচ্ছেদ-১২, ৭২-এর সংবিধানে (এটি পাকিস্তানের সরকার গঠনের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। যা সংবিধান প্রণয়নের জন্য জনরায়প্রাপ্ত নয়, এমন একটি বিতর্কিত গণপরিষদ দ্বারা ৭২-এর সংবিধান গৃহীত হয় বলে বিজ্ঞ মহলে আলোচনা রয়েছে) যা ছিল তা ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছিল, সেটাকে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে পুনর্বহাল করা হয়েছে। এই পুনর্বহাল বাতিল করতে হবে।

১৯. অনুচ্ছেদ-২৫; আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন। ৫ম সংশোধনীতে ছিল : ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবেন।’ এই ধারাটি নতুন সংবিধানে থাকার নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা। সংবিধান থেকে এ অংশটুকু বিলুপ্ত করে দেওয়ার ফলে মুসলিম বিশ্বের সাথে গভীর ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক তৈরিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্রের পরম আদরনীয়, ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম প্রধান দেশ।

২০. অনুচ্ছেদ-৩৮ সংগঠনের স্বাধীনতা। পূর্বে ছিল : ‘জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ পঞ্চদশ সংশোধনীতে ‘থাকিবে’ এরপর নতুন করে ৪টি শর্তারোপ করে বলা হয়েছে :
‘তবে শর্ত থাকে যে, কোনো ব্যক্তির উক্তরূপ সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদি-
ক. উহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়;
খ. উহা ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়;
গ. উহা রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গী কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; বা
ঘ. উহার গঠন ও উদ্দেশ্য এই সংবিধানের পরিপন্থি হয়।’
এসব শর্তারোপ করায় সংগঠন করার মৌলিক অধিকার অনেকটাই বিঘ্নিত হয়েছে। সুতরাং এই শর্তারোপ নতুন সংবিধানে না থাকা নিশ্চিত করতে হবে। এসব সংযোজিত শর্তারোপের দ্বারা যে-কোনো সময় যে-কোনো সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার হরণে উক্ত ধারা ব্যবহার করার সমূহ শঙ্কা থাকে।

২১. অনুচ্ছেদ-৭০। ‘রাজনৈতিক দল হইতে পদত্যাগ বা দলের বিপক্ষে ভোটদানের কারণে আসন শূন্য হওয়া’ শিরোনামে দুটি উপ-অনুচ্ছেদ রয়েছে। দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে প্রতিটি সংবিধানে এই ধারা বহাল রয়েছে। এই ৭০ নং অনুচ্ছেদের (খ) উপ অনুচ্ছেদটি যেখানে বলা হয়েছে : (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন’ তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে।’ এর ফলে একজন সংসদ সদস্য তার ভিন্ন মতটি প্রকাশের সুযোগ পান না। যা একটি একনায়কতান্ত্রিক ধরনের ফ্যাসিবাদী নিয়ম। এতে জনপ্রতিনিধির মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিনষ্ট হয়। সে জন্য আমরা প্রস্তাব করছি যে, দলীয় শৃঙ্খলা ধরে রাখার উদ্দেশ্যে সরকারি বিলের পক্ষে ভোট দেওয়া সত্ত্বেও- ‘তবে কোনো বিলের ক্ষেত্রে যৌক্তিক দ্বিমত পোষণ, গঠনমূলক সমালোচনা এবং প্রয়োজনে ঘড়ঃব ঙভ উবপবহঃ দিয়ে নিজেকে অবাঞ্ছনীয় বিল পাশে ধর্মীয় ও নৈতিক দায় থেকে মুক্ত রাখার সুযোগ থাকবে।’ এ বাক্য অন্তর্ভুক্ত করা।

২২. নির্বাচনকালীন সরকার প্রসঙ্গ : বাংলাদেশে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উৎকণ্ঠা পরিলক্ষিত হয়। এ প্রেক্ষাপটে ৯০-এর পটপরিবর্তনের পর অসাংবিধানিকভাবে ১৯৯০ সালে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন-এর নেতৃত্বে সকল রাজনৈতিক দলের সমঝোতার ভিত্তিতে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ গঠিত হয়। ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাশ হয়। এই বিলের প্রতি গোটা বাংলাদেশের সকল দল ও মতের সমর্থন ছিল। এর অধীনে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১১ সালের ১০ মে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের একটি রায়ে সকল দলের মতামতের ভিত্তিতে গৃহীত ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’-ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়। অবশ্য সরকার চাইলে আরও দুটি নির্বাচন এভাবে করতে পারে, এমন সুপারিশ এই রায়ের পর্যবেক্ষণে ছিল, যা তৎকালীন সরকার পালন করেনি। উক্ত নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা প্রয়োজনে সামান্য সংস্কারসহ নতুন সংবিধানে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। তবে খেয়াল রাখতে হবে যেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইনগত সুযোগে কোনো দেশবিরোধী এনজিও কিংবা ধর্ম ও সমাজবিদ্বেষী ব্যক্তি এতে সংযুক্ত না হতে পারে। এ ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী তিনটি সংসদের প্রস্তাবনায় সুপ্রিম কোর্ট একটি কেয়ার টেকার সরকার গঠন করে দিতে পারে। যার এক-তৃতীয়াংশ রাজনীতিবিদ আরেক তৃতীয়াংশ পেশাজীবী এবং অন্য তৃতীয়াংশ ওলামা-মাশায়েখ থেকে নেওয়া হবে।

লেখক : দার্শনিক আলেমে দীন ও সমাজতত্ত্ববিদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *


Scroll to Top