গাজা উপত্যকায় চলমান যুদ্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত ছাড়াই সমাপ্ত হয়েছে ইসরাইলি নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার সর্বশেষ বৈঠক।
ইসরাইলি গণমাধ্যম জানিয়েছে, বৈঠকটি রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে তীব্র মতবিরোধের মধ্যে দিয়ে শেষ হয়। সেখানে কোনো সুস্পষ্ট চুক্তি বা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি।
বৈঠকের আগে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ইরানের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সাফল্যের পর এখন ইসরাইলের সামনে একাধিক সুযোগ রয়েছে। তিনি গাজায় আটক ইসরাইলি বন্দীদের ফিরিয়ে আনা এবং পরে হামাসকে পরাজিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
সাউদার্ন কমান্ড সদর দফতরে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার সদস্য ও উচ্চপদস্থ সামরিক এবং নিরাপত্তা কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে জানানো হয় যে বন্দী বিনিময়সংক্রান্ত আলোচনায় কোনো অগ্রগতি হয়নি।
সরকারি ও সামরিক মহলের মধ্যে বৈঠকে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। সেনাবাহিনী দাবি করে যে ‘অপারেশন গিডিয়ন আর্মস’ প্রায় শেষের দিকে। কিন্তু সরকারি প্রতিনিধিরা এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। তারা উল্লেখ করেন যে হামাস এখনো পরাজিত হয়নি।
ইসরাইলের হায়োম পত্রিকা জানায়, নেতানিয়াহু যুদ্ধের লক্ষ্য থেকে সরে আসেননি এবং মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্টিভ উইটকফের পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি সম্ভাব্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে, যার পর যুদ্ধ আবার শুরু হতে পারে।
সামরিক সূত্র জানিয়েছে, সেনাবাহিনী গাজায় পূর্ণ দখলের বিরোধিতা করে এবং বন্দী বিনিময় চুক্তির পক্ষে। তারা রাজনৈতিক নেতৃত্বকে গাজার ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ নির্ধারণের আহ্বান জানিয়েছে। চ্যানেল ১৩ সূত্রের মতে, সেনাবাহিনী বিশ্বাস করে যে গাজা যুদ্ধ তার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে। তবে নেতানিয়াহু মনে করেন, কোনো চুক্তি না হলে যুদ্ধ চলতে থাকবে।
নিরাপত্তা কর্মকর্তারা মধ্যপ্রাচ্যে একটি বিরল কৌশলগত সুযোগের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাদের মতে, ইরান ও গাজার সাম্প্রতিক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে বন্দী বিনিময় চুক্তিতে পরিণত করা যেতে পারে। আজ সোমবার বিকেল ৫টায় (তেল আবিব সময়) একই বিষয় নিয়ে আরেকটি মন্ত্রিসভার বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
ইসরাইলি বন্দীদের পরিবারের কমিটি নেতানিয়াহুর এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে যে বন্দী ফেরত আনা এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। তারা বলেন, যুদ্ধ বন্ধ ও বন্দী মুক্তির জন্য একটি বিস্তৃত চুক্তিই একমাত্র কার্যকর উপায়।
কমিটি নেতানিয়াহুকে রাজনৈতিক লাভের চেয়ে নৈতিক ও দাফতরিক মূল্যবোধকে অগ্রাধিকার দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। একইসাথে তারা মনে করিয়ে দিয়েছে, যদি গাজায় ইসরাইলি বসতি পুনঃস্থাপনে বাধা না থাকে, তবে যুদ্ধ বন্ধেও বাধা থাকার কথা নয়।
গাজায় বন্দী এক ইসরাইলির মা বলেন, ইরানে বোমা হামলার আগে ট্রাম্প যেমন ইসরাইলি বিমান ফিরিয়ে আনেন, তেমনি নেতানিয়াহুর উচিত এখন বন্দীদের ফেরাতে আদেশ জারি করা।
এদিকে, ইসরাইলি কৌশলগত মন্ত্রী রন ডার্মার ওয়াশিংটন সফরের আগে এক মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র গাজা যুদ্ধ বন্ধে নেতানিয়াহুর ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তার ট্রুথ সোশ্যাল অ্যাকাউন্টে গাজা নিয়ে একটি চুক্তির পক্ষে মত প্রকাশ করেন এবং সতর্ক করেন যে হামাস ও ইরানের সাথে আলোচনাকে নেতানিয়াহুর বিচার থেকে মনোযোগ সরাতে ব্যবহার করা হতে পারে।
তবে টাইমস অফ ইসরাইল জানায়, লিকুদ পার্টি ও ক্ষমতাসীন জোট নেসেটের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হস্তক্ষেপ করবে না। নেতানিয়াহু নিজেও এটি চান না।
ক্ষমতাসীন জোটের একটি সূত্র জানিয়েছে, কিছু আইনপ্রণেতা নেতানিয়াহুর বিচার বন্ধ করে গাজা যুদ্ধের অবসান ও বন্দী মুক্তির চুক্তির সম্ভাবনা আলোচনা করেছেন। তবে বাস্তবায়নের সম্ভাবনা খুবই কম।
ইসরাইলি অনুমান অনুযায়ী, গাজায় প্রায় ৫০ জন বন্দী রয়েছেন, যাদের মধ্যে ২০ জন জীবিত। অন্যদিকে, ১০ হাজার ৪০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি ইসরাইলি কারাগারে বন্দী রয়েছেন, যাদের মধ্যে বহু মানুষ নির্যাতন, চিকিৎসা অবহেলা ও অনাহারের শিকার হচ্ছেন। অনেকেই মারা গেছেন। ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলি মানবাধিকার সংস্থা ও মিডিয়া রিপোর্টে এই বিষয়টি উঠে এসেছে।
হামাস বারবার জানিয়েছে, তারা যুদ্ধের অবসান, ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার এবং ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে ইসরাইলি বন্দীদের একসাথে মুক্তি দিতে প্রস্তুত। কিন্তু নেতানিয়াহু একক বন্দী মুক্তির আংশিক চুক্তির ওপর জোর দিয়ে একটি বিস্তৃত চুক্তি এড়িয়ে যাচ্ছেন।
পূর্ণ মার্কিন সহায়তায়, ইসরাইল ৭ অক্টোবর ২০২৩ সাল থেকে গাজায় গণহত্যামূলক আক্রমণ চালাচ্ছে। এতে এখন পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত বা আহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই শিশু ও নারী। ১১ হাজারের বেশি মানুষ নিখোঁজ এবং লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
সূত্র : আল জাজিরা